মৌন বৃষ্টিদিনের রোদ্দুর কাউসার পারভীন
নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে– ধর বন্ধু আমার কেহ নাই–” – অবয়ব থেকে বোঝা যায় মানুষটা বেশ বয়স্ক, হাতে লোহার বেড়ির মত ধাতব একটা কিছু পরেছে, বাঁকা একটা লাঠি অন্য হাতে – উদ্ভ্রান্ত মুখে বেদনা, ক্লান্তি আর জীবনকে নিয়ে পরিহাস করার মতো একটা হাসি । গাড়ির কাছে এসে মাথা নীচু করে দেখছে, কয়েক মূহুর্ত পর গাড়ি রাস্তার অন্য মোড়ে চলে গেল । দরদভরা গানের গলা লোকটার । ভাবনায় মিশে রইলো গানের কথা আর সাদা চুল-দাড়িতে ঢাকা মুখটা । সংসারে এমন লোকের অভাব নেই ! রাস্তার অন্য পাশে টেম্পোর সহকারী শিশুটির বিমর্ষ ক্লিষ্ট মুখ, বাইরের দিকটায় দাঁড়ায়, কেউ ওর বসার দাবী জানায় না বা, ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের খবর নেয়না । ভবনের বাইরের দেয়ালে দড়ির প্রান্তে ঝুলে কাজ করছে নির্মাণ শ্রমিক, নিরাপত্তার আয়োজন নেই। ট্রাফিক-সিগন্যালে অনেক গাড়ির পেছনে থেমেছি সবুজতমএকটা অংশে । ঝুমঝুম বৃষ্টিতে ধুয়ে শুচি হওয়া গাঢ়-হালকা সবুজের সব স্তরের সাথে গাছের কাণ্ড, সরু ডাল আর ছায়ার রঙের বিন্যাস মেঘ আর রোদের সাথে মিশে মোহন ছবি তৈরি হয়েছে, সব যেন আকাশের স্নিগ্ধ আলোয় প্রফুল্ল । ফুলে ছেয়েছে হাসনুহেনা গাছগুলো ! কদমের কেশর এখনও বিকশিত হতে বাকি, ফুলে ভরা গাছটা । সোনালু ফুলের দু’একটা এখনও রয়েছে গাছের উঁচু ডালে । বৃষ্টি বুঝি একটু জিরোবে এখন । ঘরে ফিরে ‘নিথুয়া পাথারে’ গানটা শুনছি,বার বার শুনতে ভালো লাগছে । সন্ধ্যায় ক্ষীণ কন্ঠে ‘ইলিশ মাছ’ বিক্রি করছে কেউ – বারান্দায় গিয়ে দেখি বড় হাঁড়িতে চারটা খুব ছোট ইলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে । মাছগুলো কিনিনি, বাড়ির কেউ খাবে না । “মাছ লাগবে না, বাবা” বার বার বলি, তবুও কিনতে অনুনয় করে । কিছু মিষ্টি আর ফল দেবো কিনা জানতে চাইলাম, রাজি হয়নি । ছেলেটা চলে যাবার পর নিজেকে অবিবেচক মনে হলো – মাছগুলো কিনে নেয়া যেতো ! চোখ ফেরালেই বিপন্ন মুখের দেখা মেলে চারপাশে। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ইমেইল পাঠিয়েছে পিটার, জানিয়েছে পোষ্টকার্ডটি ওর সহধর্মিনীর প্রী-স্কুলের বাচ্চাদের হাতে এখন । পোষ্ট করেছিলাম আমি । সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের কিছু স্কুলে নিয়েছিলাম ওকে । বাচ্চাদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো, চকোলেট দেয়া আর ছবি তোলা – এর বেশী কিছু না । পিটার তেল-জাতীয় পদার্থের বিশেষজ্ঞ । উড়োজাহাজের জ্বালানীর ‘অফ্-স্পেক’ এর সমস্যা সমাধানে ওকে আসতে হয়েছিলো । ফেরার দিন বিমানবন্দরে যাবার পথে চারপাশের দৃশ্যের সংক্ষিপ্ত একটা বর্ণনা লিখলো পোষ্টকার্ডে । পশমের তৈরী ওর ছোট্ট ‘টেডি-বেয়ারে’র নামে পাঠানো হয় কার্ডটা । ‘টেডি’ পিটারের ব্যাগে সযত্নে থাকে । পেশাগত কাজে পিটার অনেক দেশে যায়, অবসরে সেখানে বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের সাথে কিছুটা সময় কাটায়, ছবি তোলে, দেশটির কিছু তথ্য সংগ্রহ করে । যাবার আগে ‘টেডি’র নামে ওর স্ত্রীর স্কুলের ঠিকানায় পোষ্টকার্ড পাঠিয়ে দেয় । ওর সহধর্মিনী তার ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে গল্প বলে আর ছবিগুলো দেখায় । ওদের জন্য কাল্পনিক মজার অংশটা হলো, ‘টেডি’ নিজেই ভ্রমন শেষে গল্পের ঝুলি নিয়ে আসে, পিটার যেখানে যায় সে স্কুলের বাচ্চাদের মাঝে বসিয়ে ‘টেডি’র ছবি তুলতে ভোলে না কখনও। পেশাগত কাজের চেয়েও পিটারের সাথে এ কাজটা বেশী আগ্রহ নিয়ে করেছি । এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের এখানে হয়তো আরও কাজ বাকি । আবার মনে হয়, দূরের আলোয় অন্যদের আনন্দ কতোটা দীপ্ত তা কি বুঝি আমি !