রাণা প্লাজার ধ্বসঃ দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড?
-ফজলুল কবির মিন্টু
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রাণা প্লাজা ধ্বস ছিল বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম দুর্ঘটনা। এদিন এখানে ১১৩২ জন শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু হয়। আহত হয় অজস্র শ্রমিক। রাণা প্লাজা দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা, যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেছেন এবং যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তারা প্রত্যেকেই এক দূঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আজ রাণা প্লাজা ধ্বসের ৯ বছর পূর্ণ হবে। একটি প্রশ্নের উত্তর আজও অমিমাংসিত রয়ে গেছে- সেটা হচ্ছে রাণা প্লাজা ধ্বস- দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড? অথচ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা খুবই জরুরি।
ইতিহাস হয়তো একদিন এর মূল্যায়ন করবে তবে একজন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক হিসাবে আমি রাণা প্লাজা ধ্বসকে কেবল দুর্ঘটনা বলতে রাজি নই- কেননা, রানা প্লাজায় অবস্থিত গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা দুর্ঘটনা ঘটার আগের দিন নিরাপত্তা শঙ্কার কথা বুঝতে পেরে কারখানা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এবং দুর্ঘটনা ঘটার দিন কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল কিন্তু তাদেরকে অনেকটা জোর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। কাজে যোগ না দিলে মজুরি প্রদান না করে চাকুরীচ্যুতির হুমকিও প্রদান করা হয়।
পাশপাশি একই বিল্ডিং এ ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখা ছিল। নিরাপত্তা শঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ ঐ শাখাটি বন্ধ রেখেছিল এত বড় দুর্ঘটনার পরেও ব্র্যাক ব্যাংকের সকল কর্মচারী প্রাণে রক্ষা পায়।। সেদিন যদি ব্র্যাক ব্যাংকের মত পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ থাকতো তাহলে হয়তো পোশাক শ্রমিকরাও ঐ নির্মম দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেত। ব্র্যাক ব্যাংকের সকল কর্মচারী বেঁচে যাওয়া এবং ১১৩২ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর মধ্যেই নিহিত আছে রাণা প্লাজা ধ্বস দুর্ঘটনা নাকি হত্যাকান্ড।
এছাড়া ৪ তলার অনুমোদন নিয়ে ৮ তলার বিল্ডিং তৈরি করার সুযোগ পাওয়া এবং বিল্ডিং এর নিরাপত্তা ও কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতাও এধরনের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
আরও একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়াও খুব জরুরি বলে আমি মনে করি, সেটা হচ্ছে- শ্রমিকেরা নিরাপত্তা শঙ্কার কথা আঁচ করতে পেরেও কেন তারা ঐদিন কাজে যোগ দিয়েছিল? মালিক পক্ষই বা কি করে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করতে সক্ষম হয়েছিল? কারন প্রধানত শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দূরাবস্থা। দুর্ঘটনাটি ঘটে ২৪ এপ্রিল অর্থাৎ শ্রমিকেরা প্রায় ১ মাস চাকুরী করেছিল। যদি তারা কাজে যোগ না দিত তাহলে ঐ মাসের মজুরী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল বা মজুরী পেলেও তাদেরকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হত। বলা বাহুল্য পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মাসের আয় দিয়ে মাস চলে। তাদের কোন উদ্বৃত্ত আয় নাই বিধায় আপদকালীন চলার মত তেমন কোন সঞ্চয় থাকেনা। কোন এক মাসের মজুরী না পেলে পরবর্তী মাসে তাদেরকে কঠিন দূর্ভোগের মখোমুখি হতে হয়। ফলে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার কোন বিকল্প ছিলনা।
এই বিকল্প হতে পারতো শ্রম আইন। কিন্তু শ্রম আইন কী শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে সক্ষম? লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, শ্রম আইন ২০০৬ এর ৮৬ (১) ও (২) ধারায় উল্লেখ আছে যদি কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক দেখতে পান যে, উহার কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি, যাহা শ্রমিকেরা সাধারণতঃ ব্যবহার করেন এমন বিপজ্জনক অবস্থায় আছে এবং উহা যে কোন সময় কোন শ্রমিকের শারীরিক জখম প্রাপ্তির কারণ হতে পারে, সেক্ষেত্রে তিনি অবিলম্বে তৎসম্পর্কে লিখিতভাবে মালিককে অবহিত করবেন৷ উক্তরূপ সংবাদ প্রাপ্তির পর মালিক যদি তিন দিনের মধ্যে তৎসম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন এবং উক্ত ভবন বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে কোন শ্রমিক যদি জখম প্রাপ্ত হন তাহলে মালিক, অনুরূপ জখমপ্রাপ্ত শ্রমিককে, দ্বাদশ অধ্যায়ের অধীন উক্তরূপ জখমের জন্য প্রদেয় ক্ষতিপূরণের দ্বিগুন হারে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবেন৷
শ্রম আইন মোতাবেক একজন শ্রমিক কর্মস্থলে জখমপ্রাপ্ত হয়ে নিহত হলে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা এবং স্থায়ীভাবে কাজ করতে অক্ষম হলে ২লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রাপ্য হবে। আর উপরোক্ত ধারা মতে নিরাপত্তা শঙ্কার কথা মালিককে শ্রমিক কর্তৃক অবহিত করার পরও যদি মালিক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন তাহলে সেক্ষেত্রে শ্রমিক নিহত হলে ৪লক্ষ টাকা এবং স্থায়ীভাবে কাজ করতে অক্ষম হলে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রাপ্য হবে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছেঃ প্রথমত ক্ষতি পূরণের পরিমান অত্যন্ত অপ্রতুল আবার শ্রম আইনের এই ধারাটি শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিধান করেনা কারণ কারও অবহেলায় মৃত্যু কখনো ক্ষতি পূরনের মাধ্যমে পূরনীয় হতে পারেনা। বরং নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিলে উক্ত শঙ্কা সম্পূর্ণভাবে দূর না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিককে কাজে যুক্ত না করা কিংবা শ্রমিক নিজেও যাতে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে – এমন ধারা শ্রম আইনে থাকা খুবই বাঞ্চনীয়। এধরনের পরিস্থিতে শ্রমিক কাজ করতে অসীকৃতি জানালে, শ্রমিককে যাতে চাকরিচ্যুত করা না যায় এবং শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরী নিয়ে যাতে মালিক পক্ষ কোন প্রকার তালবাহনা করতে না পারে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। তাই শ্রম আইনের ৮৬ ধারাটি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে।
এছাড়া শ্রমিকদের নিজ মতামত প্রকাশের জন্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ না থাকার কারনেও রাণা প্লাজার মত ভয়াবহ দূর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। রাণা প্লাজায় অবস্থিত কারখানাগুলোতে যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্রমিক সংগঠন থাকতো তাহলে ঐ সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারতো। কিন্তু শ্রমিকদের কোন সংগঠিত শক্তি বা প্লাটফর্ম না থাকার কারনে শ্রমিকদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি।
রাণা প্লাজা ধ্বসের পর ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধনীতে অংশগ্রহণ কমিটি ও সেফটি কমিটি গঠন করার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু কমিটিগুলো গঠন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকের মতামতের কোন প্রতিফলন ঘটেনা বিধায় কমিটিগুলো মূলত কাগুজে কমিটি বা মালিকের পকেট কমটিতে পরিনত হয়েছে। অনেক সময় মালিক পক্ষ এই দুইটা কমিটিকে ইউনিয়নের বিকল্প হিসাবে দেখানোর চেষ্টায় লিপ্ত থেকেছে। ফলে অংশগ্রহণকারী কমিটি ও সেফটি কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য শুরুতে হোঁচট খেয়েছে বলেই অভিজ্ঞ মহল মনে করে।
রাণা প্লাজার রক্তাক্ত অধ্যায়ের আজ ৯ বছর পূর্ণ হবে। বিগত ৯ বছরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা তথা বিল্ডিং নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ও অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন হয়েছে বটে। কিন্তু এই উন্নয়ন টেকসই হবেনা যদি শ্রমিকেরঞ্জীবনমান ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিকের আইনগত সুরক্ষা এবং শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত না হয়।
পরিশেষে বলতে চাই – রাণা প্লাজা ধ্বস একটি পরিস্কার হত্যাকান্ড। এরজন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস মালিক, ভবণ মালিক, বিল্ডিং এবং কারখানা অনুমোদনকারী সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার ৯ বছর পরেও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া দুঃখজনক। সুতরাং এধরনের দুর্ঘটনার পুণরাবৃত্তি রোধ করতে হলে সবার আগে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি