‘আইএমএফের ঋণ পেতে’ জনগণের উপর চাপ
জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন দাম বাড়ায় বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতি৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএমএফ এর ঋণ পেতেই জনগণের উপর অযৌক্তিক চাপ বাড়িয়েছে সরকার৷
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার পরপরই পাম্পগুলোতে যানবাহনের লম্বা লাইন পড়ে৷ কোথাও কোথাও হামলার খবরও পাওয়া গেছে৷ যানবাহন চলাচল বলতে গেলে বন্ধই রয়েছে৷
এরইমধ্যে গণপরিবহণের ভাড়া আনুষ্ঠানিকভাবেই বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সবক্ষেত্রে৷ শিল্প উৎপাদন ও কৃষিখাত নিয়ে সবচেয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে৷
সারাদেশে এ নিযে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করছে৷ সকাল থেকেই গণপরিবহণ ও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল ছিলো কম৷ চট্টগ্রামে দুপুর পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ ছিল৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পাঁচ ধরনের প্রভাবে কথা বলেন৷ তার মধ্যে রয়েছে:
১.পরিবহণ খাত৷ কারণ অধিকাংশ গণপরিবহণ ডিজেলচালিত৷
২.উৎপাদন, শিল্প ও পোশাক খাতে খরচ বাড়বে৷
৩. কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে৷
৪.পণ্য পরিবহণ খরচ বাড়বে৷
৫. সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে৷
‘আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও দাম বেশি’
বাংলাদেশে পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন ও কেরোসিনের দামএকবারে এত বেশি আর কখনোই বাড়েনি৷ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা করা হয়েছে৷পেট্রোলের দাম ৫১.৬ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা লিটার৷ অকটেনের দাম ৫১.৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা লিটার হয়েছে৷
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের ভবিষ্যৎ দাম ছিল ৯৪.১২ ডলার এবং ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম কমে এসেছে ৮৮.৫৪ ডলারে, যা গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর সর্বনিম্ন৷
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম. তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে এখন বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বেশি৷”
তার মতে , সরকার জ্বালানি তেলের আমদানি খরচ বৃদ্ধির অজুহাত দিলেও বাস্তবে কমছে৷ ‘‘তারা বলছে ডিজেল এখন ১২২ টাকা লিটার পড়ছে ভ্যাট, ট্যাক্স মিলিয়ে৷ এটা যদি হয় তারা বাজারের চেয়ে উচ্চমূল্যে কিনছে৷ তবে দাম সমন্বয় হয় তিন মাস পরপর৷ এখন যে দাম ধরা হচ্ছে তা তিন মাস আগের৷আর এখনকার কম দামের তেল আসবে তিন মাস পরে৷কিন্তু তখন কি কমবে?’’
সরকারের ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানো ও পাচার ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ তবে বিশেষজ্ঞরা এই তিনটি কারণের কোনোটিকেই যৌক্তিক মনে করছেন না৷
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বিপিসিকে বাঁচানোর জন্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও এটা যৌক্তিক নয়৷ কারণ বিপিসি তো অনেক লাভ করেছে৷ সেই টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে গেছে৷ লাভের টাকা যদি বিপিসির কাছে থাকত তাহলে সেই টাকা দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত৷ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না৷”
উল্লেখ্য গত মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলার পর্যন্ত ওঠে৷ এখন সেই জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলারের নিচে৷ বিপিসি ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে৷
এই বিষয়ে ম. তামিম বলেন, ‘‘বিপিসি যখন ব্যবসা করে তার সুফল দেশের মানুষ পায় না৷ আর যখন লোকসান হয় তার বোঝা বইতে হয়৷ এখন সবকিছুর দাম বাড়বে৷ এমনকি বাড়ি ভাড়াও বাড়বে৷আমার বিবেচনায় এইভাবে নজিরবিহীনভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঠিক হয়নি৷ ”
তিনি বলেন, ‘‘কার্যত এই খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়া হয়েছে৷ এখন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ব্যবসা করবে৷ এটা ঘোষণা দিয়েই সরকার করতে পারত, যা ভারত করেছে৷ কিন্তু সমস্যা হলো যখন জ্বালানি তেলের দাম কমে তখন এখানে কমে না৷”
কারণ আইএমএম এর ঋণ?
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বাংলাদেশ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে৷ ঋণের অঙ্ক খোলাসা করা না হলেও এই তথ্য নিশ্চিত করেছে সরকার ও আইএমএফ দুই পক্ষই৷
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন আন্তর্জাতিক সংস্থাটির ঋণ পেতেই সরকার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আইএমএফসহ দাতা সংস্থার ঋণ পেতে এটা করা হচ্ছে৷ এর আগে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে৷ এখন ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো৷ দুইদিন পর হয়তো আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে৷ কিন্তু আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিক হলে এই দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না৷”
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘সরকারকে এখন আইএমএফের ঋণ পেতেই হবে৷ তা না হলে খরচ মিটাতো পারবে না৷ তাই এখন তাদের শর্ত মেনে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে৷ কয়েকদিন আগে সারের দাম বাড়িয়েছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ আরো চাপে পড়ছে৷ এর প্রভাবে সব কিছুর দাম বাড়া শুরু হয়েছে৷এটা বাড়তেই থাকবে৷’
সূত্রঃ ডয়চে ভেলে