মতামত

রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও লেনিনের ভূমিকাঃ যুদ্ধকালীন সাম্যবাদ থেকে নয়া-অর্থনীতি (৫ম পর্ব)

-বলশেভিক বিপ্লবের চরিত্র বিচারে কুৎসামূলক তথ্যবিকৃতি ও অপপ্রচার

-অধ্যাপক সুস্নাত দাশ

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকেই এর বিরুদ্ধে পশ্চিমী পুঁজিবাদী সংবাদপত্র ও লেখক সাংবাদিকদের একাংশ খোলাখুলি কুৎসামূলক তথ্যবিকৃতি ও অপপ্রচারে নেমে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন-তথ্য কমিটির বৈদেশিক বিভাগের সহ-সভাপতি এডগার সিসন অক্টোবর বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় উপস্থিত হয়ে তার কুটনৈতিক পদমর্যাদার সুযোগে সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য ও গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়েছিলেন। তার পেশ করা ‘সিসন দলিল’ ছিল লেনিন ও সোভিয়েত বিরোধী কুৎসার প্রধান আকর – যা পাশ্চাত্য দুনিয়ার নামী-অনামী সংবাদসংস্থাগুলি ব্যাপক ব্যবহার করে বলশেভিক বিপ্লব ও তার প্রধানতম নেতা লেনিনের ভাবমূর্তি কলুষিত করতে। আমেরিকান সাংবাদিক আলবার্ট রিস উইলিয়ামস (ইনি, জন রিড এবং আরও কয়েকজন মার্কিন সাংবাদিক বিপ্লব চলাকালে রাশিয়াতেই ছিলেন) দেখিয়েছিলেন কীভাবে কুৎসামূলক অপপ্রচার আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী সংবাদ মাধ্যমগুলি লেনিনকে একজন ‘নররাক্ষস-দস্যুদলপতি-নারী ও শিশুঘাতী পিশাচ থেকে শুরু করে ‘সর্বশক্তিমান-অতিমানবে’ পরিনত করেছিল।

এমনকি তিনি চিহ্নিত হতেন ‘রাশিয়ার নয়া জার’ রূপেও। এছাড়া জার্মানির অর্থে পুষ্ট ‘জার্মান-দালাল’ ইত্যাদি ‘আবশ্যিক’ উপাধিতো ছিলই। পশ্চিমী ফিনান্স পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯১৭-১৮ সালের দু’বছর ধরে সর্বতোভাবে রাশিয়ার ভেতরে ও বাইরে ক্রমান্বয়ে প্রচার চালিয়ে যাওয়া হয়েছিল যে বলশেভিক বিপ্লবের আয়ু বড়জোর কয়েকদিন-কয়েকমাস বা বছর খানেক; সর্বতোভাবে সাহায্য করা হচ্ছিল প্রতিবিপ্লবী কর্মকান্ড ও অভ্যুত্থানগুলিকে; প্রমাণ করার চেষ্টা চলছিল যে যুদ্ধ থেকে রাশিয়াকে বার করে আনার ও শান্তি স্থাপনের বলশেভিক প্রচেষ্টা আসলে রুশ স্বজাত্যবোধের বিরোধী ও জার্মানির স্বার্থরক্ষাকারী। প্রধানত মার্কিন ও ব্রিটিশ বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তিগুলির এ জাতীয় বহু কীর্তীকলাপ দুই আমেরিকান প্রগতিশীল সাংবাদিক জন রিড ও আলবার্ট উইলিয়ামস তাঁদের অসাধারণ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরনে তুলে ধরে সকল কুৎসার অবসান ঘটিয়ে পরবর্তীকালে বৃটিশ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড কারের রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত সুবিশাল গবেষণাকার্যও এক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিরোধী অপপ্রচার ও কুৎসার দায়িত্ব ১৯৫০ এর দশকের ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময়কাল থেকে এরপর মার্কিন পুঁজিবাদের প্রতিভু রূপে কাঁধে তুলে নিয়েছিল বিভিন্ন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ‘রুশ-বিশেষজ্ঞ’ রূপে খ্যাত পেশাদার পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদগণ। ইতোমধ্যে ট্রটস্কিপন্থী পোলিশ ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েশ্চার মুখ্যত স্তালিন-বিরোধিতার উপর ভিত্তি করেই রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চায়  নিযুক্ত হয়েছিলেন; ঐতিহাসিক ফিশার তাঁর ‘ইউরোপের ইতিহাসে’ (১৯৩৬) ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হলেও রুশ বিপ্লব সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিলেন প্রধানত ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্পর্কে তাঁর অগাধ অনুরাগ ও অবশেসন থাকার কারণে।  কিন্তু ১৮১৭-র রুশ বিপ্লবের গণ ও সমাজতান্ত্রিক চরিত্র, গুরুত্ব এবং তার উদ্যোক্তা নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে উক্ত ইতিহাসবিদদের মধ্যে কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না। ছিল না ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃত উপস্থাপন। রুশ বিপ্লবকে হেয় করা না, ব্যাখ্যা করাই ছিল তাঁদের কাজ। এই বক্তব্য ট্রটস্কি, মানবেন্দ্রনাথ রায় কিংবা মার্ক ফেরো প্রণীত রুশ বিপ্লবের ঐতিহাসিক ভাষ্য সম্পর্কে প্রযোজ্য।  এমনকি কমিউনিস্ট-বিরোধী তাত্ত্বিক যে সমালোচকরা সমকালীন জার্মান মার্ক্সবাদী রোজা লুক্সেম্বার্গের লেনিনীয় নীতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু প্রশ্নকে বিক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরে সুখানুভুতি লাভ করেন – তারা বিস্মৃত হন লুক্সেম্বার্গের এই প্রসিদ্ধ বক্তব্য ‘সর্বহারার একনায়কত্ব মানে শ্রেণির একনায়কত্ব যার অর্থ মেহনতী জনগণের সীমাহীন গণতন্ত্র’। বলশেভিকরা সেই মেহনতী জনগণ বা সর্বহারা শ্রেণির অগ্রণী বাহিনী ছিল।

