শিল্প সাহিত্য

মাস্টার মশায়

-মহসিন সিদ্দীক

আমরা তখন ছিলাম নেত্রকোনায়; থাকতাম মগরা নদীর ধারে, সাহেব পাড়ায়। সে সময় ওটা ছিল ছোট একটা নিরিবিলি শহর। বাবা ছিলেন খাদ্য বিভাগের মহাকুমা প্রধান, অন্য সব সরকারি বিভাগের প্রধানদের মধ্যে তিনিও একজন। ইংরেজ আমলে মফস্বল শহরে প্রশাসনিক প্রয়োজনে বিদেশী ও দেশী সাহেবদেরে বসবাস করতে হতো অজ-বাংলার এ’কোনে সে’কোনে। সেটা সহনশীল করার প্রচেষ্টা তারা যতখানি সম্ভব, করেছিল। শহরের সবচেয়ে বাঞ্চনীয় এলাকায় তাদের থাকা, টেনিস কোর্ট, ক্লাব, ইত্যাদির ব্যবস্থা ছিল সে কারণেই। সে সব ঢাকা, কলকাতা, দিল্লী কিম্বা লন্ডনের জীবনের সম্পূর্ণ প্রতিকল্প নাহলেও তাদের সুদুর প্রবাসজীবন সহজতর করায় সাহায্য করেছিল সন্দেহ নেই। স্বাধীনতার পর দেশী সাহেবদের জন্য এইসব অধিবৃত্তি অনিচ্ছায় ঢাকা শহরের বাইরে থাকার বাধ্যতার পারিশ্রমিক বলে গন্য হত। অন্য সব পাড়া থেকে বিচ্ছিন্ন নদীর ধারে সারি সারি সরকারি বাড়ী, তার একপ্রান্তে আমাদের বাসা, অন্য প্রান্তে মহাকুমা প্রধানের বাংলো। পেছনে বিশাল মাঠ। চার দিক খোলামেলা। নদীর ওপারে ছোট ছোট গ্রাম, একটা মন্দির। সন্ধাবেলা শঙ্খ-ধ্বনি শোনা যেত; শীতের শান্ত নদীর জলে প্রদীপ ভাসত দেয়ালীর সময়। ওপারে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে এলে তাদের কোলাহলে এপাড়ায় ক্ষণিকের জন্য অলস কৌতুহল ছাড়া যোগাযোগ ছিলনা এই দুই জগতের। প্রায় আধমাইল দূরে খেয়া, ওপারে যাবার। একমাত্র উপায়। সেই খেয়ার মন্থর গতি’ই এই শহরের জীবনধারার নির্ধারক ছিল। সেই যে ‘শান্ত নদীটি, পটে আঁকা ছবিটি …’, প্রায় তারই প্রতিবিম্ব।

আমরা ছোট ছিলাম, তবুও পাড়ার ওপর ছিল আমাদের অপরিমিত অধিকার। যত্র-তত্র আমাদের প্রবেশে ছিলনা কোন বাধা। ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াতাম অনাবিস্কৃত কূল গাছের খোঁজে। যদিও নিয়মবদ্ধ ভাবে সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসতে হতো, পড়াশোনায় মন ছিলনা বিন্দুমাত্র। বাবা-মা ব্যস্ত সংসারের উৎকণ্ঠা নিয়ে, আর আমার মন ছিল ফুটবল ক্লাবের নানা ব্যবস্থাপনার ওপর। একাধিক কাজে এক সঙ্গে নিযুক্ত থাকার ভান আমি সেই বয়সেই রপ্ত করেছিলেম – একদিকে তারস্বরে পাঠ্য বই থেকে পড়া, অন্যদিকে ক্লাবের স্বনির্বাচিত নেতার অবান্তর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট নানা সমস্যার সমধানে মনকে ব্যস্ত রাখা। ফলে চতুর্থ শ্রেনীর বাৎসরিক পরিক্ষায় বসে হঠাৎ এই উপলব্ধির উদয় হল যে দিনের পর দিন তারস্বরে তার বর্ণনা পড়া সত্বেও, টাইটানিক যে কি বস্তু, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই!

