মধ্যসত্ত্বভোগী আল মাহমুদ: ৫ম পর্ব
-শোয়েব নাঈম
শুধু জঙ্গি না হয়েও কেবলমাত্র আল মাহমুদের কবিতা এদেশে বাস্তবায়ন করেই একইসাথে ‘গাজী’ ও ‘শহীদ’ এমন যুগল জগাখিচুড়ি মার্কা খেতাব প্রাপ্তদের দ্বারা এই বাংলাদেশকে কঠিন সংকটে ফেলা দেওয়া সম্ভব। কবিতার মাধ্যমে যে কতটা ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী চিন্তার উম্মেষ এবং বিকাশ ঘটানো সম্ভব, এদেশে তার অনন্য দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘ইসলাম বাঁচানেওয়ালা’ আল মাহমুদের পানি ঘোলা করা কবিতাগুলি। এই কট্টর মানসিকতাকে তিনি আদর্শায়িত করেছেন এদেশের অপরাপর শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের অস্তিত্ব ও সত্যতার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অস্বীকার করে, ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ঘৃণায় আধিপত্যবাদী মনোভাবে। হুংকারী মওলানাদের ভাষার আচরণের মতো তিনিও চিৎকার দিয়েছিলেন-
“…আমাদের হাতে একটিমাত্র গ্রন্থ আল কুরআন,
এই পবিত্র গ্রন্থ কোনদিন, কোন অবস্থায়, কোন তৌহীদবাদীকে থামতে দেয়নি।
আমরা কি করে থামি?
……………
….আমাদের পতাকায় কালেমা তাইয়্যেবা,
আমাদের এই বাণী কাউকে কোনদিন থামতে দেয়নি
আমরাও থামবো না….” – আমাদের মিছিল।
পাকিস্তানে যে মাত্রায় আর্মি-পুলিশের মধ্যে প্রভাবিত করে আছে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিপ্রেম, সেসবের বেশ কিছু প্রতিফলন দেখেছি আমাদের দেশের কিছু কবি সাহিত্যিকদের লেখনিতে স্বাধীনতার পূর্বে ও উত্তরকালে । স্বঘোষিত ‘নায়েবে রসূল’-দের তাণ্ডবে টালমাটাল পাকিস্তানী চরিত্রের কালনাগিনীদের লেজের মতোই আল মাহমুদের লেজও নড়া শুরু হয়েছিল আশির দশকের শুরু থেকে , তার মনোঃজগত তার কবিতার উদাহরণ দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব ‘ লেজ্জা is very difficult to hide’ –
“…… কেন এক প্রাচীন তৌহীদবাদী জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার রজ্জু / তুমি পরাক্রান্ত পৌত্তলিকদের হাতে তুলে দিতে চাও?/আমরা কি বংশানুক্রমে তোমার দাস নই?/আমরা তোমার নামের কোনো জেহাদেই অতীতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি….”
– কদর রাত্রির প্রার্থনা
আল মাহমুদের কবিতায় উগ্রবাদী রাজনীতির উপকরণ আছে বিধায় বাংলাদেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীরা তার কবিতায় তাদের রাজনীতির স্বাভাবিক মিত্রকে খুঁজে পায়-
“ইসরাফিলের চোখ দুটি ঈষৎ রক্তবর্ণ ধারণ করলেও অনন্তকালের মধ্যে তিনি সজাগ / শৃঙ্গধারী এক ফেরেস্তা। তবুও তার চোখের কোল বেয়ে কিসের দুটি দাগ? তিনি কি / তার প্রথম ফুৎকারের পরিণাম দর্শনে মুহূর্তের জন্যও কেঁদে ফেলেছিলেন? তার / বৈদুর্যমণির মত চোখ দুটি থেকে কি ঠিকরে গড়িয়ে পড়েছিল বৃষ্টি? . . . ”
– পুনরুত্থানের ফুৎকার
দুনিয়ায় লাভ যতবেশি করেছিলেন তিনি, তারচেয়ে দ্বীন বরবাদ করেছিলেন সেই অনুপাতে অনেক বেশি । বঙ্গীয় সহজিয়া ইসলামের ভুখন্ডে কতলের রক্তপাতের ধর্মীয় সন্ত্রাসের মুওদূদী ধারা কায়েম করতে চিয়েছিলেন কূটকৌশলে। যে বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় বহিছে মুসলিম সুফি হজরত শাহ জালাল-শাহ পরান-শাহ মখদুম-হাজী দানেশমন্দ-দের দেয়া সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মরমীয়া ইসলামের নির্যাস, সেখানে আল মাহমুদ আহ্বান করেছেন সুদূর তুরস্কের ধর্মোন্মাদ এক উগ্র ইমামের আগমনী বার্তা দিয়ে –
“… ঢাকা তোমার মুখ । কারণ/ মগরের নকীবেরা এখন দাজ্জালের আগমনশিঙায়/ ফুঁক দিচ্ছে/
ঢাকো তোমার বুক। করাণ/ সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে আমরা/ হকের তালিকায় লিপিবদ্ধ ।/
চলো অপেক্ষা করি সেই ইমামের/ যিনি নীল মসজিদের মিনার থেকে নেমে আসবেন… “
– নীল মসজিদের ইমাম ।
আল মাহমুদের জীবনকালে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে কখনোই ধারণ করতে পারেন নাই তার মানস চরিত্রে। মানুষে মানুষে সহাবস্থানের মধ্যে যে ঐক্যের যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বছরের যাপিত জীবনে, সেখানে ইসলামের নামে কবিতার আখ্যানে ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংস্রতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন কপটবাদীতায়। সর্বধর্মে শ্রদ্ধাবান না হয়ে দেশবিরোধী গোষ্ঠীদের সাথে নিয়ে মসজিদকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন এভাবে-
” অথচ হাজার বছর আগে/ বেবিলনের ঝিলগুলো থেকে তোমার এস্ত উড়ালের শব্দে/
আমি আনন্দ প্রকাশ করতাম। বলতাম /
পালাও পালাও/ মাংসাশী বাঘমানুষ/ সিংহমানুষ/
চিতা-মানুষদের থেকে মেঘের গম্বুজে আত্মগোপন করো …. “
– আরব্য রজনীর রাজহাঁস ।
পরমতসহিষ্ণুতার নীতিবোধে উন্মুখ করে না, উদ্বুদ্ধ করে না এই কবির কবিতা পাঠে। তার কবিতা প্রভাবিত করে না দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিময় সমাজজীবন গঠনে। বীজ বোপন করে দিয়েছেন ইসলামের নামে ভয়ানক আরবীয় কট্টর সংস্কৃতি এই ভূখন্ডে এক মধ্যসত্ত্বভোগীর ধূর্ত মস্তিষ্কে।
(চলবে….)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে আগামী ১২ জুলাই ২০২১, সোমবার