যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন… – সুভাষ দে
নীরবে, নিভৃতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে জীবনের পালা সাঙ্গ করলেন অরুণ দাশগুপ্ত, কবি সাংবাদিক, আমাদের দাদামণি। এ যেন আনসাঙ এন্ড অব লাইফ। জন্মেছিলেন সামন্ত অভিজাত পরিবারে, ঐ উত্তরাধিকার ঝেড়ে ফেলে রাজনীতি, লেখালেখি, সাংবাদিকতা, পড়াশোনা, অগ্রজ-অনুজ বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সংগীত, সংস্কৃতির আসরে গুছিয়ে কথা বলে শিল্পী সাহিত্যিকদের সাথে মিলে মিশে জীবন কাটিয়ে দিলেন অরুণ দাশগুপ্ত। লিখেছেন কম, বলেছেন বেশি।
যৌবন কেটেছে কোলকাতায়, স্কটিশে পড়েছেন, সেখানেই মার্কসবাদের পাঠ নেওয়া। বদলে গেলো ছিমছাম জীবনযাপনের ছক; শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, সিপিএমএর শীর্ষ নেতাদের স্নেহ পেয়েছিলেন। তখন কোলকাতায় মার্কসবাদের অভিযাত্রা সর্বত্র। রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, লিটল ম্যাগাজিন, রাজনীতি, ছাত্র-যুব আন্দোলন সকল ক্ষেত্রে মার্কসবাদের বিপুল প্রভাব। তবে বিগত শতকের ষাটের দশক থেকেই মার্কসবাদী আন্দোলন ধূম্রজালে পড়লো। দলভাঙ্গা, বৃত্তভাঙ্গা, জীবনযাপনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করলো। মার্কসবাদ নিয়ে প্রবল ভাঙচুর শুরু হলো বিশ্বব্যাপী। প্রবল দ্বন্ধ, রাজনৈতিক সংঘাত, দেশে দেশে যে ঝড় তুললো তা অনেক তরুণকে হতাশায়, মানসিক বিপর্যয়ে নিয়ে গেলো। অরুণ দাশগুপ্ত আদর্শিক ভাঙচুরে আর কোলকাতায় থাকলেন না, চলে এলেন বাংলাদেশে। এখানে এসে শিক্ষকতা করলেন কিছুদিন, পরে যোগ দিলেন দৈনিক আজাদীতে। প্রায় অর্ধশতাব্দী জড়িয়ে গেলেন সাংবাদিকতায়। প্রথমে সহ-সম্পাদক পরে সম্পাদকীয় বিভাগে, সাহিত্যের পাতাটিও তিনি দেখেছেন। একসময় পরিচিতিও পেলেন আজাদীর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে।
তখন চট্টগ্রামের নামজাদা সাংবাদিকরা আজাদীতে, অধ্যাপক খালেদ সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক সাধন ধর, আছেন বিমলেন্দু বড়ুয়া, শরীফ রাজা, কাজী জাফরুল ইসলাম, ওবায়দুল হক, মাহবুব উল আলম, সমীর ভট্টাচার্য্য, সিদ্দিক আহমেদ, প্রদীপ দেওয়ানজী, রাশেদ রউফ প্রমুখ। অরুণ দাশগুপ্ত প্রবীণ এবং নবীন সাংবাদিকদের মাঝে সূত্রধর। চিন্তায় আধুনিক, প্রগতিবাদী, মার্কসবাদী দর্শনে অনুগামী অরুণ দাশগুপ্ত আজাদীতে আলাদা একটি জায়গা করে নিলেন। সাংবাদিকতার বাইরেও চট্টগ্রামের শিল্প-সংস্কৃতি, সংগীত, সাহিত্যের নানা সংগঠনের সাথেও জড়িয়ে গেলেন। চট্টগ্রামের মফস্বল আদলকে যারা নাগরিক আবহাওয়া দিয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমে, তাদের সংগঠকদের একজন অরুণ দাশগুপ্ত। চট্টগ্রামে তখন নাটক, আবৃত্তি, গণসংগীত, চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আজাদীর ভূমিকা, আজাদীর সাংবাদিকদের জ্ঞান, পাণ্ডিত্য আর জনসম্পৃক্ততা আজাদীকে একটি ইনস্টিটিউশনে পরিণত করেছিলো। বলাবাহুল্য, অরুণ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় আজাদীর সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক সাময়িকী একটি বিশেষ মাত্রা পেল। অনেক তরুণ কবির কবিতা এলো আজাদীতে। বলা যেতে পারে, একটা কবিগোষ্ঠী কয়েক বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলো। এদের মধ্যে বামপন্থিদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। প্রবন্ধ আর বই আলোচনায় সিরিয়াস বিষয় এলো, অরুণদা খুঁজে খুঁজে লেখক বের করলেন, নানা পেশার, নানা মতের লেখক এঁরা। ঢাকার বাইরে একটি পত্রিকার ৬০ বছর, সাংঘাতিক ব্যাপার। নিউজ, সাহিত্য- শিল্প, নানা ফিচার, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, এমনকি নারী পাতা, খোলা হাওয়া, পাঁচমিশালী এসব বিশেষ বিভাগগুলি নির্মাণে, লেখক নির্বাচনে অরুণ দাশগুপ্তের একটি ভূমিকা ছিলো।
আজাদীতে তরুণ প্রবীণ যাঁরা লিখতেন বিভিন্ন বিভাগে, তাদের সাথে নিবিড় সখ্য ছিলো অরুণদার, আড্ডায় তিনি ছিলেন মধ্যমণি। আমরা আজাদী অফিসে গিয়ে অরুণদার সামনেই বসতাম। সম্পাদকীয় লেখার সময় একটি নিরিবিলি কোণ বেছে নিতেন। একটি ছোট চিরকুটে আমাদের লেখার তারিখসহ উল্লেখ করে সম্মানীর জন্য কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ম্যানেজারের কাছে পাঠাতেন। তাঁর সই দেখে আমাদের লেখার সম্মানী দিয়ে দেয়া হতো। আজাদী পত্রিকা আধুনিক, প্রগতিশীল হওয়ার পেছনে অরুণদার একটি ভূমিকা ছিলো- একথা অনেক লেখক, কবি-সংস্কৃতিকর্মীরা স্বীকার করবেন। সাংবাদিক হিসেবে এটি তাঁর বড় কাজ ছিলো, তিনি প্রভাবিত করতে পারতেন। এটি খুব বড়ো ব্যাপার আমার কাছে- একজন সাংবাদিক খুবই সংগোপনে লেখার মাধ্যমে, লেখকদের সংযোগের মাধ্যমে, একটি পত্রিকার লোকমান্যতা প্রাপ্তিতে ভূমিকা রেখেছেন।
অরুণদার ৫০ এনায়েত বাজারে থাকার কক্ষটি (এনায়েত বাজারের মোড়ে চট্টগ্রামের এককালীন সিভিল সার্জন ডা. কেশব সেনের দোতালা বাড়ি, বর্তমানে ডেভেলপারের কল্যাণে ৯ তলা ভবন) একটি মনোরম আড্ডার জায়গা ছিল। ৩ দশকেরও বেশি সময় চট্টগ্রামের শিল্প-সংস্কৃতির বিদগ্ধ জন, সাংবাদিক, তরুণ কবি, নাট্যকর্মী, আজাদীতে লেখার লোকজন সবাই আসতেন। বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীদের একটি ভরসার জায়গা। অরুণদার আড্ডায় নিয়মিত ছিলেন প্রয়াত সায়ফুল আলম ( দৈনিক বাংলার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান), সংগীতের বড় সমঝদার ছিলেন, আসতেন নিয়মিত আবদুল হক চৌধুরী (ইতিহাসবিদ, প্রয়াত), শ্রী মিহির কানুনগো, ড. অনুপম সেন। সাংবাদিক সুখেন্দু ভট্টাচার্য, আমাদের বন্ধু, সাংবাদিক সংস্কৃতি ও নাট্য সংগঠক, অরুণদার অনেকটা সার্বক্ষণিক আড্ডার সঙ্গী। ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর উদীচী তাঁর থাকার জায়গাটি আলোচনার কেন্দ্র করেছে ত্রিদিবের সৌজন্যে। (নির্মল দা, নির্মল মিত্রের বাসায়ও আমাদের কাজের আলোচনা হতো)। মৃদুল সেন, আমি, সুখেন্দু ভট্টাচার্য ঐ বিপর্যয়ের সময়ে অরুণদার পরামর্শ নিতাম। বলা যায়, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মহল এ সময় তাঁর সুবিবেচনাপ্রসূত পরামর্শ পেয়েছে। ডিসি হিলে ১লা বৈশাখ উদযাপনের মূল সংগঠক ওয়াহিদুল হক (ছায়ানটের ওয়াহিদ ভাই, তিনি তখন চট্টগ্রামে ডেইলি লাইফ’ এর সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন) অরুণদার বাসায় আমাদের কাজ ও অনুষ্ঠান বিষয়ক নির্দেশনা দিতেন। ওয়াহিদ ভাই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন।
অরুণ দাশগুপ্ত চট্টগ্রামের কবি-লেখক সংস্কৃতি কর্মীদের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। আপ্যায়নও করতেন যথাসাধ্য, লাকি রেস্টুরেন্ট থেকে চা সিঙ্গারা, আমৃত্তি, লবঙ্গ নিয়ে আসতো।। নিয়মিত পড়াশোনা করতেন, বই-ম্যাগাজিন কেনা, আপ্যায়ন, নানা সংগঠনে চাঁদা, এসবে তাঁর বেতনের টাকা খরচ হয়ে যেতো।
তাঁর প্রকাশিত মাত্র ২টি বই। রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য’ এবং যুগপথিক কবি নবীন চন্দ্র সেন’। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে আলোচনা কম আমাদের এখানে। আর চট্টগ্রামের মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনকে নিয়ে বই এখানে চোখে পড়েনি। অরুণ দাশগুপ্ত এই অসম্পূর্ণ দিকটায় আলো ফেলেছেন।
অরুণদা বন্ধু, সতীর্থ, চেনাজানা মানুষ নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। তাঁর সান্নিধ্য, তাঁর কথা বলা, আলোচনা আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিলো। অনেক তথ্য পেতাম তাঁর আলোচনায়, মার্কসবাদী চিন্তার আলোকছটা তাঁর আলোচনায় বেরিয়ে আসতো। লোকপরিবৃত থাকতে চাইতেন অরুণদা অথচ জীবনের শেষ কটা দিন তিনি নিঃসঙ্গতায় নিক্ষিপ্ত হলেন। এই শহরে তাঁর জন্য কোন দরদি আশ্রয় মিলল না, এ দুঃখ আমাদের যাবে না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