বলাবাহুল্য, পরীক্ষার ফল বেরুবার পর বাড়িতে ভীষন গোলযোগ। চিৎকার, হৈহল্লা, দুয়েক দফা চড়-চাপাটি তে এর সমাপ্তি হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হল না। বাবা সজোরে ঘোষনা করলেন যে আমার পড়াশোনার কোন আশা নেই। মাকে বললেন, আমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হোক, খেত-খামারে কাজের লোকের দরকার। আমার বয়স মাত্র দশ-এগারো তখন; মা সে কথা স্বরণ করিয়ে দিলেও বাবার হতাশার গভীরতা দেখে ভয় হলো, আমার ভবিষ্যৎ গ্রামের বাড়িতেই।

দিন কয়েক গেল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে খাওয়া শেষে খেলতে বেরুব, মা রান্নাঘর থেক চেঁচিয়ে বললেন – সাবধান, ঘর থেকে বেরোবেনা। তোমার মাস্টার আসছে আজ। মাস্টার আসছে! শুনে’ত অবাক। প্রথম হলাম খুবই বিরক্ত। স্কুলের পর সন্ধে হবার আগ পর্যন্ত ভোঁভো করে ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার নিত্যকার রুটিন। আর সব ছেলেমেয়েরা বাইরে সর্দারের অপেক্ষায়, তাদের নিরাশ হতে হবে। তবে একটু ভেবে বোঝা গেল যে দেশের গ্রামে গিয়ে খেত মজুরির কাজের পরিবর্তে চুক্তি হিসেবে এটা বোধ হয় মন্দ নয়।

আধ ঘন্টা পর মাস্টার মশায় এলেন। ভয়ে ছিলাম বুড়ো এক পন্ডিত আসবেন হয়ত বাংলা শেখাতে; অবশ্য অন্যান্য বিষয়ে আমার যোগ্যতা বাংলার তুলনায় এমন কিছু বেশি ছিল, তা নয়। ইনি ময়মনসিংহের কলেজ থেকে সদ্য বি এ পাস করে বাবার আফিসে কেরানীর কাজে ঢুকেছেন। সম্প্রতি বিয়েও করেছেন, ফলে সংসারের আয় বাড়ানোর প্রয়োজন। তাই সপ্তাহে তিনদিন আফিসের পর তিনি আসবেন ঠিক হয়েছে। নাম শঙ্কর ভট্যাচার্য।

শঙ্কর মাস্টার ছিলেন খুব অমায়িক মানুষ। অল্পেই তিনি আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে শেখালেন। আমার মস্তিস্কের ক্ষমতা খারাপ ছিলনা, ছিল উৎসাহের অভাব। ঘরের খেয়ে বনের না হোক অন্ততঃ পাড়ার মোষ চড়িয়ে বেড়ানোর অভ্যাস। কাঞ্চনজংঘা সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনীর জন্য যে পরিমান পড়বার ক্ষমতার প্রয়োজন, তা আমার আয়ত্বে ছিল; এর বেশি পড়ার দরকার কি, তা বোঝার ইচ্ছা কিম্বা সময় আমার ছিল অতি স্বল্প। শঙ্কর মাস্টারের পাল্লায় পড়ে সে সব ধ্যান ধারণা বদলাতে হলো। আমি সব কিছু বুঝিনি তখন – সেটা ছিল ভাষা আন্দোলনের যুগ, এখন মনে হয় তিনি সম্ভবত তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছিলেন আদর্শবাদী ভাবুক মানুষ, কবি; তাঁর সংস্পর্শেই বোধ হয় আমি সেসব ব্যাধিতে আক্রান্ত হই। অনেক কিছু পড়ে শোনাতেন, সবই ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে সুভাষ মুখোপধ্যায়’র একটা বই থেকে পড়ে শুনিয়েছিলন, “চৈত্র মাসে যদি কখনো ময়মনসিংহ যাও, রাত্তিরে উত্তর শিয়রে তাকাবে। দেখবে, এক রাশ ধোয়াটে মেঘে কারা যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ওটা আগুন নয়, গারো পাহাড়”। ক্রমশ, শঙ্কর মাস্টার মশায় আমাকে সেই আগুন দেখতে শিখিয়েছিলেন।

