চলমান সংবাদ

দুর্নীতি মামলায় ওসি প্রদীপের ২০ ও স্ত্রীর ২১ বছরের কারাদণ্ড, সম্পদ বাজেয়াপ্ত

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক’র মামলায় আলোচিত টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২০ বছর ও তার স্ত্রী চুমকী কারনকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে আদালত তাদের সম্পতি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন। বুধবার (২৭ জুলাই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুন্সী আবদুল মজিদ এ রায় ঘোষণা করেন। বাজেয়াপ্তকৃত সম্পদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার আগে সকালে প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। আদালত স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের রায় ঘোষণা করে। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত থাকা প্রদীপ কুমার দাশ ও চুমকি কারনকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে প্রদীপকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন আদালত। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট থেকে প্রদীপ কারাগারে থাকলেও মামলার শুরু থেকে চুমকি কারন পলাতক ছিলেন। গত ২৩ মে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণের শেষদিনে চুমকি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদুল হক মাহমুদ বলেন, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ২০ বছর ও তার স্ত্রী চুমকি কারনকে ২১ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে যে সম্পদের মালিক তারা হয়েছেন, তা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তিনি বলেন, প্রদীপ একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে স্থানান্তর, হস্তান্তর ও ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, এটা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগারকৃত অবৈধ উপার্জন হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে স্ত্রী চুমকি কারনের নামে জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গড়েছেন। তিনি আরও বলেন, দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ২০ ভরি স্বর্ণের তথ্য গোপনসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদের মূল্যকে অপরাধ গোপনের লক্ষ্যে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকি পরস্পর যোগসাজসে অপরাধে করেছেন। যা দুদক মৌখিক, দালিলিক ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী করা হয়েছিল মোট ২৯ জনকে। তাদের মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিনসহ ২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবী সমীর দাশগুপ্ত বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২) ধারায় চুমকিকে ১ বছর কারাদণ্ড, ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১ মাস কারাদণ্ড, ২৭(১) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ৮ বছর কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সাজা, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও ৪ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছরের সাজা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় প্রদীপ ও চুমকিকে ২ বছর কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ২ মাস কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তিনটি আইনের চারটি ধারায় প্রদীপ কুমার দাশের মোট ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ৪ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরো মোট ২ বছর ৮ মাসের সাজা হয়েছে। আর তার স্ত্রী চুমকির মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড, ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা ও অনাদায়ে আরো মোট ২ বছর ৯ মাসের সাজা হয়েছে। প্রত্যেক কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। ন্যায়বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করবো। আদালতে বেঞ্চ সহকারী মো. মূসা বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের বাজেয়াপ্ত সম্পদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ এর বিধি ১৮৩(৯) এবং ফৌজদারী কার্যবিধি ধারা ৫১৭/৫২০ সহ প্রযোজ্য অন্যান্য বিধানসমূহের আলোকে বাজেয়াপ্তকৃত সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কক্সবাজার জেলার সম্পত্তির বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রসঙ্গত ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন বাদি হয়ে দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন। মামলায় প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে প্রায় চার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকা ওসি প্রদীপ ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন বলে দুদক অভিযোগ করে। আরও ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য বিবরণীতে গোপন করার অভিযোগও আনা হয়। তদন্তের পর গতবছরের ২৬ জুলাই দুদক চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত১৫ ডিসেম্বর প্রদীপ-চুমকির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর গত ৪ এপ্রিল সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত ১৮ জুলাই প্রদীপ-চুমকি দম্পতির বিরুদ্ধে দায়ের দুর্নীতি মামলায় দুদকপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। উল্লেখ্য ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ওই বছরের ৬ আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন প্রদীপ কুমার দাশ। ওই মামলায় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে প্রদীপকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন আদালত। # ২৭.০৭.২০২২ চট্টগ্রাম #