মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ : তিন – শোয়েব নাঈম
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে যেখানে জেন্ডারভিত্তিক প্রতিবাদ্য বিষয় ছিল— ‘each for equal’ অর্থাৎ ‘সবার জন্য সমতা’। একটি সমতাপূর্ণ বিশ্বের অভিপ্রায় হচ্ছে সবার জন্য সক্ষমতা, সেখানে কবি আল মাহমুদের জেন্ডার- সমতাপূর্ণ নারীবিষয়ক প্রক্ষাপটের উদ্দেশ্য ও বিধেয় এক থাকেনি কোন কালেই। মননশীলতায় নয়, নারীর অসীম স্পেসকে তিনি সীমাবদ্ধ করেছেন উপমার ছলনায় কামের অবগাহনে। প্রগতিশীল আন্দোলনের যুগে নারীকে দেখেছেন পর্ণোবুভুক্ষ লালসার আর উদ্দীপনার অবয়বে। সেই সুক্ষ্ম ছক কষেছিলেন ‘সোনালি কাবিন’ দিয়েই—
“বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানত না যা বাৎস্যায়ন আর যত আর্যের যুবতী”
ষাটের দশক থেকেই দেহেজ প্রেমের টানে দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর মতোই অবদমিত ইচ্ছা প্রকাশ করলেন কবিতার লাইনে লাইনে । কালের রেঁদার টানে একদিন ঝরে যাবে কবি আল মাহমুদের যৌন সুড়সুড়িময় অতিমূল্যায়িত এবং অসংগত ‘সোনালি কাবিন’ সনেটের সেইসব পঙক্তিগুলি—
” বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না তুমি যদি খাও তবে আমাকে দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা”
” তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ”
গ্রামবাংলার স্নিগ্ধ-সরল-মনোরমা নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে যৌনতার ইঙ্গিতবাহী কুৎসিত গ্রাম্য মেল শভিনিজমের ভাষায় লিখেছেন—
“আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল”
কামনায় অধীর হয়ে বাৎসায়নের কামসূত্রে লেখেন ‘শূন্য হাওয়া’তে—
“ঘুমের ছল কামের জল
এখনো নাভিমূলে
মোছেনি তবু আবার এলো
আগের শয্যায়।”
স্বমৈথুনের আরেক ‘মাচো’ পুরুষের অবয়বে ‘লোক লোকান্তর’এ লেখেছেন—
“শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি লজ্জায় বিবর্ণ মন ঢেকে যাবে ক্রিসেনথিমামে”
— (কবিতা: ‘সিম্ফনি’/ গ্রন্থ: লোক লোকান্তর)।
“তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার”
—(কবিতা:চক্রবর্তী রাজার অট্রহাসি/ গ্রন্থ: মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে)
” তামসিক কামকলা শিখে এলে
যেন এক অক্ষয় যুবতী
তখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল
যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল “— ‘শোকের লোবান’ ।
“ইস্পাহানের হলুদ আপেল বাগান আমার হাতে দুলে দিয়েছে
তার সুপক্ক দুটি সোনালি ফল ।
তোমার ব্লাউজের বোতাম খোলো ….”
— (কবিতা: অভিযোজনা/গ্রন্থ: আমি , দুরগামী)
বলতে সংকোচ নেই এই কবি কখনোই শৌর্য-বীর্যের প্রেমিককে তালাস করেননি তার জীবনকালে, বরং ছলে বলে কৌশলে অসদ্ভাবের কৌমের কেলি পুরুষের আহবানে লেখেছেন—
“আবার করবো পান বুকের এ উৎস ধারা হতে/জারিত অমৃত রস/এতোদিন যৌবনের নামে/যা ছিল সঞ্চিত এই সঞ্চারিত শরীরের কোষে/হে নূহ সন্তান দেবো,
আপনাকে পুত্র দেবো ” — ‘নূহের প্রার্থনা’।
বাঙালী জাতীয়তাবাদের সেই ঐতিহাসিক উত্তপ্তকালে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আরেকটি যৌনতায় ভরা আদিরসের মাহমুদীয় প্রয়োগ করলেন এভাবে—
” স্পর্ধিত রোমশ বুকে একেকটি চুম্বনের দাগ
কাঁপা ঠোঁটে এঁকে দাও ।
ভাবুক সে ডাইনি, মায়াবী
স্তন ঠোঁট নখ হতে ঢেলে নিজের পরাগ”
— ‘এমন তৃপ্তির’ / লোকা-লোকান্তর ।
“যে নারী দিয়েছে খুলে নীবিবন্ধ লেহনে পেষণে
আমি কি দেখেছি তার পরিপূর্ণ পিঠের নগ্নতা?
হয়তো জংঘার পাশে ছিল তার খয়েরি জরুল
লেহনলীলায় মত্ত যা আমার লেলিহান জিহ্বাও জানে না” …. (কবিতা: ‘আমি আর আসবোনা বলে’: গ্রন্থ/ ‘সোনালি কাবিন’) ।
অতৃপ্তির ঘোরে এই পঙক্তিগুলি একপার্শ্বিক এবং একরৈখিক ভাবনায় পুলকের প্রস্রবণ। এমন শিহরণের পঙক্তি এসব যা শীতকেও গ্রীষ্ম করে দেয়! এমন কবিতায় যৌনসংকেতের প্রত্যক্ষ স্পর্শ প্রলোভন আর স্বেচ্ছাচারিতা লুকিয়ে আছে।
“বোধের উৎস কই, কোনদিকে?
আমাকে রাখতে দাও হাত।
একবার স্পর্শ করি, শিশ্নে, সহ্যগুণে, প্রেমে
রক্তের ভিতর দিয়ে একবার দেখা যায় যদি
বিশাল মিনার সেই, যাকে লোকে পুরুষার্থ বলে।”
(কবিতা: ‘বোধের উৎস কই, কোনদিকে?’: গ্রন্থ/ ‘সোনালি কাবিন’)।
কবি আল মাহমুদের সৃষ্ট কবিতাগুলির অসংখ্য পঙক্তি স্ফূরিত হয়েছে শোণিতের মতো কামনার সঞ্চরণে। কবির চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ঠোঁট আর হাত— এসব ইন্দ্রিয়কে কামলাবণ্যের স্বাদের শিহরণে কাব্যে সর্বাধিক ব্যবহার করেছেন। কবিতার পঙক্তিতে যখন এমন যৌন সম্ভোগের ইচ্ছা প্রসারিত হয় তখন মনস্তত্ত্ব বলে কবির নিজের ভিতরেই রতিমনের প্রকৃত ক্রিয়া ও গতিপ্রকৃতি সেই লালসা দ্বারা বিশৃঙ্খলিত। পাঠকরুচিতে এমন পঙক্তি পাঠে কোনো কাব্যবোধ তৈরি করে না, পাঠক শুধু পাঠউত্তর হিউমিলিয়েশান উপভোগ করে। পাশাপাশি কবির ভয়-পরাজয় পৌরুষের আত্মবিশ্বাসহীনতা পর্যাপ্ত পরিমাণেও অনুভব হয়।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের উত্তসুরি কবি আল মাহমুদের নারী বিষয়ক কবিতাগুলিতে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের আহবান নাই, শৃঙ্খলিত নারীর দ্বীধাহীন উত্তরণের কোন ইশতেহার নাই। নারীবান্ধবহীন কাব্যনমুনায় আছে নারীর প্রতি কামজ হাহাকার, অতৃপ্ত বাসনার মাহমুদীয় বয়ান । এসব কবিতা পাঠে চিত্তবিনোদন হয় বটে , তবে কোনো মননশীলতার গাইডলাইন পাওয়া যায় না । বিংশ শতাব্দীকালে জীবন-যাপন করেও তিনি আঠারশ শতাব্দীর নারী-কাতরতায় obsessed ছিলেন শরীরস্থ রিপুর তাড়নায়।
‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে, চুল খোলা আয়েশা আক্তার’— জেন্ডার সমতাপূর্ণ প্রতিফলনের ছদ্মাবেশে আয়েশাদেরকে নিয়ে এমন কাব্য করে এভাবে বেশিদূর প্রগতিশীলতার পথে হাঁটেননি , বরং ইউটার্ণ দিয়ে একজন মধ্যসত্ত্বভোগীর মতো সুবিধাবাদীতার হিসাব কষে আয়েশাদেরকে ভিনদেশের হিজাব-লেবাস পরানোর কূটকৌশল করেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ‘because of you’ অর্থাৎ ‘তোমার জন্য হে নারী’— এই হচ্ছে এদেশের একজন কবির নিরূপণযোগ্য অবৈধতার তৃপ্তির ধ্যানধারণা থেকে প্রাপ্ত নারীবিষয়ক জাতীয় অর্জন! একটি বহুত্ববাদী সমাজে নারীর ব্যক্তিবাদ বিষয়ে রাজনীতি থেকে সাহিত্য’ই অধিকতর সচেতনার ভূমিকা পালন করে। এদেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক তাঁদের লেখনীতে নারীর প্রতি সমতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন একটি মঙ্গলজনক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে। আল মাহমুদের প্রেমনির্ভর কবিতার পঙক্তিগুলি পাঠ করলে উপলব্ধি হয় এ জাতীয় কাব্যসৃষ্টির পূর্বে তাকে জেন্ডার বিষয়ক প্রশিক্ষণ নেওয়া অবশ্যই উচিত ছিল।
৪র্থ পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ২৮ জুন ২০২১ সোমবার