মুশকিল ছিল যে মাস্টারের দায়িত্ব পড়শোনার তদারক করা, আমার আর সব বদঅভ্যাস বদলানো নয়। বাইরের পৃথিবী জানুক বা নাজানুক, সরকারি চাকুরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে অনেক কিছুর অভাব ছিল, শুধু অভাব ছিলনা সক্রিয়ভাবে নীতি-জ্ঞান শেখানোর প্রচেষ্টা। তার একাটা পরিনতি ছিল, কখনো নগদ পয়সা আমাদের হাতে দেয়া হতো না। বলা হতো, যদি কিছু কিনতে চাও, বলবে; ন্যয্য হলে কিনে দেয়া হবে। আড়িপেতে বড়দের কথা-বার্তায় বুঝতাম তাদের ধারণা ছিলো পয়সা হাতে থাকলে আমাদের সিগারেটে আসক্তি অনিবার্য। মাঝে মধ্যে দু’একটা আবদার পূরন যে হ্তো না, এমন নয়। মুশকিলটা ছিল অন্য রকম, আর তার মুখোমুখি হতে হতো টিফিনের সময়। দত্ত হাই স্কুলের গেটের বাইরে সারা বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু মুড়কি, বুট ভাজা, তেলে ভাজা, ছোলা-ভূনা (তার সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, অজানা মসল্লা, আর তেলের একটা চাটনি দেয়া হ্তো, যার কথা ভাবলে এই বুড়ো বয়েসেও জিভে জল আসে) ইত্যাদির আবির্ভাব হতো। কাঁচা রাস্তার ওপারে মেয়েদের স্কুল। পকেটে পয়সা না থাকলে দুপুরের ধূলায়, মাছি, ছেলে মেয়েদের ভীড়, চিৎকার ইত্যাদি মিশ্রিত সেই অতি-উত্তেজক পরিবেশ এড়নোর একমাত্র উপায় ছিল ক্লাস-ঘরে একা বসে থাকা; সেটা ছিল অসম্ভব, আর সেই সব খাবার থেকে বঞ্চিত থাকার কস্ট ছিল অবর্ণনীয়।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ একথা বাংলাভাষী দশ-এগারো বছরের কোন বালক-বালিকা না শুনেছে? আর সেই বিশেষ মৃত্যুর ভয় অবজ্ঞা করেনি, তাদের সংখ্যা ও নিশ্চয় সামান্য নয়। মা অতিথিদের ব্যবহারের থালা-বাটি যত্ন করে রাখার আলামারীতে খুচরো পয়সা রাখতেন লক্ষ্য করেছিলাম। তা থেকে দু’আনার কমতি তিনি টের পাবেন, সেটা আমার ভাবার কোন প্রয়োজন ছিলনা। বলা বাহুল্য, সে দু’আনায় যে অপরিসিম ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির সম্ভাবনা বিনিয়োগ ছিল, তার কাছে নীতিজ্ঞান, বুদ্ধি, ভয়, মৃত্যু ইত্যদির মূল্যায়ন ছিলো আমার কাছে অবান্তর।।

বিকেলে যথারীতি শঙ্কর মাস্টার এসেছেন। হঠাৎ মা ঘরে ঢুকলেন। মুখ ভার রাগে লাল, হাতে বাঁশের কঞ্চি। -আমাকে না বলে তুই পয়েসা নিয়েছিস কেন আলমারী থেকে? – কই, আমি ত নেয়নি কিছু। আমার কথা শেষ হবার আগেই চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে বেধড়ক পিটুনি শুরু হলো। শুধু শুনলাম, মিথ্যে কথাও বলতে শিখেছিস?” মাস্টার মশায় প্রথম হতভম্ব হলেও মিনিট কয়েক পর আমার আর মায়ের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টির প্রচন্ড প্রচেষ্টা চালালেন। তিনি আকুতি করে বললেন, ‘ও যখন বলছে পয়সা নেয় নি, তাহলে নিশ্চয় ….’ মা গর্জে উঠে বললেন, ‘মাস্টার মশায়, ও আমার পেটের সন্তান, ওকে আমি ভালো করেই জানি। আমাকে বললেন, ‘আজ থেকে আমি যত্র-তত্র পয়সা ছড়িয়ে রাখবো। একটা পয়সা যদি এদিক-সেদিক হয়, তোর পিঠের ছাল উঠিয়ে ফেলবো আমি। আমার পিঠের ছাল যে কেন এখনো অক্ষত আছে, তার কারণের ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়। আর সে দিনের পিটুনি যে শঙ্কর মাস্টারের হস্তক্ষেপেই বন্ধ হয়েছিল, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

আর সন্দেহ নেই যে আমাকে বাংলা-অঙ্ক-ভূগােল ছাড়াও অন্যকিছু শেখাবার দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন। এটাও লক্ষ্য করলাম যে বিরল হলেও, মাঝে-মধ্যে স্কুলে যাবার সময় দু’চার পয়সা মা আমাকে দিতে শুরু করেছেন। তাতে সম্ভবতঃ শঙ্কর মাস্টারের হাত ছিল; পরিবর্তে তার কাছে সিগারেটে নেশা সম্পর্কে দু’একবার সতর্ক বার্তা শুনতে হয়েছিল।

পূজোর সময় মাস্টার মশায় আমাদের দেবী দর্শনে নিয়ে যেতেন, যদিও আমাদের আসল আকর্ষন ছিল প্রসাদ। তার লোভে পূজোর মন্ডপে স্বরস্বতী মাইকী জয়, বিদ্যা মাইকী জয়’ ধ্বনিতে যোগ দিতেও কখনো কূণ্ঠা বোধ করিনি। দূর্গা পূজোর সময়ও তাই। আর আমরা হালখাতার অপেক্ষায় থাকতাম; সেকালে এই উপলক্ষে মিস্টান্ন বিতরনের প্রচলন ছিল, আর সরকারি সাহেবের ছেলে বলে আমাদেরে বেশ খাতির ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সে সব উপলক্ষে মাস্টার মশায় ছিলেন আমাদের সঙ্গী ও তদারককারী। ঈদের সময় তিনি আসতেন আমাদের সঙ্গে খেতে, তবে একাই।

শীত এলো, ভীষন ঠান্ডার সম্ভাবনা নিয়ে; গারো পাহাড়ের শীত। বর্ষায় উত্তাল পাহাড়ী মগরা তখন  স্তিমিত। ঠিক হল আমাদের জন্য গরম কাপড় তৈরী হবে। খুব গর্বের সঙ্গে তাঁকে বলেছিলাম কি তৈরী হচ্ছে, ইত্যাদি। দরজী দোকান থেকে নতুন কাপড় যখন এলো, দেখে তিনি খুব খুশী।

নেত্রকোনায় বাবার কাজ শেষ হল বছর কয়েক পরে। সেটা অপ্রত্যাশিত ছিলনা, তাই হতো তখন। চলে যাবার পর মাঝে মাঝে মগরা নদীর কথা মনে পড়েছে, ওপারের ছোট মন্দিরে শঙ্খের ধ্বনি, দেয়ালীর সময় জলে ভাসানো প্রদীপ…। আর হাসপাতালের সামনের বিশাল বকুল গাছের নিচে শীতের চন্দ্রালোকিত রাতে দল বেঁধে ঝরা ফুল কুড়াবার স্মৃতি এখনো স্পন্দিত হয় হৃদয়ে। ‘পেছনে ফেলে আসা সময়ের হিসেব কেউ করে কিনা জানিনা …’, লিখেছিলেন এক অপ্রকাশিত লেখক; তবু সেই সময়ের কি যে এক আকর্ষন।

এর মধ্যে বাবার চকুরির পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার। এক সময় তিনি আবার ফিরে গেলেন নেত্রকোনায়, এবার ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে। আমি তখন ঢাকায় কলেজে পড়াশোনা শেষ করায় ব্যস্ত। থাকি জন কয়েক আত্মীয়ের সঙ্গে এক মেস’এ। নেত্রকোনায় ফিরে যাবার সুযোগ হলো কলেজের ছুটিতে। বাসা সেই আগের পাড়াতেই।

খবর পেয়ে মাস্টার মশাই এলেন দেখা করতে। দেখে মনে হল প্রবাহিত সময়ের তুলনায় তার বয়েস যেন হয়েছে অনেক বেশী। শুনলাম খাদ্য বিভাগের চাকরী হারিয়েছেন অনেক আগে। কোন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরী করেন। এক ছেলে, এক মেয়ে। সংসারের ভারে বিনত আমাদের শঙ্কর মাস্টার অনেক বদলে গেছেন। আমার খোঁজ-খবর নিলেন। আমার পড়াশোনার অগ্রগতিতে, রাজনৈতিক কাজ-কর্ম, সাহিত্যে ও কবিতায় উৎসাহ, আর ধ্যান-ধারনা আর আচার-ব্যবহারের পরিবর্তনে তিনি যে আনন্দিত হয়েছিলেন তাতে আমার সন্দেহ নেই। তবুও, পরে ভেবে অজান্তে যে উৎসাহ ও উদ্দিপনা আশা করেছিলাম, তাঁর চোখে মুখে তার অনুপস্থিতি আমাকে বিমর্ষ করেছিল।

দিন কয়েক পর খবর পেলাম যে তাঁর বাসায় আমাদের তিন ভাইয়ের নেমনতন্ন সন্ধ্যাবেলা।  আমাদের সরকারি গাড়িতে পৌঁছে দিল ড্রাইভার। ছোট একটা বাড়ী, নদীর পাড় দিয়ে পথ, তার ওপাশে। সামনে ছোট উঠান। একপ্রান্তে একটা তুলসি গাছ, গাছটার নিচে সলতে-প্রদিপ জলছে; তার শিখা নদীর জলে ভেজা হেমন্তের মৃদু বাতাসকে প্রতিহত করে কোনক্রমে সজীব রয়েছে। ঘরে কেরোসিনের বাতি। তার ঘোমটা পরা স্ত্রী মৃদু স্বরে বললেন, ‘কেমন আছ বাবারা?’ মাস্টার মশাই তাঁর ছেলে আর মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই প্রথম যখন তিনি আমাকে পড়াতে আসেন, তখন আমাদের যে বয়স ছিল, তাদের বয়স প্রায় তাই হবে। আমাদেরে খেতে দিলেন; দেখি ওঁদের বাচ্চা দুটো দাঁড়িয়ে আছে।। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা খাবে না? মাস্টার মশায় বললেন, ‘ওদের খাওয়া হয়ে গেছে। ছোট কিনা, খিদে লেগে যায় তাড়াতাড়ি। কেন যেন কথাটা আমার বিশ্বাস হলনা।

আমার এই প্রথম তার বাসায় আসা। যখন আমার শিক্ষক ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন উদীয়মান এক যুবক – উৎসাহী, প্রাণবন্ত, আশাবাদী। সেই মাস্টার মশায় যে ধনী লোক ছিলেন না, তা কেউ না বলে দিলেও বোঝা যেত। তবে সে জীবন যে আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলনা। এবার তার সংসারের দারিদ্র, চারপাশের হতাশার চিহ্ন আমাকে হতবাক করল। আমি সারাক্ষণ সেই সন্ধের শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম।

পরদিন সকালের উজ্জ্বল আলোতে বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছি, দেখি মাস্টার মশায় নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন। দেখে একটু অবাক লাগলাে; এত তাড়াতাড়ি আবার দেখা সাক্ষাৎ এর কারণ বা প্রয়োজন কি বুঝতে পারলাম না। গত রাত্তিরের নিমন্ত্রনের জন্য ধন্যবাদ দিলাম। তিনি এসেছেন শুনে মা চা করে দিলেন। ফেরার যখন সময় হলে বললেন, ‘চল, আমাকে এগিয়ে দেবে একটু। আঞ্জুমান  হাইস্কুলের পেছনের পুকুরটার ও মাথায় পৌঁছুলে, পুকুর পাড়ের একটা বেঞ্চিতে বসে বললেন, ‘বস একটু’। অসুস্থ না হলেও তিনি যে কিছুটা হাঁপিয়ে পড়েছেন, সেটা আমার চোখ এড়ালনা। একটু থেমে বললেন, ‘তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, সংসার নিয়ে খুব কষ্টে আছি। সরকারী চা্করিটা হারালাম অকারনে। পাঠশালায় মাস্টারী করে সংসার একেবারেই চলেনা।

তারপর, একটু ভেবে বললেন, জান, মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজেদেরই এই দেশে আমাদের আর স্থান নেই। আরো একটু ভেবে বললেন, ‘যাব’ই বা কোথায় বল? বিশেষ করে এ বয়েসে, এই সংসার নিয়ে?

অমি কি বলবো ভাবছি। তিনি বললেন, ‘যাক, যে কারণে তোমাকে ডাকা। মনে আছে, তোমাদের জন্য শীতের কাপড় তৈরী হয়েছিল সেবারে? সে গুলোতো তোমাদের আর দরকার নেই নিশ্চয়ই। শীত আসছে, তাই ভাবছি …; আমার বাচ্চা গুলোর বড় উপকার হয়।

আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। প্রথম ক’দিন মনে পড়লে ব্যাপারটা আমাকে বিষন্ন করতো। পরে কাজে কর্মে সব ভুলে গেছি।

মাস কয়েক পর বাবা এলেন আফিসের কাজে। খেতে বসে কথায় কথায় বললেন, “মাস্টার মশায় মারা গেছেন, জানিস নাকি?”

– না তো

-হাঁ, তাই। সন্ধাবেলা তুলসি তলায় নেভানো প্রদীপে আলো দিতে গিয়ে ফিরে আসেন নি। অনেকক্ষন। তাঁর স্ত্রী গিয়ে দেখেন প্ৰনামের ভঙ্গীতে ভূমিষ্ঠ তার ঠান্ডা অসাড় শরীর।

একটু থেমে বললেন, শুনলাম হার্ট এটাক।

আমার সেটা বিশ্বাস হলো না। অভাব, নিরাশা … সে সব’ই দায়ী বলে মনে হয়।

আর সে বছর ভীষন ঠান্ডা’ও পড়েছিল উত্তর শিয়রে।

——-

লেখকঃ ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা “নাগরিক” এর সম্পাদক এবং পরিবেশ প্রকৌশলী