হেফাজতের নতুন কমিটি প্রত্যাখ্যান শফিপন্থিদের
বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। জুনায়েদ বাবুনগরীপন্থি এই কমিটিতে কারাগারে থাকা বিতর্কিত হেফাজত নেতাদের বাদ দেয়া হলেও নাশকতা-তান্ডবের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই আছেন। এদিকে সংগঠনের প্রয়াত আমির আহমেদ শফির অনুসারীদের বাদ দিয়ে ঘোষিত কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন শফিপন্থিরা। বিতর্ক এড়াতে আহমেদ শফির বড় ছেলে ইউসুফ মাদানী সহকারী মহাসচিব করা হলে কমিটি ঘোষণার পরপর তিনিও হেফাজতের এই কেন্দ্রীয় কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। শফিপন্থিরা অভিযোগ করে বলেন, সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের কমিটির নেতাদের ইন্ধনে দেশব্যাপী নাশকতা-তান্ডব-রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড করেছে। হেফাজত নেতাদের নারী-অর্থ কেলেংকারিসহ নানা অপকর্ম রয়েছে। আইওয়াশ করার জন্য তাদের কয়েকজনকে বাদ দেয়া হলেও নাশকতা-তান্ডবের অনেক মদদদাতাদের নতুন ঘোষিত কমিটিতে রেখে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতভাবে যারা ইসলাওমের ঈমান-আকিদা রক্ষায় যারা কাজ করেছেন তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাইখুল হাদিস আহমেদ শফি সাহেবের অনুসারীদের বাদ দেয়া হয়েছে। নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ও সর্বমহলে সমালোচিত হেফাজতের ভাবমুর্তি পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে তাদের দেয়া হলেও নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এই কমিটি ঘোষণা করেছেন জুনায়েদ বাবুনগরীরা। ঘোষিত কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে মীর ইদ্রিসকে, যিনি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে হাটহাজারীতে নাশকতা-তান্ডবের অন্যতম ইন্ধনদাতা। এই মীর ইদ্রিসকে গ্রেপ্তার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এমনকি হেফাজতের পদবঞ্চিত অনেক নেতাই নাশকতার দায়ে মীর ইদ্রিসের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের চালানো তান্ডবের ঘটনায় ইন্ধনদাতা নেতা সাজিদুর রহমান ও মুফতি মুবারক উল্লাহ হেফাজতের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেয়েছেন। সাজিদুরকে যুগ্ম মহাসচিব এবং মুফতি মুবারককে সদস্য করা হয়েছে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার বিভিন্ন সংগঠন অনেকদিন ধরেই তান্ডবের ঘটনায় এই দুই নেতার গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছিল। এই দাবিতে গত ২ জুন ‘সর্বস্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী’ নামের সংগঠনটি প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে। এর মধ্যে এমন ঘোষণা আসায় ক্ষুব্ধ এসব সংগঠনের নেতারা। হেফাজতের শফিপন্থিরা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংসতার মূলহোতা সাজিদুর রহমান ও মোবারক উল্লাহ। সেখানে তারা আজও রহস্যজনক কারণে গ্রেপ্তার হচ্ছে না। তারা এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। তাদেরকে কমিটিতে রাখা মানে হচ্ছে, আগামিতেও তারা এমন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পিছপা হবে না। তাই সরকারকে উচিৎ এখনই তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করা।’ হেফাজতে ইসলামের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী। গতকাল সোমবার নতুন এ কমিটি ঘোষণার পরই হাতে লেখা এক চিঠিতে এ ঘোষণা দেন তিনি। ঘোষিত কমিটিতে সহকারী মহাসচিবের পদ দেওয়া হয়েছিল ইউসুফ মাদানীকে। চিঠিতে ইউসুফ মাদানী লিখেছেন, ‘আমি মাওলানা ইউসুফ মাদানী আজ ৭/৬/২১ ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার নাম দেখে আমি মর্মাহত। যারা আমার পিতাকে কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়েছেন তাদের সঙ্গে আমি কখনো এক হতে পারিনা। আজকের ঘোষিত তথাকথিত হেফাজতের কমিটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’ হেফাজতের প্রথম কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দীন রুহী ঘোষণা দিয়েছেন আহমদ শফীর নীতি আদর্শের ভিত্তিতে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন তারা। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির (প্রয়াত) আহমেদ শফির অনুসারী হিসেবে পরিচিত মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘গতবছরের ১৫ নভেম্বর তথাকথিত হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিলের মাধ্যমে সিন্ডিকেট কমিটি, অবৈধ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমি অনেকবার লাইভে এসে বলে এসেছিলাম। এটা একটা অবৈধ কমিটি, সিন্ডিকেট কমিটি। এটা একটা রাজনৈতিক উচ্চবিলাস এবং হেফাজতের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্যেকে বিসর্জন দিয়ে এ কমিটিকে গঠন করা হয়েছে। তথাকথিত সম্মেলনের মাধ্যমে একটি কমিটি গঠনের চার মাস সাড়ে চারমাসের মাথায় এসে বিতর্কিত হয়ে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। আবার তড়িঘড়ি করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কমিটিতে নাশকতার দায়ে কারাগারে থাকা কয়েকজনকে বাদ দেয়া হলেও নাশকতায় জড়িত ও ইন্ধনদাতা অনেককে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে। হেফাজত নেতা রুহী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের মূলধারা আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকভাবে দেশের উন্নয়ন ও দেশের সমৃদ্ধি এবং দেশের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে হেফাজতে ইসলাম। আগামীতে ইসলামের জন্য এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য ইসলামী আকিদা বিশ্বাস সংরক্ষণের জন্য হেফাজতে ইসলাম কাজ করবে। সে লক্ষ্যে আমরা অতি শিগগিরই আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের নীতি-আদর্শের হেফাজতে ইসলামের গঠন করব।’ বাবুনগরীর বিরোধী পক্ষের প্রধান নেতা হিসেবে পরিচিত এ নেতা বলেন, আহমদ শফী সাহেবের নীতি আদর্শকে বুকে ধারণ করে হেফাজতের ইসলামের কমিটি শিগগিরই পুনঃগঠন করব। এদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে গত ২৬ মার্চ দেশব্যাপী নাশকতার দায়ে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্ত করা নতুন কমিটির প্রধান লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলামের নবগঠিত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস। গতকাল সোমবার (৭ জুন) দুপুর ২টার দিকে কমিটি গঠনের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি এ মন্তব্য করেন। মীর ইদ্রিস বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নতুন করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্ত করা। অনতিবিলম্বে আটককৃত সকল আলেম-উলামা ও তৌহিদী জনতাদের মুক্তি দিতে হবে। অনেক নির্দোষ আলেম-উলামা গ্রেপ্তার হয়ে আছেন। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি তাদের মুক্তি দিন। আলেম-উলামাদের বয়ানের মিম্বার ও হাদিসের মসনদে ফেরার ব্যবস্থা করুন। এছাড়াও আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি অনতিবিলম্বে দেশের সকল কওমী মাদ্রাসা খুলে দেওয়া হোক। কওমী মাদরাসাগুলো দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। কওমী মাদ্রাসাগুলোর কারণে আমাদের দেশে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। কোনো মাদ্রাসায় করোনা সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এর আগে সোমবার (৭ জুন) বেলা ১১টায় রাজধানীর খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদরাসায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলে থাকা ও রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতাদের বাদ দেয়া হয়েছে নতুন কমিটিতে। কমিটিতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। হেফাজতের সদ্য ঘোষিত ৩৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ১৪ জনই চট্টগ্রামের এবং জুনাইদ বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সংগঠনটির আমির জুনাইদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির সালাহউদ্দীন নানুপুরী (ফটিকছড়ি), মোহাম্মদ ইয়াহইয়া (হাটহাজারী), তাজুল ইসলাম (পটিয়া), মুফতী জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী)। সংগঠনটির বর্তমান মহাসচিব হাফেজ নূরুল ইসলাম জিহাদী ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও তার পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায়। এছাড়া যুগ্ম-মহাসচিব লোকমান হাকীম (চট্টগ্রাম), আইয়ুব বাবুনগরী (ফটিকছড়ি), সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস (হাটহাজারী), অর্থ-সম্পাদক মুফতি মুহাম্মাদ আলী (হাটহাজারী), সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতী হাবিবুর রহমান কাসেমী (হাটহাজারী) এবং সদস্য ফোরকানুল্লাহ খলিল (চট্টগ্রাম) ও মাহমুদল হাসান (হাটহাজারী)। প্রসঙ্গত চট্টগ্রামের আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সূচনালগ্ন থেকে শফী সংগঠনটির আমির এবং জুনায়েদ বাবুনগরী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০১৩ সালে যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হয় হেফাজত। একপর্যায়ে ১৩ দফা নিয়ে ওই বছরের ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। ব্যাপক নাশকতা-তান্ডব চালায় হেফাজত। জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন অংশ জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করা হয়। কাসেমী মারা যাবার পর সিনিয়র নায়েবে আমীর নুরুল ইসলামকে মহাসচিব করা হয়। এই কমিটিতে থাকা যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ হেফাজত নেতারা প্রথম থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় সভায়, ওয়াজ মাহফিলে সরকার, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধীতা করে হাটহাজারীতে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ব্যাপক নাশকতা-তান্ডব চালায়। হাটহাজারী থানায় ভাঙচুর, ভূমি অফিসসহ সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। # ০৭.০৬.২০২১ চট্টগ্রাম #