ঠাণ্ডাযুদ্ধ বা ১৯৫০-এর দশক থেকে পুরোমাত্রায় শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রুশ ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বিদ্যার একটা প্লাবন আসে। বলাবাহুল্য মার্কিনী পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এই গবেষণা সোভিয়েত অনুরাগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আদৌ পরিচালিত হয়নি। সোভিয়েত বিপ্লব, তাঁর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বিপ্লবী যুগের নেতৃত্বের স্খলন ও পতন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। রুশচর্চা সম্পর্কিত সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানটি ছিল নিঃসন্দেহে হারবার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের বেয়ার্ড অধ্যাপক পদে আসীন রিচার্ড পাইপস হলেন এ বিষয়ে একজন পুঁজিবাদী তাত্ত্বিক ইতিহাসবিদ যিনি বিগত ৫০ বছর ধরে মার্কিনী সোভিয়েত চর্চার স্তম্ভরূপে বিবেচিত হয়ে এসেছেন। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে Stephen F Cohen রচিত Rethinking the Soviet experience, 1985, গ্রন্থে)।

পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই (পাইপসের The formation of the Soviet Union: Communism and Nationalism, 1917-23 প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ তে)

পাইপস ‘অক্টোবর বিপ্লবের কুফল’ ও তার ‘ধ্বংসাত্মক পরিণাম’  সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতে শুরু করেন পরম উৎসাহে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাইপস লিখতে থাকেন। ১৯৬৭-তে প্রকাশ পায় Revolutionary Russia নামক একটি সম্পাদিত গ্রন্থ; ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত The Debate on Soviet Power এবং ১৯৯০-তে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের পর প্রকাশিত হয় The Russian Revolution অবশ্য ১৯৯১ পাইপস-এর দুটি প্রবন্ধ ‘Russia’s Chance’ এবং ‘The Soviet Union Adrift’ নিবন্ধ দুটিতে লেনিন ও স্তালিনের  হাতেগড়া সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপসারনের কার্যকরণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে। ১৯১৭-র অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে পাইপসের (অব) মূল্যায়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি ছিল সেগুলি অতি সংক্ষেপে এক এক করে তুলে ধরা যেতে পারে এভাবে।

প্রথমত, বলশেভিক বিপ্লব পাইপস এর কাছে শুধুই একটি ‘সামরিক অভ্যুত্থান’ মাত্র – বলপ্রয়োগ ও ষড়যন্ত্রমূলক সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের এই ঘটনাকে তিনি আদৌ বিপ্লব বলতে চান না – এটা নাকি একটি ‘ক্যু-ডেটা’! দ্বিতীয়ত পাইপস প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে রুশ  সমাজদেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা নৈরাজ্য আর বিশৃংখলার ফায়দা তুলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু রেজিমেন্ডেট রাজনৈতিক গোষ্ঠীরূপে বলশেভিক পার্টি রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। পাইপসের ভাষায় “সব থেকে নৃশংস ও সাহসী দাবিদারের হাতেই ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল রুশ জনতা”।  তাঁর মতে এইভাবে দুর্বল এক নাগরিক সমাজে লুন্ঠিত সাধারণ মানুষ পুনরায় চলে যায় লুটেরা বলশেভিকদের কবলে। সুতরাং তাঁর সুচিন্তিত অভিমত হল লেনিন একটা ‘ফটকা’ খেলেছিলেন এবং যা কার্যত অসম্ভব ছিল তাই ঘটে গিয়েছিল ১৯১৭-র অক্টোবরে রাশিয়ায়। ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের আবর্তে বলশেভিকরা ক্ষমতা করায়ত্ত করে। তৃতীয়ত, লেনিনের সুচতুর একনায়কতত্বে ২৪-২৫ অক্টোবর (৬-৭ নভেম্বর, ১৯১৭) আকস্মিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পেত্রোগ্রাদ পরবর্তী সময়ে মস্কোতে বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেয়ার জন্য পাইপসের অভিসম্পাত বর্ষিত হয়েছে দুর্বল কেরেনোস্কি সরকারের (ক্যাডেট-মেনশেভিক ও সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারি দলের এই কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এপ্রিলে) অপদার্থতা-বলশেভিকদের দমনে ব্যর্থতা ও দোদুল্যমানতার উপর। পাইপসের মতে মেনশেভিক  ও সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারিদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যই বলশেভিক বিজয়কে চূড়ান্ত করে দিয়েছিল। তিনি কেরেনস্কিকে এই কারণে দায়ী করেছেন যে তিনটি কাজ করতে না পারার জন্যই কেরেনস্কি সরকারের পতন ঘটেছিল। পাইপসের মতে (১) জুলাই মাসে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হচ্ছে (ট্রটস্কি এসময়ে জেলে বন্দী, লেনিন-স্তালিন প্রমুখ প্রথম সারির নেতারা হয় পলাতক, নাহয় আত্মগোপনে) তখনই লেনিনের সাথে  জার্মানির যোগাযোগ সংক্রান্ত দলিল/নথিপত্র কেরেনস্কি প্রকাশ করে দিতে পারত। (২)  সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল্ কর্নিলভের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধানো প্রেসিডেন্ট কেরেনস্কির অত্যন্ত অনুচিত হয়েছে এবং তার আরও গর্হিত অপরাধ হল কর্নিলভকে বরখাস্ত করার (আগস্ট, ১৯১৭) বিষয়টি) (৩) বলশেভিকদের প্রতিহত করার কাজে ব্যর্থতা ও বিনাযুদ্ধে রণে ভঙ্গ দেওয়ার জন্য পাইপস মূলত দায়ী করেছেন সোস্যাল রেভ্যুলিউশনারিদের – যারা প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের আশংকায় সদা সন্ত্রস্ত ছিলেন এবং কোমর বেঁধে গণ ভিত তৈরী ক্রতে পারেন নি। বলশেভিক বিপ্লবের (তাঁর ভাষায় অভ্যুত্থানের) কোনও গণ ভিত ছিলনা। আবার তিনি বলেছেন বলশেভিকদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি, এটা তো স্ববিরোধিতা।

চলবে …

লেখকঃ অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ।