ঠেকানো যাচ্ছে না পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ভারি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কা
চট্টগ্রামে এক যুগের বেশি সময়ের চেষ্টায়ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতিমুক্ত করা যায়নি পাহাড়গুলো। পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের সরাতে সারা বছর প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদে তোড়জোড়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধ হয় না। গত ১৩ বছরে পাহাড়ধসে আড়াই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এরপরও জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ এখানে বসবাস করছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। প্রশাসন বলছে, বিভিন্ন পাহাড়ের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে রিটসহ নানান জটিলতায় বসবাসরতদের সরানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবার বসবাস করছে। অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৩১টি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩০৪টি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে কিংবা পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠেছে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করলেও প্রশাসনের এ বিষয়ে তেমন নজর নেই। নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে প্রতিদিনই গড়ে উঠছে ঝুঁপড়ি থেকে শুরু করে চার-পাঁচ তলার দালান। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় ততই পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানোর উদ্যোগে স্থবিরতা চলে আসে। প্রতিবছরই উচ্ছেদ অভিযানে সেবা সংযোগ লাইনসমূহ বিচ্ছিন্ন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কিছুদিন পর মানুষ আবারও ফিরে যায় পুরনো আবাসস্থলে। পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে রয়েছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। গত মে মাসে কমিটির ২১তম সভায় সেবা সংস্থাসমূহকে পাহাড়ের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রতিনিধির নাম প্রস্তাবনা চেয়ে চিঠি পাঠানো হলেও এখনো কোনো সংস্থার সাড়া মেলেনি। এদিকে রোববার (৬ জুন) সকাল থেকে টানা ভারি বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অতি ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ও ভূমিধসের শঙ্কায় ঝুঁকিতে রয়েছের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা বাসিন্দারা। যদিও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, পাহাড়ের আশেপাশে থাকা লোকজনদের সতর্ক করতে সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, সতর্ক অবস্থায় আছে প্রশাসন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক বলেন, জেলা প্রশাসনের ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেট বিভিন্ন পাহাড়ে গেছেন।
সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করছেন, তাদের সরানোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আমাদের ১০০ টা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতির কাজ চলছে। পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে বসতি স্থানান্তর প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অভিযানে নগরের ফিরোজশাহ কলোনির ঝিল এলাকার ১০-১২টি পরিবারকে নিরাপদে স্থানান্তর করা হয়েছে। মতিঝর্ণা এলাকার লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শহীদনগর সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে আড়াই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন টানা বর্ষণের ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে মারা যান ৩০ জন। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহানির পর টেকনিক্যাল কমিটি যে ৩৭ দফা সুপারিশ করেছিল সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান বলেন, যারা অবৈধভাবে এই পাহাড়গুলোতে বসবাস করছে তাদেরকে গ্যাস-পানির সংযোগ আছে। এই সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অবৈধভাবে সরকারি জমি দখল করে ভাড়া দেয়া এবং উচ্চ আদালতে মামলা চলমান থাকাসহ নানা জটিলতা থাকায় বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বেশ কয়েকটি পাহাড়ের ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট আছে এবং সে রিটের আছে আসলে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, পাহাড় দখলের পেছনে রয়েছে ভূমিদস্যুতা। যারা দখলদার, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকেন। তারা যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকারের সমর্থক গোষ্ঠী সেজে পাহাড় দখল করেন। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ এবং পাহাড় রক্ষা করতে হলে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ে ব্যাপকভাবে বনায়ন করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বলেন, ‘পাহাড় কাটা রোধে নিয়মিত মামলা করা হয়। পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়। কিন্তু এসব করেও পাহাড় কাটা ঠেকানো যাচ্ছে না। যারা পাহাড়ের মালিক তাদেরই পাহাড় রক্ষা করতে হবে। শুধু প্রশাসনের ওপর দায় চাপানো উচিত হবে না। যার পাহাড় তারই সেটা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব। নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতাযয় দিন দিন বাড়ছে পাহাড়ে বসতি। মদদ দিচ্ছে প্রভাবশালীরা। দফায় দফায় বৈঠক, তালিকা প্রণয়ন ও সুপারিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ অবৈধ বসতি সরানোর কাজ। নগর পরিকল্পনাবিদ ও সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, অবৈধ বসবাস উচ্ছেদ না করার কারণ হচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহলের লোভাতুর তৎপরতা, সেই তৎপরতা থামানোর জন্য কার্যকর কোন উদ্যোগ না নেয়া হয় না। পরিবেশ সংগঠন পিপলস ভয়েস’র সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীরা বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসসহ সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। অবৈধ বসবাসকারীরা যদি নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো সেখানে পেয়ে যান, তাহলে তো তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। কেবল বর্ষা মৌসুম এলেই প্রশাসনের টনক নড়ে। এ সময় পাহাড়ে বসবাসকারীদের সতর্ক করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্ছেদও করা হয়। শরীফ চৌহান বলেন, পাহাড়গুলোতে যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন, তাদের বেশিরভাগই ভাড়াটিয়া। তারা কিন্তু দখলদার নয়। যারা পাহাড় দখলদার, তারা এখানে থাকেন না। পাহাড় কাটার ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, সেই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। # ০৬.০৬.২০২১ চট্টগ্রাম #