শ্রমিকের অভিযোগ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি -ফজলুল কবির মিন্টু
কোন শ্রমিককে শ্রম আইন না মেনে অন্যায়ভাবে চাকুরী হতে ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত বা অপসারণ করা কিংবা দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত অন্য কোন বিষয় যেমন নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক, শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরন, মালিকের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারনের বিষয় উল্লেখ করে ১২ ধারা প্রয়োগ করে কারখানা বন্ধ রাখা, ষড়যন্ত্রমূলক ১৩ ধারা প্রয়োগ করে কারখানা বন্ধ রাখা, লে-অফ ইত্যাদি বিষয়ে কোন শ্রমিকের পক্ষ থেকে অভিযোগ উদ্ভব হওয়ার দিন হতে ৩০ দিনের মধ্যে সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক কর্তৃক মালিক বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রদান করতে হবে।
এখানে অভিযোগ উদ্ভব হওয়ার দিন হতে ৩০ দিন সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা উক্ত সময়ের মধ্যে যদি সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক মালিক বরাবর তার অভিযোগ জানাতে ব্যর্থ হয় তাহলে অভিযোগ তামাদি বলে বিবেচিত হবে। অভিযোগপত্রে অভিযোগের বিষয় বস্তু যাতে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় সেটাও খুব গুরুত্ব সহকারে খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় অভিযোগ পত্র তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অভিযোগ অবহিত হওয়ার পর মালিক পক্ষ সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক যদি আইনের আশ্রয় নিতে চায় তাহলে অভিযোগপত্র গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসাবে কাজ করবে। মালিক বরাবর অভিযোগপত্র দেয়ার পর প্রমাণ স্বরূপ মালিক পক্ষের তথা মানব সম্পদ অথবা এডমিন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে প্রাপ্তি স্বীকার নিতে হবে। যদি মালিক পক্ষ প্রাপ্তি স্বীকার প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে রেজিষ্ট্রি ডাক যোগে উক্ত অভিযোগপত্র প্রেরণ করতে হবে। কোন কুরিয়ার সার্ভিস অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগপত্র প্রেরণ করলে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবেনা।
মালিক অভিযোগ পত্র পাওয়ার পর হতে ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করবেন। শ্রমিককে ব্যক্তিগত শুনানীর জন্য ডাকবেন এবং শুনানী শেষে তার লিখিত সিদ্ধান্ত সংক্ষুদ্ধ শ্রমিককে অবহিত করবেন।
মালিকের সিদ্ধান্তে সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক সন্তুষ্ট না হলে সিদ্ধান্ত পাওয়ার দিন হতে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করা যাবে।
শ্রমিকের অভিযোগপত্র পাওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মালিক যদি সংক্ষুদ্ধ শ্রমিককে তার সিদ্ধান্ত জানাতে ব্যর্থ হন তাহলে মালিককে অভিযোগপত্র দেয়ার ৩০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংক্ষুদ্ধ শ্রমিক মামলা দায়ের করতে পারবে।
উল্লেখ্য ২০০৬ সনে শ্রম আইন প্রনয়নের সময় অভিযোগ অবগত হওয়ার পর শ্রমিককে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য মালিক পক্ষকে ১৫ দিন সময় দেয়া হয়েছিল এবং ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনের পূর্ব পর্যন্ত তা ১৫ দিনই ছিল। ২০১৩ সনে শ্রম আইন সংশোধনের সময় ১৫ দিন থেকে বর্ধিত করে ৩০ দিন করার কারণে তা কার্যত সময় ক্ষেপন করে সংক্ষুদ্ধ বা ভুক্তভোগী শ্রমিককে হয়রানী করা হয় যা বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার একটা অশুভ প্রয়াস ছাড়া কিছুই নয়। সময় বর্ধিত করার ব্যাপারে মালিক পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
মূলত মালিক পক্ষকে অভিযোগ জানিয়ে শ্রমিকের কোন লাভ হয়না বলেই ভুক্তভোগী শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। কেননা মালিকের নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মালিকের কাছে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চাওয়া একটা নিস্ফল প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই মালিককে অভিযোগ জানানোর বিষয়টা বাধ্যতামূলক না করে শ্রমিকের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়ে শ্রমিককে সরাসরি মামলা করার সুযোগ দিলে শ্রমিক সময় ক্ষেপন ও হয়রানী থেকে রক্ষা পেত। তাছাড়া মালিককে অভিযোগ জানিয়ে ন্যায় বিচার পেয়েছেন বা মালিক তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন এমন কোন নজিরও কিন্তু আমাদের কাছে নাই। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মালিককে অভিযোগ জানিয়ে কেন সময় ক্ষেপন?
বর্তমান শ্রম আইন অনুযায়ী ২৬ ধারায় কোন শ্রমিকের চাকুরী অবসান করা হলে সাধারণত উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা যাবেনা। কারন শ্রম আইনের এ ধারাটিতে কোন কারন না জানিয়ে যেকোন সময় যেকোন শ্রমিকের চাকুরী অবসান করার অসীম ক্ষমতা মালিককে প্রদান করা হয়েছে।
তবে চাকুরী অবসানের আদেশটি যদি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ডের কারনে অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে প্রদান করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় এবং ২৬ ধারার অধীন প্রাপ্য সুবিধা হতে যদি শ্রমিককে বঞ্চিত করা হয়ে থাকে তাহলে অভিযোগ করা যাবে। একই সাথে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও শ্রম অধিদপ্তরে ১৯৫ ধারায় মালিকের অসৎ শ্রম আচরণ এবং ১৯৬(ক) ধারায় এন্টি ট্রেড ইউনিয়ন ডিস্ক্রিমিনেশনের অভিযোগও আনা যাবে।
শ্রম আদালত অভিযোগ প্রাপ্তির পর উভয় পক্ষকে নোটিশ দিয়ে তাদের বক্তব্য শুনবেন এবং আদালতের বিবেচনায় সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত আদেশ প্রদান করবেন।
ছাঁটাই, ডিসচার্জ এবং চাকুরী অবসান সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে শ্রম আদালত অভিযোগকারীকে বকেয়া মজুরি সহ বা মজুরি ছাড়া চাকুরী পুনর্বহালের নির্দেশ দিতে পারবে। বরখাস্ত বা অপসারণ সংকান্ত অভিযোগের বিষয়ে ২৩(২) ধারায় উল্লেখিত কোন লঘুদন্ডে পরিবর্তন করতে পারবে।
শ্রম আদালত ধারা ৩৩ লঙ্ঘনের দায়ে ধারা ২৮৩ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মালিককে ৩ মাস পর্যন্ত বিনা শ্রম কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড দিতে পারবেন। এ দন্ড যথেষ্ট নয় বলে অভিমত থাকলেও এ ধরনের কোন দন্ড আদৌ কোন মালিককে দেয়া হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে কোন নজির নেই।
শ্রম আইনের ২১৬(১২) ধারাতে মামলা দায়ের করার তারিখ হতে ৬০ দিনের মধ্যে রায় প্রদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদি ৬০ দিন সময়ের রায় প্রদান করা সম্ভব না হয় তাহলে ২১৬(১৩) ধারা অনুযায়ী আদালত আরো ৯০ দিন সময় বর্ধিত করতে পারবে। অর্থাৎ মামলা দায়ের করার পর হতে সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান বাধ্যতামূলক হলেও বলা যায় কোন মামলাতেই এ সময় সীমা মানা হচ্ছে না।
মামলার তুলনায় আদালতের সংখ্যা কম, আদালতে নিয়মিত বিচারক না থাকা, করোনাকালীন আদালত বন্ধ থাকা – ইত্যাদি কারনে রায় ঘোষণা করতে বিলম্ব হয় যা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। শুধুমাত্র মামলার রায় পেতে বিলম্ব হওয়ার কারনে অধিকাংশ ভুক্তভোগী শ্রমিক মামলা করা থেকে বিরত থাকে। একটি সভ্য সমাজে তা কখনো কাম্য হতে পারেনা। বিলম্বিত বিচার ব্যবস্থা ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এর ফলে মালিক-শ্রমিক পারস্পরিক অনাস্থা তৈরি হয় এবং সুস্থ্য ধারার শিল্প সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক ও শ্রম আইন বিশ্লেষক