মতামত

চা শ্রমিকদের আন্দোলন – দাবী ও বিভ্রান্তি

– রাজেকুজ্জামান রতন

এ রকম আন্দোলন বাংলাদেশ দেখে নি অনেক দিন। ১৬৮ টি বানিজ্যিক চা বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের ৬ লাখের বেশি সদস্য ১৭ দিন ধরে আন্দোলন করছে। দেশের প্রান্তে পরে থাকা একদল শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে আজ আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। দিনে ১২০ টাকা নগদ মজুরি আর সপ্তাহে রেশন, জীর্ণ ঘরে বংশ পরম্পরায় গাদাগাদি করে বসবাস করা চা শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে ৭ আগস্ট থেকে। প্রথমে প্রতিদিন ২ ঘন্টা করে কর্ম বিরতি তারপর লাগাতার ধর্মঘট। ১৩ আগস্ট থেকে চলছে এই পূর্ণ ধর্মঘট। দেশের মানুষ অনেকেই হতবাক হয়েছেন উন্নয়ন আর অগ্রগতির এই দেশে এত হতভাগ্য মানুষ আছেন একথা জেনে। অথচ সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। চা শ্রমিকদের দাবি তাদের ন্যুনতম মজুরি দৈনিক ৩০০ টাকা দিতে হবে। মালিকরা দুই দফায় ১৪০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছিল। তারপর বলা হলো প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে আরো ৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলো মালিকেরা। কিন্তু শ্রমিকেরা তা মানে নি।
মরিয়া আন্দোলন, মরণের ভয় উপেক্ষা করে –
কতখানি মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নামলে না খেয়ে, চাকরি হারানোর ভয় সত্ত্বেও শ্রমিকরা দিনের পর দিন আন্দোলনে থাকতে পারে তা চা শ্রমিকদের জীবন না দেখলে বুঝা যাবে না। হাজার হাজার নারী শ্রমিক যারা সন্তানের মত যত্নে চা গাছ বড় করে, হাড় সর্বস্ব হাতে যতখানি কোমল হওয়া যায় ততখানি কোমল স্পর্শে চায়ের পাতা তোলে যেন গাছ আঘাত না পায়, দুপুরে যাদের খাবার চা পাতা মরিচ ডলে শুকনো রুটি আর বোতলে করে আনা লবন মেশানো চা বা পানি। কমপক্ষে ২৩ কেজি পাতা তুলে বড় পোটলা বানিয়ে মাথায় করে নিয়ে যাওয়া পাতা ওজন করার স্থানে, ছায়া বৃক্ষের ছায়া যাদেরকে রোদের তীব্রতা থেকে বাচাতে পারে না বলে রোদে পোড়া গায়ের রঙ যাদের, সারাদিন প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য যাদের কোনো শৌচাগার নেই, মুখ বুঝে সব সহ্য করা এই নারীরা কেন বাগানের কাজ আর ঘরের দায়িত্ব ছেড়ে রাস্তায় এটা বুঝতে কেন এতো দেরি হচ্ছে মালিক এবং সরকারের? যখন তারা পুলিশের সামনে চিৎকার করে বলে আমরা কি বেঁচে আছি যে আমাদেরকে মারবেন? তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কতখানি যন্ত্রনা তাদের বুকে। একজন কর্মকর্তা যখন কৌশল করে জানতে চেয়েছিল কারা তাদেরকে রাস্তায় নামিয়েছে? একসাথে শ্রমিকরা বলে উঠেছে অভাব আর মজুরির দাবিতে তারা রাস্তায় নেমেছে।
চা বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হিসেব
২৩ আগস্ট সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ টি এ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে চা বাগান মালিকরা জানান, বস্তুত চা শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দৈনিক প্রায় ৪২২ টাকা পেয়ে থাকেন। মালিকদের হিসেবে শ্রমিকরা মাসে প্রায় ১১ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। দৈনিক নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পরিমানের বেশি চা পাতা তুলে তারা দৈনিক ৬৫ টাকা প্লাকিং বোনাস পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া ছুটির দিনে কাজ করে এবং ভোর বেলা মর্নিং ক্যাশ প্লাকিং করে তারা অতিরিক্ত আয় করে থাকেন।
তাদের হিসেবে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় ১৮০-১৮৫/- টাকা পর্যন্ত নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন। তাছাড়া আরও বিবিধ প্রত্যক্ষ সুবিধা যেমন ১৪ দিনের বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ ১৪ দিনের উৎসব ছুটি ভাতা, ২০ দিনের অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতা (৪০/৫০ দিনের মজুরির সমান উৎসব ভাতা), ভবিষ্যৎ তহবিলের উপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে সর্বমোট দৈনিক গড়ে ২৪৬/- টাকা নগদে পেয়ে থাকেন।
