চা শ্রমিকদের মুল্লুক চলো আন্দোলনের শতবর্ষ : বিদ্যমান অবস্থা -তপন দত্ত
শেষ পর্ব
এইসব নির্যাতনের কাহিনী প্রচার হওয়ার পর বৃটিশ সরকার ভারতের মাটিতে এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। ১৯২১ সালে চা শ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য রয়েল কমিশন অন লেবার এনকোয়ারী কমিটি গঠিত হয়।
ক্রমে অবস্থা এত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যে, শ্রমিকরা অভাব ও নির্যাতনের তাড়নায় কাজ বন্ধ করে দলে দলে বাগান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরিনতি হলো মর্মান্তিক। এই রকম ঘটনা থেকেই ১৯২১ সালে “মুল্লুক চলো” আন্দোলন শুরু হয়। ইতোপূর্বে ভারতবর্ষে ১৯২০ সালে “ অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের” জন্ম হয়েছে। সর্বভারতীয় ভিত্তিতে প্রথম সংঠিত শ্রমিক সংগঠন।
অনেক দিনের সঞ্চিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল মুল্লুক চলো আন্দোলন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চা শিল্পের মালিকেরা বিশাল মুনাফা অর্জন করে ক্ষেত্র বিশেষে মুনাফার অংক শতকড়া ৪৫০ ভাগ পৌঁছায়। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি এক আনাও বৃদ্ধি করেনি কিন্তু যুদ্ধের পরে যখন বাজার মন্দা হলো মালিকরা সামান্য ভাতা ছাড়া মজুরি দিতে অস্বীকৃতি জানালো। মজুরি দৈনিক ৩ পয়সা ধার্য হলো। মজুরি কমানোর ঘটনা শ্রমিক বিক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি পড়লো। শ্রমিক দলে দলে বাগান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলো। সেটা ছিল অসহযোগ আন্দোলনের কাল। “১৯২০ সালে শ্রমিকরা বিভিন্ন বাগানে ধর্মঘট করে ১৯২১ সালের মে মাসে দলবদ্ধভাবে বাগান ত্যাগের মধ্য দিয়ে তাদের বিক্ষোভের চূড়ান্ত রূপ নেয়। প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক বাগান ত্যাগ করে এই সময় কিছু দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটে। যার পরিনতিতে ১৯২১-২২ সালে ৯৬ জন এবং ১৯২৫-২৬ সালে ২৪ জন কুলিকে কারাদন্ড দেয়া হয়”। (ভারতের শ্রমিক আন্দলনের ইতিহাস – সুকোমল সেন)
কুলিদের বাগান ত্যাগের ফলে মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাঁরা ষড়যন্ত্র শুরু করলো। করিমগঞ্জের রেলের ইউরোপীয় মালিকরা কুলিদের রেলের টিকেট না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা কলকাতার মেয়র জে এম সেন গুপ্তের (চট্টগ্রাম)হস্তক্ষেপের ফলে কুলিদের কাছে টিকেট বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু চাঁদপুরে আবার কুলিদের বেআইনীভাবে আটক করা হয়। ১৭ মে ১৯২১ প্রায় ১০০০ কুলি ট্রেনে উঠলেও ফরিদপুরেরর জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট উপরওয়ালার নির্দেশে কুলিদের ট্রেন থেকে নামিয়ে দিল। এদিকে করিমগঞ্জে অবস্থিত কুলিদের নিকট সরকার ও পুলিশ কর্মকর্তারা মালিকদের হয়ে কুলিদের কাছে মজুরি ৬ আনা করার প্রস্তাব দিল। কিন্তু কুলিরা বাগানে ফিরে যেতে রাজী হলোনা। যদিও পথে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় কলেরা ইত্যাদি রোগে বহু কুলি মৃত্যুমুখে পতিত হলো। ২০ মে চাঁদপুর ষ্টেশনে প্রায় ৬০০০ হাজার কুলি আটক হলো । তাঁরা রাত্রে চাঁদপুর ষ্টেশন থেকে ষ্টিমারে যাত্রার কথা ছিল তাদের। কিন্তু রাত্রে ডিভিশনাল কমিশনারের নির্দেশে ঐ রাতে গুর্খা সৈন্যরা উম্মুক্ত বেয়নেট নিয়ে স্ত্রী পুরুষ শিশু নির্বিশেষে নিদ্রিত কুলিদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। অনেককে নিহত আহত করা হলো। অনেককে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হলো।
কুলিরা ক্রীতদাশের জীবন ত্যাগ করে দেশে ফিরতে চেয়েছিল। তার বদলা হিংস্র মালিক, শোষক, ঔপনেবেশিক সরকার এভাবেই নিল। কিন্তু জনগন নীরব থাকেনি। চাঁদপুরের জনগন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সাধারণ ধর্মঘট পালন করে। ধর্মঘট এতই সফল এবং সর্বাত্মক হয় যে, কর্তাব্যাক্তিরা বাংলো পরিস্কারের জন্য ঝাড়ুদার পায়নি। শিলচরেও সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। নেত্রকোনা, ঈশ্বরগঞ্জের উকিলরা ধর্মঘটে অংশ নেয়। গোয়ালন্দে রেলওয়ে ষ্টিমারের কর্মচারীরা ধর্মঘট করে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্মচারীরা কুলিদের দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করে। রেলের চাকা বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতবর্ষে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনকে “মুল্লুক চলো” আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করা হয়। যদিও সে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। শ্রমিকদের এই আন্দোলনে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়ে আরেকটি জালিনওয়ালাবাগের সৃষ্টি করেছিল বৃটিশ সরকার।
“মুল্লুক চলো আন্দোলন” ছিল চা শ্রমিকদের মধ্যে পেশাগত চেতনার উন্মেষ ও যৌথ সংগ্রামের আকাংখার বহিপ্রকাশ। ১৯৪৭ এর পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সিলেট, চট্টগ্রামে চা শ্রমিকরা জাতিগত নিপীড়ন ও সম্প্রদায়গত নিপীড়নে ত্রিমুখী আক্রমনের শিকার হয়। কারন এই সব চা শ্রমিকরা অধিকাংশই হিন্দু ধর্মালম্বী ছিল। তারা স্থানীয় ছিলনা। সামাজিকভাবেও তাঁরা অচ্যুত ছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই ত্রিমুখী নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে চা শ্রমিকরা স্বাধীনতার যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। বাগান ত্যাগ করে অনেক শ্রমিক, কিন্তু এখনও চলছে অর্থনৈতিক নিপীড়ন। একজন চা শ্রমিকের মজুরী এখনও ১২০টাকা দৈনিক।
শ্রম আইনে চা শ্রমিকদের জন্য অনেক বৈষম্যমূলক আইন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্র্যাচুয়িটি, নৈমিত্তিক ছুটি থেকে চা শ্রমিকরা বঞ্চিত। বার্ষিক ছুটি অন্য শ্রমিকদের বেলায় ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন হলেও চা শ্রমিকদের জন্য ২২ দিন কাজের জন্য ১ দিন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের এখন দেড় লক্ষাধিক চা শ্রমিক আছে। চা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ লক্ষের উর্দ্ধে। তারা প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার। অথচ চা শিল্প বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ফসল। প্রায় ৯ কোটি কেজি চা উৎপন্ন হয়। বাজার মূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। চা উৎপাদন ও ব্যবহারে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এই চা আমদানী করতে হয়না। যদিও উচ্চবিত্তের ব্যবহারের জন্য সামান্য পরিমাণ চা আমদানী হয়। উন্নতমানের যন্ত্রপাতি, সেচব্যবস্থা চালু করলে সারা বছর অনেক উন্নতমানের চা উৎপাদন করা সম্ভব। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ও সিলেটের কোন কোন বাগান সেই ব্যবস্থায় গেছে। দেড় শতাব্দী আগে এই সব এদের পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে চা বাগান ক্রীতদাসদের জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ মালিকরা। এখন উল্টো তাদের বংশধরদের পুরুষানুক্রমে ভোগদখল করা জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। চা শ্রমিকদের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই দুর্বল। এক শ্রেণীর নেতা মালিকদের পোঁ ধরে চলে। নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। মুল্লুকে চলো আন্দোলনের শতবর্ষে এই বিরাট সংখ্যক চা শ্রমিক তাদের সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলে ন্যায্য মজুরী ও বৈষম্যমূলক আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে- এই কামনা করি।
-সমাপ্ত
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি এবং প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন