মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ: চার -শোয়েব নাঈম
” মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক ক’রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধূলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধ্যে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যে দিক-পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন-মনে তাই
ভয় পেয়েছ-ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি, ‘ভয় কোরো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে-
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’
ওই – যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে!
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে,’
আমি বলি, ‘দেখো-নাচুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই ক’রে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’
কী দুর্দশাই হত তা না হলে!”
– বীর পুরুষ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জিত হতে ‘বীর পুরুষ’ কবিতাটি এখানে আলোকপাত করা হয়নি, দেশমাতৃকার বৈশিষ্ট্যে এবং মানবিকবোধে উত্তরণের ‘প্রতীক’ হিসাবে এই কবিতাটির প্রসঙ্গিকতা বিচারেই এখানে আলোচনা করা হয়েছে । পৃথিবীর মহত্তম চিন্তাকে একক মস্তিষ্কে ধারণ করেই সুনির্ণীত এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেছিলেন ১৯০৩ সালে। অপরদিকে আল মাহমুদ ভিনদেশীয় খিলজীদের আর বাংলাদেশবিরোধী- এই দুই পক্ষীয়দের তার কূটমস্তিষ্কে ধারণ করেই ‘প্রকল্প’ হিসাবেই ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতাটি লেখেছিলেন বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে । তিনি এদেশের ঐক্যবদ্ধ জাতির চিন্তা-চেতনার চিরায়ত ‘রাঙা ঘোড়ার’ শিশুতোষ কনসেপ্টকে বাতিলের ষড়যন্ত্রে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’কে ‘আল্লার সেপাই’- এর তকমা লাগিয়ে বাংলা সাহিত্যে ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছিলেন ।
কালক্রমে বাংলা ভাষার আদর্শপাঠ হয়ে ওঠা ‘বীর পুরুষ’ এই কবিতার কিশোরের আত্মিক আশ্রয় ছিল শিকড়মুখী দেশমাতৃকাবোধে স্ফুরিত স্বদেশ রক্ষাকারী এক যোদ্ধারুপী । পক্ষান্তরে ‘বখতিয়ার ঘোড়া’র উদ্ভ্রান্ত কিশোরকে কুমন্ত্রণার অঙ্গুলিনির্দেশে একদল বহিরাগত স্বদেশ দখলদারদের অভ্যর্থনা জানাতে কবিতার নামে উন্মুক্ত ইশতেহারে নির্মম অশ্বখুরের বার্তা শুনিয়েছেন মাহমুদীয় বচনে ।
‘বীর পুরুষ’ এর ভয়-ডর শঙ্কাহীন কিশোর ধনধান্যে পুষ্পে ভরা গ্রামবাংলার দূর পথ পাড়ি দিতে দিতে প্রাকৃতিক নিয়মে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যাবেলায় অনাগত কোনো বহিরাগত শত্রু-মোকাবেলার দীপ্তকন্ঠের অভয়বাণী তার জননীকে শুনানোর মাধ্যমে পাঠকদের যেভাবে নির্ভীকের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছেন কবি, যেভাবে এই বাংলা অঞ্চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অসংখ্য মাতৃভূমির রক্ষক তৈরি করেছেন এই ভূখন্ডে, সেই শক্তিশালী বুনিয়াদকে এনকাউন্টার দিতেই সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা তৈরির হীনউদ্দশ্যে স্বদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে পশ্চাদ্গামী চক্রান্তে বহিরাগত ভিনদেশী একদল দখলদারদের ‘ইসলামের টুপি’ লাগিয়ে আল মাহমুদ বললেন-
‘শোনো- বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে’!!
প্রসারিত ও পরিশীলিত ভাষায় রচিত ‘বীর পুরুষ’ এর কাউন্টার দিতে গিয়ে আল মাহমুদ শিব গড়তে কিম্ভূত বানরই গড়েছেন ‘বখতিয়ার ঘোড়া’ দিয়ে।
একটি জাতিভিত্তিক ভাষাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘূর্ণি দিয়ে ভিনদেশীয় চরিত্র সম্মিলনে ভিনদেশীয় পরিভাষায় ‘বখতিয়ার ঘোড়া’ সার্বজনীন এই সমাজে সম্প্রসারিত না হয়ে আরো উগ্রসাম্প্রদায়কে প্ররোচিত করেছে, তারচেয়ে ‘বীর পুরুষ’ কবিতাটি অধিক আদর্শপাঠ্য হয়ে অসাম্প্রদায়িক অন্ত:করণে এই বাংলাদেশে অভিষিক্ত হয়ে আছে ।
“নিশিডাক:
তার আহবান ছিলো নিশিডাকের শিসতোলা তীব্র বাঁশীর মত।
প্রতিটি মানুষের রক্তবাহী শিরায় কাঁপন দিয়ে তা বাজত
নদীগুলো হিসহিস শব্দে অতিকায় সাপের মত ফণা তুলে দাঁড়াতো
অরণ্যের পাখিরা ডাকাডাকি করে পথ ভুলে উড়ে যেত সমুদ্রের দিকে।
সে যখন বলল, ‘ভাইসব।’
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল
সে যখন ডাকলো, ‘ভাইয়েরা আমার।’
ভেঙ্গে যাওয়া পাখির ঝাঁক ভীড় করে নেমে এল পৃথিবীর ডাঙায়
কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগলো
খোলা ময়দানে।
এই আমি
নগন্য এক মানুষ
দেখি, আমার হাতের তালু ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে
এক আগুণের জিহবা।
বলো, তোমার জন্যই কি আমরা হাতে নিইনি আগুন?
নদীগুলোকে ফণা ধরতে শেখাই নি কি তোমার জন্য–
শুধু তোমার জন্য গাছে গাছে ফুলের বদলে ফুটিয়েছিলাম ফুলকি,
আম গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলেছিল
গ্রেনেড ফল। আর সবুজের ভেতর থেকে ফুৎকার দিয়ে
বেরিয়ে এল গন্ধকের ধোঁয়া। আহ্
আমি এখন আর চোখ মেলতে পারছি না।”
জাতির পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও লিখেছেন ‘নিশিডাক’ কবিতা পঁচাত্তরে অগাস্টের নৃশংস হত্যার কিছুকাল পূর্বে , কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের রক্তের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতায় মানুষের কবন্ধে শেয়ালের মুণ্ডু বসিয়ে মধ্যসত্ত্বভোগী চরিত্রে এদেশীয় তালেবানদের অতিশয় তুষ্ট করে ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ দিয়ে জেহাদ ঘোষণা করলেন –
“মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।”
( চলবে…..)
৫ম পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ৫ জুলাই ২০২১, সোমবার