টি এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ি, চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যে সকল সুবিধা সমূহ প্রদান করা হয়ে থাকে তা বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন। এই শিল্পে প্রতি শ্রমিককে ২/- টাকা কেজি দরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল/ আটা রেশন হিসেবে প্রদান করা হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ২,৩১০/- টাকা। তাছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে চা শিল্পে প্রায় ৯৪,২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে চা শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে।
চা শ্রমিকদের বসত বাড়ির জন্য বিনামূল্যে পরিবার প্রতি ১,৫৫১ স্কয়ার ফিট জায়গার মধ্যে ৩৭০ বর্গফুট বিশিষ্ট সর্বমোট ৬৮,৮০৬ বসতবাড়ি কোম্পানি নির্মাণ করেছে এবং এর বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন।
তাছাড়া, শ্রমিকগণ হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন করে থাকেন এবং গবাদিপশু পালনের জন্য চারণভূমি ও রাখালের খরচও কোম্পানি বহন করে থাকে।
উদ্যোক্তারা বলেন, এছাড়াও একজন চা শ্রমিক অবসর গ্রহণ করলে তার পরিবর্তে তার পছন্দ অনুযায়ী পরিবারের একজনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা পেনশনের আদলে সাপ্তাহিক ১৫০/- টাকা অবসর ভাতা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা এবং ২/- টাকা প্রতি কেজি মূল্যে চাল বা আটাও পেয়ে থাকেন।
১৯০ বছরের পুরোনো শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের অন্যান্য যেকোনো শিল্পের তুলনায় অনেক আগে থেকেই শ্রমিক আইন অনুসরণপূর্বক ৭০ দশকে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ এর মাধ্যমে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সম কাজ এবং সম মজুরি নিশ্চিত করেছে।
তারা আরো বলেছেন, চা শিল্পে ১৯৩৯ সাল থেকে শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রচলন করে, যা বর্তমানে ১৬ সপ্তাহ মাতৃকালীন ছুটি ও আইন নির্ধারিত মাতৃকালীন ভাতা দিয়ে থাকে। চা বাগানগুলো, গর্ভ ও প্রসবকালীন জটিলতাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছে যা বাংলাদেশে প্রচলিত অন্য শিল্পে বিরল। সর্বোপরি সবদিক থেকেই চা শিল্প অনেক আগে থেকেই সুসংগঠিত একটি শিল্প।
শ্রমিকের ভাতা, বিভিন্ন রকম শ্রমিক কল্যাণমূলক যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানি, ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক, স্বাস্থসম্মত টয়লেট, পূজা, বিনোদন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। উপরোক্ত এ সকল সুবিধা টাকার অংক হিসাবে প্রায় ৪৩/- টাকা দাঁড়ায়।
উল্লেখ্য যে, প্রতিটি চা বাগান (ওয়েলফেয়ার এস্টেট) হিসেবে পরিচালিত হয় এবং ইংরেজী প্রবাদ বাক্যের আদলে বলতে গেলে বলতে হয় চা বাগান কোম্পানি গুলো তাদের প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের সদস্যের “জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত” এর সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি চাহিদার সাথে চা কোম্পানির অবদান অনস্বীকার্য।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মজুরি হিসেবে নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা, চিকিৎসা বাবদ সাড়ে ৭ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ শূন্য দশমিক ০২ টাকা, বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা, অবসরভাতা ২ টাকা, গরু চরানো বাবদ ১ টাকা, চা-শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয় বাবদ দেড় টাকা দেওয়া হয়।
চা শ্রমিকদের বাস্তবে প্রাপ্তি কত?
মালিকদের প্রদত্ত হিসেব তো পাওয়া গেল এখন এক এক করে হিসেব করে দেখা যাক ঘোষণা, প্রচারনা আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক কত?
প্লাকিং বোনাস
প্রতিদিন নাকি শ্রমিকরা প্লাকিং বোনাস পায় ৬৫ টাকা। এর অর্থ কি আর প্রাপ্ত অর্থের পরিমান কত? কোন শ্রমিক যদি তার প্রাপ্ত মজুরিতে সংসার চালাতে না পেরে অতিরিক্ত কাজ করেন তাহলে তা কি মজুরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়? এর মাধ্যমে তো এটাই প্রমানিত হয় যে মজুরি এত কম যে শ্রমিকদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। সাধারনত প্লাকিং মৌসুমে এবং তরুণ, যুবকরা কিছুটা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারে। বাকি সারাবছর নিরিখ পুরন করাই কঠিন চা শ্রমিকদের জন্য। অভাবের তাড়নায় কয়েকটা বাড়তি টাকার জন্য শ্রমিকরা জীবনীশক্তি নিঃশেষ করতে থাকে। ৩৫/৪০ বছর বয়সী শ্রমিকরা কি এই বাড়তি কাজ করতে পারে? চা শ্রমিকদের চেহারা দেখলে আর কোন প্রমান দরকার হয় না। তারপরও এটা তো বাস্তবে সাধারণ দৈনিক মজুরি নয়। এটা শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অতিরিক্ত সময়ে বা অধিক কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুন মজুরি প্রদানের কথা আছে। তা কি দেয়া হয়? ফলে এগুলিকে দৈনিক হিসেবে দেখানো কি প্রতারণামূলক নয়?
রেশনের হিসেব কি ঠিক আছে?
চা শ্রমিকদের রেশনের যে হিসেব দেয়া হয়েছে তা যাচাই করে দেখা যাক!
একজন স্থায়ী পুরুষ শ্রমিক সপ্তাহে রেশন পান – ৩.২৭ কেজি
তার নির্ভরশীল স্ত্রী পান- ২.৪৪ কেজি
সন্তান (৮ বছর পর্যন্ত) – ১.২২ কেজি
সন্তান (১২ বছরের নিচে) – ২.৪৪ কেজি চাল অথবা আটা পেয়ে থাকেন। সন্তানের বয়স ১২ বছরের বেশি হলে মা বাবা তাদের জন্য কোন রেশন পাবেন না। চা বাগানের বেশিরভাগ শ্রমিক নারী কিন্তু নারী শ্রমিকরা তাদের নির্ভরশীলদের জন্য কোন রেশন পান না। তিনি অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। ধানী জমি থাকলে রেশন দেওয়া হয় না।
তাহলে দেখা গেল রেশনের হিসাব বড় জটিল। সপ্তাহে রেশন পান ৬ কেজি থেকে ৯.৩৭ কেজি আর মাসে সর্বমোট রেশন পেয়ে থাকেন ২৪ কেজি থেকে ৩৭.৪৮ কেজি। কেজি প্রতি দাম শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২ টাকা। কেজি প্রতি ৪৫ টাকা ভর্তুকি দিলে মাসে রেশন বাবদ শ্রমিকরা পান ১০৮০ টাকা থেকে সরবোচ্চ ১৬৮৬ টাকা। তাহলে দিনে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা থেকে ৫৬ টাকা। প্রচার আর প্রাপ্তির মধ্যে কি বিশাল ঘাটতি।
ধান চাষের জমি ও খাদ্য নিরাপত্তা
শ্রমিকরা কিছু চাষবাস করেন এ জন্য মজুরিতে তা হিসাব করে দেখানো হয়েছে। সাধারনত চা বাগানের যে অংশে চা গাছ লাগানো যায় না অর্থাৎ নিচু জলাভুমির মত সেই অংশে ধান চাষের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। আবার যারা বাগানের জমি আবাদ করেন তাদের রেশন কেটে রাখা হয়। একটু বাড়তি আয়ের জন্য রেশন বাদ দিয়ে তাদের পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে জমিতে। আবার ধান খেতের জন্য ভুমি উন্নয়ন কর প্রতিদিন ১০ পয়সা অর্থাৎ মাসে তিন টাকা ধরা হয়েছে। চা শ্রমিকরা যে হাঁস মুরগি গরু ছাগল পালন করে তার রাখালের খরচ নাকি মালিক দিয়ে থাকে। ভাবুন একবার! রাখালের বেতন দেবার জন্য প্রতিদিন মজুরিতে ধরা হয়েছে ১ টাকা। সংসারের অভাব মেটানোর জন্য পতিত জমিতে আবাদ করে তাকে উন্নত করেছে শ্রমিকরা এটাকেও মজুরির অংশ বানানোর কথা বলা হয়েছে। বাসাবাড়িতে শ্রমিকরা গাছ লাগিয়ে থাকে সেখানে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ-১৪টাকা শ্রমিকদের মজুরির সাথে যুক্ত করে দেখানো হয়েছে। এক চিলতে জমিতে একটা লাউ, পেপে কিংবা পেয়ারা গাছের ফলের দামও হিসেবের বাইরে নেই!
চা শ্রমিকদের ঘর – একসাথে বসবাস মানুষ ও প্রাণীর
চা শ্রমিকদের গৃহের জন্য ভুমি উন্নয়ন কর/ ইজারা মুল্য ধরা হয়েছে প্রতিদিন ২ পয়সা। প্রতিদিন ২ পয়সাও হিসেব থেকে বাদ দেন নি তারা। প্রতিদিন ২ পয়সা মানে মাসে ৬০ পয়সা আর বছরে ৭ টাকা ২০ পয়সা তারা ধার্য করেছেন শ্রমিকের উপর। এক শতাংশ জায়গার জন্য ৩ টাকা মালিকরা সরকারকে দিয়ে থাকেন চা বাগানের জমি ইজারা নেয়ার জন্য। এক শতাংশ সমান ৪৩৫ বর্গফুট। মালিকরা বলছেন ৩৭০ বর্গফুট ঘর তারা দিয়ে থাকেন। বাস্তবে মিত্তিঙ্গা টাইপের ঘর হয় ২১ ফুট বাই ১০ ফুট অর্থাৎ ২১০ বর্গফুট। অর্ধেক শতাংশ যার খাজনা ১.৫০ টাকা আর মালিকরা আদায় করেন ৭.২০ টাকা। টিন, বাশ, মাটি দিয়ে ঘর বানানোর খরচ যদি ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয় আর ১০ বছর তা টিকে থাকে তাহলে প্রতি বছর, প্রতি মাস , প্রতি দিন হিসেব করলে আসে ৭ টাকা। কিন্তু ঘর বাবদ ধরা হয়েছে প্রতিদিন ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা। এরপরও তারা বিনামুল্যে বাড়ি দেয়ার কৃতিত্ব তারা দাবি করছেন।
কি আছে চা বাগানের জন্য জমি পাওয়ার শর্তের মধ্যে?
২ লাখ ৮০ হাজার একর জমিতে নিবন্ধিত চা বাগানগুলো অবস্থিত। প্রতি একর জমির ভুমি উন্নয়ন কর বা খাজনা ৩০০ টাকা। অন্যদিকে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জমি ১২৫ টাকা শতাংশ হিসাবে খাজনা দেওয়া হয়। সে হিসাবে এক একর (১০০ শতাংশে এক একর) জমির খাজনা দাঁড়ায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অথচ চা শিল্প দাবি করে তারা খাজনা দেন ৪০ ভাগের এক ভাগের কম। ইজারা নেয়ার শর্তের মধ্যেই আছে –
অনুচ্ছেদ ১২ – চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের সুবিধাবলী
১২.১ চা বাগান শ্রমিকদের বসবাসের জন্য সুপরিসর বাসগৃহ প্রদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
১২.২ শ্রমিকদের পয়নিস্কাসনের জন্য যথাযথ স্যানিটেশন সুবিধা প্রদান, গভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানিয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
১২.৩ চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করিতে হইবে।
তাহলে পয়নিস্কাসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের যে কথা মালিকরা বলছেন তা তো জমি ইজারার শর্তের মধ্যেই আছে। এটা কোন বদান্য বা সুবিধা দেয়া নয়। অথচ এ সবের জন্য দৈনিক ৪৩ টাকা করে হিসেবে ধরেছেন তারা। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী মালিকপক্ষ প্রত্যেক শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের জন্য বিনা মূল্যে বাসস্থান নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশ টি বোর্ডের তৎকালীন হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ৩২ হাজার ৯৯৯ স্থায়ী শ্রমিকের জন্য আবাসন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। যাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁদের একটিমাত্র ঘরে কোনো বিভাজকের ব্যবস্থা না থাকায় মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ছেলের স্ত্রী এবং গরু-ছাগল নিয়ে পুরো পরিবারকে একসঙ্গে বসবাস করতে হয়।
চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কি বলা হয়েছে আর বাস্তবতা কি?
মালিকদের দাবি, চা শ্রমিক ও তার পুরো পরিবারের সকলেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকেন অথচ অন্যান্য শিল্পে শুধু মাত্র শ্রমিক নিজেই এই সুবিধা পান। শ্রমিকদের মৃত্যুর পরেও তার পরিবারের জন্য এই সুবিধা বহাল থাকে। উল্লেখ্য যে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চা শিল্পে ০২ টি বড় আকারের আধুনিক গ্ৰুপ হাসপাতাল ও ৮৪ টি গার্ডেন হাসপাতালে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫ টি ডিসপেনসারি সহ সর্বমোট ৮৯১ জন মেডিকেল স্টাফ নিয়োজিত আছেন।
টি আই বি’র এক জরিপে দেখা যায় যে মালিকদের এই দাবির সাথে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। প্রতিটি বাগানে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম থাকলেও জরিপের আওতাভুক্ত ৬৪টি বাগানের মধ্যে ১১টিতেই তা ছিল না। বেশির ভাগ চা–বাগানের চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। নিয়ম অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকার কথা থাকলেও, বেশির ভাগ বাগানমালিক তা মানেন না। আর শ্রম আইনের ৮৯(৫) অনুযায়ী প্রতি ৩০০ শ্রমিকের জন্য চিকিৎসক, নার্সিং স্টাফ সহ যন্ত্রপাতি সহ ডিসপেনসারি থাকতে হবে। সে অনুযায়ী ডিসপেনসারি থাকার কথা কমপক্ষে ৫০০টি। ডিসপেনসারি আছে বলা হচ্ছে ১৫৫ টি যদিও ডাক্তার কতজন তা বলা হয় নি। আর চিকিৎসা কি পায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চা-বাগানের চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই খারাপ। কোনো রোগী অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। চা-বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা-বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা-বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, গর্ভবতী নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায় অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়, স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭.৫ শতাংশ। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যায় ৪৬ শতাংশ কিশোরীর, ন্যুনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই চা বাগানের ৬৭ শতাংশ মানুষের।
চা শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা – ঘোষণা ও বাস্তবতা
টি এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাগন বলেছেন, চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরনে প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চ বিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮ টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে যেখানে ১,২৩২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন যেখানে বর্তমানে ৪৪,১৭১ জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। কি দারুণ তথ্য! ১৬৮টি বাগানে ৭৬৮ টি বিদ্যালয় হলে গড়ে প্রতি বাগানে সাড়ে ৪ টি বিদ্যালয়। কিন্তু একটা হিসাব সব গোলমাল করে দিল। শিক্ষক আছে নাকি ১২৩২ জন। মানে বাগান প্রতি দেড়জন শিক্ষক। একটা স্কুলে ১ জন থেকে ২ জন শিক্ষক, কি শিক্ষা দেবেন তারা? শ্রম আইনের বিধিমালা অনুযায়ী বাগানমালিকের নিজ উদ্যোগে বাগানপ্রতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু জরিপে দেখা যাচ্ছে ৬২ শতাংশ বাগানমালিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেননি।
চা শ্রমিকদের ছুটি আর মালিকদের বক্তব্য
মালিকরা বলছেন,চা শ্রমিকদের প্রতি বছরে অর্জিত ছুটি(১৪দিন) বাবদ দৈনিক ৪ টাকা ৬০ পয়সা দেয়। ছুটি শ্রমিকের অধিকার এর আর্থিক মুল্য হিসাব করে মজুরির সাথে যুক্ত করা কি কোন আইনের মধ্যে পরে? অনেকটা প্রতারণার মত নয় কি? চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে ও আইনের নির্মম লঙ্ঘনের মাধ্যমে শ্রমিকদের ন্যায্যপ্রাপ্তি থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রম আইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকাবর্ষে পূর্ণ বেতনে ১০ দিনের যে নৈমিত্তিক ছুটি পেয়ে থাকেন, চা–শ্রমিকের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। অন্য সমপর্যায়ের খাতে প্রতি ১৮ কর্মদিবসের জন্য শ্রমিকেরা ১ দিন অর্জিত ছুটি পেয়ে থাকেন, যা চা–বাগানে ২২ দিনে ১ দিন। অন্য খাতে দুই বছর চাকরি পূর্ণ হলে ভবিষ্য তহবিলে মালিকপক্ষের প্রদেয় অংশ সম্পূর্ণ পাবেন, চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা ১০ বছর। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফার ৫ শতাংশের ৮০ শতাংশ শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে ও বাকি ২০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রদেয় হবে। কোনো চা–বাগানে এই নিয়ম মানা হয়, এমন কোনো তথ্য নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী যে গ্রুপ বিমার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা চা–বাগানে মানা হয় না। আইনানুযায়ী কোনো শ্রমিক তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিশকাল অতিক্রম করার পর স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পাবেন, কিন্তু তা মানা হয় না। কারণ, স্থায়ী হলে শ্রমিক নির্ধারিত মজুরিসহ অন্য সুবিধাসমূহ প্রাপ্য হবেন। স্থায়ী হওয়া শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। নিয়োগপত্রের বিকল্প সি-ফরম দেওয়ার নিয়ম থাকলেও একটি জরিপে দেখা যায় ৯৩ শতাংশ স্থায়ী হিসেবে কর্মরতদের কোনো নিয়োগসংক্রান্ত নথি দেওয়া হয় না।
এত বঞ্চনা তবুও চা শ্রমিকরা বাগানেই পড়ে আছেন কেন?
শ্রমিকদের আন্দোলন দেখে অনেকেই বলছেন, এত যদি বঞ্চনা তাহলে চা শ্রমিকরা অন্য কোথাও কাজ খুজে নেয় না কেন? তারা চা শ্রমিকদের জীবন এবং সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, আত্মীয়তার বন্ধন এবং শত বছর ধরে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রভাব বিবেচনা করছেন না। চা বাগান ছেড়ে তারা কোথায় যাবেন আর বৃহত্তর সমাজ তাদেরকে কি গ্রহন করবে? এই চিন্তা তাদেরকে মাটি কামড়ে বাগানেই পড়ে থাকতে বাধ্য করে। মালিকরা যথার্থই বলেছে, চা শ্রমিকরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চা বাগানেই জড়িয়ে থাকে। এটাই চা শ্রমিকদের অসহায়ত্ব আর বাগান মালিকদের শক্তি।
কি দিয়ে কি পায়, চা শ্রমিকরা?
দিনে কমপক্ষে ২৩ কেজি চা পাতা তোলে একজন চা শ্রমিক। চা পাতাকে পাঁচ ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে চা উৎপাদন করা হয়। এতে গড়ে ৪ কেজি কাঁচা চা পাতা থেকে ১ কেজি চা উৎপাদন হয়। সাড়ে ৫ কেজি চায়ের নিলাম মুল্য কমপক্ষে ১১০০ টাকা। এই নিলাম প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন আছে। সিন্ডিকেটের কারনে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা কঠিন। তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের হিসাব নিকাশ করতে হবে । ১২০ টাকা মজুরি, গড়ে ৪৬ টাকা রেশন, ৭ টাকা ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য ভাতা সহ ১৮৫ টাকা দিয়ে থাকে মালিকরা। বাগানের ইজারা, বাগান ব্যবস্থাপনা খরচ, চা প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ, বাজারজাতকরনের খরচ আর চা শ্রমিকদের মজুরি এসব মিলেই তো চায়ের উৎপাদন খরচ। শ্রমিকরা চা উৎপাদনে যতখানি মুল্য সংযোজন করেছে তার পুরোটা চায় নি। তাদের চাওয়া ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি। শ্রমিকের মজুরি ৩০০ টাকার সাথে ১০০ টাকা ভাতাসহ আনুষঙ্গিক বিষয় যুক্ত করলে শ্রমিকের জন্য খরচ দাঁড়াবে ৪০০ টাকা। ব্যবস্থাপনা খরচ, বিপনন খরচ ৪০০ টাকা ধরলেও প্রতিজন শ্রমিক প্রতিদিন ৩০০ টাকা মালিককে মুনাফা দিতে পারে। ফলে শ্রমিকের প্রত্যাশা অনুযায়ী মজুরি দিলে মালিকের মুনাফা কিছুটা কমবে কিন্তু লোকসান হবে না। এতে শ্রমিকের জীবনমান কিছুটা উন্নত হবে।
ফলে এই আন্দোলন উন্মোচিত করে দিয়েছে চা শ্রমিকদের জীবনের বঞ্চনা। একদিকে মালিকের মুনাফা অন্যদিকে চা শ্রমিকের মান সম্পন্ন জীবনের উপযোগী মজুরি এই দ্বন্দ্বে শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের কর্তব্য।
লেখকঃ সভাপতি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট