কি কারণে বদলি করা হলো দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনকে?
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে রাজনৈতিক দলের নেতা সাবেক মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে মামলা, রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা, রোহিঙ্গাকে সনদ দেয়ার অভিযোগে বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান মামলা করে বেশ আলোচিত হয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২’র উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। রেলওয়ে, কর্ণফুলী গ্যাস, ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিস, নির্বাচন কমিশন অফিসের বড় কর্মকর্তা থেকে ছোট কর্মচারী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ দুর্নীতিবাজ কেউ ছাড় পাচ্ছেন না তার কাছ থেকে। এ নিয়ে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে পুরষ্কৃত করা হতে পারে বলেও ধারণা করছিলেন অনেকে। কিন্তু পুরষ্কারের বদলে উল্টো তাকে চট্টগ্রাম থেকে বদলি তরা হলো দুদক’র পটুয়াখালী অফিসে। শুধু তিনি নন, মো. শরীফ উদ্দিনসহ আরও ২১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। তার এ বদলিকে স্বাভাবিক চোখে দেখছেন না দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলকারী সংগঠকরা। দুর্নীতি বিরোধী সচেতন নাগরিরা বলছেন, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, সেখানে দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দীন ছিলেন ব্যতিক্রম। তার সাহসী অভিযান ও পদক্ষেপে দুর্নীতিবাজদের ভীত নড়ে গিয়েছিল। মূলত প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েই তাকে গণ-বদলির সিরিয়ালে ফেলে কৌশলে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে গতি কমবে আর বেপরোয়া হয়ে উঠবে দুর্নীতিবাজরা। চট্টগ্রামের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে চলমান রাখতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে শরীফ উদ্দীনের বদলি প্রত্যাহারের দাবি ওঠেছে। গত বুধবার (১৬ জুন) দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আদেশ দেওয়া হয়। আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দীন সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) ভোটার তালিকায় ১৩ রোহিঙ্গা নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত করায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আসামি তালিকায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশের তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন। মামলার বাদি দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আসামিরা একে অপরের সহযোগিতায় অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, প্রতারণার আশ্রয়ে ভুয়া পরিচয়, নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এর আগে বুধবার (১৬ জুন) হালনাগাদ ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালকসহ ইসির ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর আগে গত ১৫ জুন রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবৈধ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণের ঘটনায় চসিক’র সাবেক কাউন্সিলর সরফরাজ কাদের রাসেলসহ ৬ জন এবং ১২ জুন আরেক সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন শরীফ। আরও আগে গত ১০ জুন দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ প্রদান করায় সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় আসেন শরীফ উদ্দীন। এ মামলায় মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান ও সার্ভেয়ার মো. দিদারুল আলমকে গ্রেপ্তারও করে দুদক। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়। এছাড়া তার আরও বেশ কয়েকটি আলোচিত অভিযান ছিল। তারমধ্যে ২০২১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে সংলগ্ন কলাতলী বাইপাস রোড এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অফিস তৈরির জন্য এক একর (১০০ শতক) জমি অধিগ্রহণে জালিয়াতির ঘটনা উঠে আসে দুদকের এ কর্মকর্তার তদন্তে। এ ঘটনাসহ কক্সাবাজারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জমি অধিগ্রহণের দুর্নীতিতে জড়িত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়। এ বছরের মার্চে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে খালাসি পদে ১৯ জনকে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এক কোটি ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন শরীফ উদ্দীন। একই মামলায় দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত খালাসি, ঠিকাদার, স্কুল শিক্ষক, পিয়ন, রেলের ড্রাইভারসহ আরও ৮ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে মাঠে নামে দুদক। সরকারি হাসপাতালের টেন্ডার কারা নিয়ন্ত্রণ করে, হাসপাতালে টেন্ডারবাজি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে কারা জড়িত, বেসরকারি হাসপাতাল কারা পরিচালনা করছেন, ওই সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা এসব বিষয় তদন্তে নেমে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও কয়েকটি মামলাও করেছিলেন শরীফ উদ্দীন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষমতাশীলদের আইনের আওতায় আনার কারণেই তাকে এই ফল ভোগ করতে হচ্ছে এমনটা মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও সরকারি চাকরিতে বদলির নিয়ম আছে। তবে সাবেক মন্ত্রীপুত্র ও বেশ কয়েকজন আলোচিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার পর এই কর্মকর্তাকে বদলি করা একেবারে উচিৎ হয়নি। এতে করে কর্মকর্তাদের মনোবলে আঘাত লাগে।’ তিনি বলেন, ‘যদি এই বদলিটি রুটিন ওয়ার্কও হয় তবু দুদকের এই বদলি আদেশ দেওয়া উচিত হয়নি। এই সময়ে তার বদলির ঘটনাটি সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত হয়নি।