ফিলিস্তিন: সংসদীয় নির্বাচনে হামাসের যে বিজয় দুনিয়াকে চমকে দিয়েছিল

গাযা, পশ্চিম তীর এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনিরা ২০০৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে হামাসকে জয়যুক্ত করে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।
ঐ নির্বাচনের ফলাফল সবাইকে যেমন অবাক করেছিল, তেমনি বিস্মিত হয়েছিল এমনকি বিজয়ী দল হামাসও।
গাযা, পশ্চিম তীর এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিরা ২০০৬ সালের ২৫শে জানুয়ারি ভোট দেয় কয়েক দশকের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম পার্লামেন্ট নির্বাচনে। সেবারই প্রথমবারের মত ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস অংশ নেয় ফিলিস্তিনের কোন সংসদীয় নির্বাচনে।
হাযেম বালুশা তখন গাযায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিক। নির্বাচনের ঠিক আগে তিনি কাজ করতেন ফিলিস্তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন দপ্তরের মিডিয়া অফিসে ।
বিবিসির যাক ব্রোফিকে তিনি বলেন, সেই নির্বাচনে কী দারুণ উত্তেজনা ছিল, আগ্রহ সৃষ্টির অনেক কিছু তিনি ঘটতে দেখেছিলেন।
“ওই নির্বাচনের কথা তখন সবার মুখে মুখে। সেসময় ওই নির্বাচনই ছিল সমাজে প্রধান আলোচনার বিষয়।”
তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের সেই তরুণ সম্প্রদায়ের একজন যাদের এর আগে কখনও ভোট দেবার সুযোগ হয়নি।

ফাতাহ-র সাথে প্রথম রাজনৈতিক টক্কর
ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে তখনও পর্যন্ত প্রাধান্য ছিল প্রয়াত নেতা ইয়াসির আরাফাত ও তার ফাতাহ পার্টির।
হামাস ২০০৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ায় সেই প্রথম ফাতাহ পার্টির প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী একটি দল নির্বাচনের মাঠে নামে।
হাযেম বালুশা বলেন সেই নির্বাচনে হামাসের অংশগ্রহণ ফাতাহ পার্টির জন্য ছিল বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ।
“সেসময় হামাস নির্বাচনের মাঠে নেমে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের দল পরিস্থিতির বাস্তবতায় অনেক বেশি বিশ্বাসী। রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর প্রক্রিয়ার একটা অংশ তারা হতে চায়।”
ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ বা প্যালেসটিনিয়ান অথরিটি গঠন এবং তার প্রতিনিধি নির্বাচনের গোটা প্রক্রিয়াটা ছিল ইসরায়েলের সাথে একটি শান্তি চুক্তির ফসল।

হামাস প্রথম থেকেই ছিল ওই শান্তি চুক্তির বিরোধী, ফলে তারা ছিল এই গোষ্ঠীর বাইরে। স্বভাবতই, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ কোনরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই জয়লাভ করেছিল ১৯৯৬-এর নির্বাচনে।
কিন্তু এর এক দশক পর, সেখানকার আঞ্চলিক পরিস্থিতি বদলে যায়। পরিবর্তন আসে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে আর সেই রাজনীতিতে হামাসের ভূমিকা দশ বছর পরের ওই নির্বাচনে হামাসকে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিপক্ষ করে তোলে।
হাযেম বালুশা সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করার সময় দেখেছিলেন নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে মানুষের মধ্যে কী প্রবল উৎসাহ আর উদ্দীপনা কাজ করছে।
“চারিদিক প্রচারণায় মুখর, রাস্তায় রাস্তায় লাউডস্পিকারে তুমুল প্রচারণা- মসজিদে, পার্কে, খোলা জায়গায় বড় বড় জনসভা- ফ্ল্যাগ, পোস্টার, ব্যানার- বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া, আলাদা করে পরিবারগুলোর সাথে, গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেখা করে ভোটের প্রচার চালানো – সব মিলিয়ে বিশাল উদ্দীপনায় জমজমাট ছিল প্রচার পর্ব,” বলছিলেন মি. বালুশা।

তবে হাযেম বালুশা বলছিলেন প্রচারণা পর্বে প্রবল উদ্দীপনা যেমন ছিল, তেমনি বৈরি পরিবেশও ছিল বৈকি।
“উত্তেজনা অবশ্যই ছিল,” বলছিলেন তিনি। “সবসময়ই ফাতাহ আর হামাস যে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী- প্রতিপক্ষ, তা প্রচারণা পর্বে ছিল খুবই স্পষ্ট। তবে তাদের মধ্যে সহিংসতা বা সংঘাতের কোন ঘটনা আমার মনে পড়ে না।”
বড় ধরনের কোন অঘটন ঘটেনি বলেই তিনি জানান, কারণ দু পক্ষই তখন একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাইছিল।
হামাসের জন্য জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ
হামাস ইতোমধ্যেই জঙ্গী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছে- বিশেষ করে পশ্চিমের চোখে।
ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয়া হামাস ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় ইন্তেফাদার সময় সহিংস আন্দোলনের পথ নেয়, যার মধ্যে ছিল আত্মঘাতী বোমা হামলাও।

হামাস ২০০১ সালে একটা আত্মঘাতী হামলাও চালায়। জনাকীর্ণ বাজার এলাকায় বোমাবর্ষণ করে দলটি।
ইসরায়েলের কাছে হামাস হয়ে ওঠে একটা আক্রমণকারী শক্তি।
কিন্তু এর পরেও ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের অংশগ্রহণকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
অবশ্য সবগুলো জনমত জরিপে বলা হয় ফাতাহই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী হতে যাচ্ছে। এমনকি হামাসও সেটাকেই প্রত্যাশিত ফল হিসাবে ধরে নিয়েছিল। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল ফাতাহর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য।
হামাস-এর একজন মুখপাত্র বলেন, নির্বাচনী বিজয়ের স্বপ্ন তারা কখনই দেখেননি।
“আমরা চাইছিলাম ফাতাহ শক্তিশালী হোক্, ফাতাহ আরও স্বাস্থ্যবান হোক। কারণ আমার মতে, আমাদের অবস্থান সেখানে বেশ জটিল ছিল। আমাদের সামনে সমস্যা ছিল পাহাড়-প্রমাণ। ইসরায়েলের সাথে আমাদের সম্পর্ক, দেশের ভেতর আমাদের অবস্থান সবকিছু নিয়েই ছিল জটিলতা। হামাস চাইছিল ফাতাহ-র সাথে মিলে কাজ করতে।”

নির্বাচনের দিনটা কেমন ছিল?
নির্বাচনের দিন হাযেম বালুশা কাজ শুরু করেছিলেন খুব সকালে।
“প্রথম যে ভোটকেন্দ্রে আমি গেলাম, সেটা ছিল আমার নিজের ভোটদান কেন্দ্র। আমি খুবই উদ্দীপ্ত ছিলাম। প্রথমবারের মত আমি ভোট দিচ্ছি। বাক্সে ব্যালট পেপারটা ঢোকানোর পর আমার দারুণ আনন্দ হচ্ছিল,” বললেন মি. বালুশা।
সারা দিন অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে বিভিন্ন ভোটদান কেন্দ্র ঘুরলেন তিনি। খবর করার সুযোগ তারা ঠিকমত পাচ্ছেন কিনা সেটাও ঘুরে ঘুরে যাচাই করলেন।
“ভোটারদের লাইন ছিল লম্বা আর মানুষের মধ্যে ছিল বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা।”
সন্ধ্যের পর এক্সিট পোল বা প্রাথমিক ফলাফলের পূর্বাভাস আসতে শুরু করল।
“এক্সিট পোলে দেখা গেল ফাতাহ নির্বাচনে বিজয়ী হতে যাচ্ছে। দলের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে সারারাত উৎসব, উল্লাসে মেতে উঠল। রাস্তায় গাড়ির মিছিল, চিৎকার, হর্ষধ্বনি, স্লোগান কিছুই বাদ গেল না। সবাই জানল ফাতাহ আবার নির্বাচনে জিতেছে।”
কিন্তু রাতভর যেসব নির্বাচনী ফলাফল আসতে লাগল, তাতে চিত্রটা উল্টে যেতে শুরু করল- বলছিলেন মি. বালুশা।
“হ্যাঁ- খুব ভোরের দিকে মনে হয় – ফলাফল আরও পরিষ্কার হল। আনুষ্ঠানিক ফল তখনও আসেনি। কিন্তু এটা তখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে নির্বাচনে জিতেছে আসলে হামাস।”

ফাতাহ পার্টির ‘কঠোর শাস্তি’
সংসদের ১৩২টি আসনের মধ্যে হামাস জয়লাভ করে ৭৪টি আসনে। ক্ষমতাসীন ফাতাহ পার্টি পায় মাত্র ৪৫টি আসন- যা ছিল তাদের জন্য শোচনীয় পরাজয়।
এক দশকের ওপর শান্তি প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, এবং ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের জন্য সেটা ছিল তাদের প্রতি ‘জনগণের শাস্তি’।
ফাতাহ পার্টির নেতারা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
“আমরা এত কঠোর শাস্তি আশা করিনি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম জনরোষের কিছুটা প্রতিফলন দেখব। কিন্তু একেবারেই ভাবিনি যে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখব নীল আকাশ সবুজ হয়ে গেছে, বলছিলেন ফাতাহ পার্টির একজন মুখপাত্র।
রাতারাতি ফিলিস্তিনি এলাকা জুড়ে উড়তে শুরু করে হামাসের সবুজ পতাকা।
বিস্মিত হামাস; অস্বস্তিতে আন্তর্জাতিক মহল
এই ফল হাযেম বালুশা বা তার সতীর্থ সাংবাদিকরাও আশা করেননি। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য কী হতে পারে তা নিয়ে তখন নানা মহলে শুরু হয়েছে বিশ্লেষণ আর আলোচনা।
মি. বালুশা বলেন যাদের কাছে ধর্মীয় বিশ্বাসের গুরুত্ব বেশি, তাদের মনে সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে যে প্রশ্ন, সেটা হল: “রাজনৈতিকভাবে এর অর্থ কী দাঁড়াবে? ভবিষ্যতে কী হতে পারে?”
সাংবাদিকরা সকালে হামাস নেতাদের সাথে কথা বলেন। তারাও বুঝতে চাইছিলেন হামাসের বিজয়ের পর ওই এলাকার রাজনীতি কোন্ পথে এগোবে, কোন দিকে মোড় নেবে?
হামাস নেতাদের জবাব ছিল এই ফলাফলে তারা বিস্মিত। তারাও “ভাবতে পারেননি নির্বাচনে তারা জিততে চলেছেন”।

শুধু ফিলিস্তিনিরাই যে নির্বাচনের এই ফলে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন তাই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা প্রথমে এই নির্বাচনকে সমর্থন করেছিল, তাদের মধ্যেও কোন কোন দেশ পরে এই ফল মেনে নিতে পারেনি- যেমন যুক্তরাষ্ট্র।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ বলেছিলেন তিনি এটা স্পষ্ট করে দিতে চান যে, যে রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চায়, যুক্তরাষ্ট্র সেই দলকে সমর্থন করে না।
আর ইসরায়েলি সরকারের কাছে হামাস নেতৃত্বাধীন একটা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
ইসরায়েলি সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল: “যে দল ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য খোলাখুলি ঘোষণা দেয়, ইসরায়েলে সন্ত্রাসী ও খুনিদের পাঠায়, তাদের সঙ্গে কোনরকম আলোচনায় আমরা যেতে পারি না”।
ক্ষমতার হস্তান্তর-‘রাজনৈতিক ভূমিকম্প’
এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের একটি বড় দল। তারা রায় দেন নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। কিন্তু ফল ঘোষণার পর দৃশ্যপট সহিংস হয়ে ওঠে।

সংসদ ভবনের দিকে হামাস সমর্থকরা সবুজ ব্যানার নিয়ে এগোতে গেলে শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। খবরে বলা হয়, ফাতাহ সমর্থক দুই তরুণ এই সহিংসতা উস্কে দেয়।
ক্ষমতার এই নজিরবিহীন হাতবদলের ক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর।
পরের মাসগুলোতে ফাতাহ আর হামাসের মধ্যে বিভেদ তীব্র হয়ে ওঠে। ক্ষমতার এই লড়াই ২০০৭ সালে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়।
হামাস গাযার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, আর ফাতাহ তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে পশ্চিম তীরে।
এরপর থেকে গাযায় কঠোর অবরোধ আরোপ করা হয়। হামাসকে পশ্চিমী দুনিয়া একঘরে করে দেয়। ফিলিস্তিনি এলাকা ও ফিলিস্তিনি পার্টির মধ্যে বিভেদ আরও গভীর হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে গাযায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি।
পেছনের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট যে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে ২০০৬ সালের ওই নির্বাচন ছিল ফিলিস্তিনের রাজনীতি, ইতিহাস ও সমাজের জন্য একটা যুগান্তকারী পরিবর্তনের মুহূর্ত।
হাযেম বালুশা বলেন ২০০৬-এ পালাবদলের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে মানুষ বুঝতে পারেনি যে এটা একটা রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সূচনা।
“এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল ঠিকই। কিন্তু সাধারণ ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারেননি এর তাৎপর্য কী! তারা বোঝেননি হামাসের এই বিজয়ে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? ফাতাহ পার্টি, আর আরব দুনিয়া কীভাবে নেবে নির্বাচনের এই ফলকে?”
গাযায় এখনও নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসাবে কর্মরত হাযেম বালুশা বলেন, সেসময় কেউই বুঝতে পারেনি যে, গাযার সংঘাত, ২০০৭ সালের বিভাজন আর গাযায় পরবর্তীতে অবরোধ আরোপ – এসব কিছুর পেছনেই কারণ ছিল ২০০৬ সালের সেই নির্বাচনে হামাসের অপ্রত্যাশিত বিজয়।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা