সুখ নেইকো মনে, নাক ছাবিটি হারিয়ে গেছে, হলুদ বনে বনে” -তামান্না হোসেন

আমার জীবনের গাটছরা বাঁধা হয়েছিল যে ছেলেটি “মাধুকরী ” পড়েছিল তার সাথে। সেই ছেলেটির সাথে আমার দেখা হয়ে উঠেনি তখনও। ফোন করেছিল দূরদেশ থেকে।
আমি তখন দেশে, সারাক্ষনেই বুদ্ধদেব আমার সাথে।আর এই আমাকেই যখন জিজ্ঞেস করা হল পড়েছি কি আমি বুদ্ধদেব গুহ’ র বই। ব্যাস হয়েই গেল মধুর মিলন। আর কিছুই জানতে চাইনি।আমার প্রিয় লেখক কে চিনে আর কিছুরই যে নেই প্রয়োজন।
আজ শুভ্র জানালো তোমার লেখক আর নেই।আমি চলে গেলাম সেই চিমনী দিয়ে ধোঁয়া উঠা কোন এক সাঁওতালি আবাসে।
যেখানে মাদল বাজছে,
পায়ে আংটা বাঁধা মোটা পায়ের গোছা নিয়ে মেয়েরা নাচছে।
একটু পরেই আকাশে হেসে উঠবে পুর্নিমা।
আমি ব্যাক্তিগত ভাবে উনাকে চিনিনা। কিন্তু, কিন্তু উনার সব অনুভুতি আমার চেনা।
উনার সব বেদনা আমার জানা।উনার সব প্রেম আমার দেখা।
কিশোরী কালে ছিলাম বুঁদ হয়ে উনার সাথে।
বনের ভিতরে বনফুলের যে ঘ্রাণ তা বনে না গিয়েও আমি পেয়েছি,অংগে যে জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোর আলোয়ান জড়ানো যায়,সেই আলোতে ভেসে থাকা যায় তা আমি অনুভব করেছি বুদ্ধদেব গুহর বই পড়ে।
পাহাড়ি গ্রামীন জনপদ ম্যাকলাস্কি গঞ্জ। শহর থেকে যাত্রী নিয়ে শেষ বাসটা বাজারে এসে নামিয়ে দিয়ে যায় ক্লান্ত,অবসন্ন যাত্রীদের কে। লাল ধুলো উড়িয়ে বাসা চলে যায় আর এক গন্ত্যবে।কিন্তু পিছনে ফেলে যায় নিশ্চিত এক শুন্যতা। কি ভাবে সেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে গভীর কালো অন্ধকার নামে,সেই যে অন্ধকারের ভিতরেও যে অপরূপ রূপ তা জেনেছি এই লেখকের বই পড়েই।
পাহাড়ি মেয়ে শাড়িতে ঢেউ তুলে জ্যোৎস্না সাঁতরে যায় দয়িতের সাথে দেখা করতে। সেখানে তো মনে হয় আমিই ছিলাম।
কোয়েলের কাছে স্বশরীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তার কাজল কালো জল।কিন্তু পেয়েছি কোয়েল কে আপন করেই। শুধু বইয়ের বর্ননার বৈঠা ধরেই।
একটু উষ্ণতার জন্যর “ছুটি ” যখন লেখকের গায়ের মাপ নিতো উলের সোয়েটার বুনে দিবে বলে..সেই কিশোরী বেলায় আমার মনের গভীর গোপন কোনে এই রকম একটা অভিলাষ ছিল আমিও খুব ভালোবেসে এই রকম গায়ের মাপ নিয়ে একটা সোয়েটার বুনবো কারো জন্য।
“সন্ধ্যার পরে”..জীবনের ছায়া যখন ঘন হয়ে আসে সেই সময়েও তো ভালোবাসার ফুল ফুটতে পারে। আদতে ফুল ফোঁটার কি নিদিষ্ট কোন সীমারেখা আছে? আমরাই তো তা দমিয়ে রাখি। ধনু ভাংগা পণ করেই রাখি ভালোবাসার রেনু যেন না লাগে গায়েতে। ভালোলাগার প্রজাপতি যেন উড়াউড়ি না করে আশে পাশে। কিন্তু “সন্ধ্যার পরে” তে লেখক কি উদাত্ত ভাবে আহবান করে মিলিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের বিধমা মা আর ছেলে বউ এর বিপত্নীক মামা কে যিনি ভাগ্নীর বাসায় বেড়াতে এসে ছিলেন।সব বয়সেই প্রেম এর বয়স তাই লেখক প্রমান করলেন।
আমার সেজো ভাবী নাহরীন খুব কাঁচুমাচু হয়ে আমাদের আম্মা আর তাঁর শাশুড়ী মা কে জিজ্ঞেস করলেন একটা বই দিবো উনি পড়বেন কিনা।আর সেটা হল “সন্ধ্যার পরে”। আমার আম্মা হেন বই নাই যে পড়েন না।
উনি সানন্দে ছেলে বউ এর থেকে নিয়ে বই পড়ে ফেললেন এবং হয়ে গেলেন প্রকৃতির এই লেখকের আর এক গুনমুগ্ধ পাঠক।
চট্টগ্রাম থেকে বাসে ঢাকায় ফিরছি। তখন তিনটি ফেরি পার হতে হত। হাতে ছিল “কোজাগরী”
মনে হয়েছিল ঢাকা কেন এত কাছে। আমার বন্ধু আলো কম কথার মানুষ। তার খুব রাগ ছিল আমার এই প্রিয় লেখকের উপর। উনি নাকি যে কোন বিষয় লিখতে গিয়ে ফেনায় বেশি। আলো জানতো এই যে এত বিস্তারিত বর্ননা ( আলোর ভাষায় ফেনানো) সেটাই ছিল আমার ভালোলাগা।
হ্লুদ বসন্ত,চাঁন ঘরের গান,
ভোঁরের আগে.. সবেই আমার ফেলে আসা সেদিন গুলোকে একদম সামনে এনে বসিয়ে দেয় আজও। তিতলি,রুষা,কুর্চি,বাবলী আমাকেই ঘিরে থাকে সব সময়। দুখী পৃথু ঘোষের কথা মনে হয়।যে বলতো,সুখী হওয়ার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক কে বিবশ কর। বিবেক বেঁচে থাক সুখ মরে যাক।
তাই কি হয়..বিবেক আর সুখ দুটোই তো দুটির পরিপুরক।
বিবেকের সাথে মিলেই হোক সুখের বীণ।
লেখক চলে গেছেন অন্যলোকে।ভালো থাকুন উনি অন্য ভুবনে।
আমরা শুধু বলেই যাবো
উঁনারই বলে যাওয়া কথা..
“সুখ নেইকো মনে
নাক ছাবিটি
হারিয়ে গেছে
হ্লুদ বনে বনে”।।
তামান্না হোসেন, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টায় বসবাস করেন।