মতামত

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন?

-অধ্যাপক এম এম আকাশ

-৪র্থ পর্ব-

স্বৈরাচারী দ্বিতীয় পর্ব-১৯৭৫-৯০

প্রথম পর্বে শ্রমিকদের প্রধান সমস্যা ছিল ‘’দারিদ্র্যতা’’ অর্থাৎ খাওয়া-পরাই জুটছিল না। বিশেষ করে যারা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ছিলেন না, তাদের কাজ করতে হতো অনানুষ্ঠানিক অকৃষি খাতে অথবা মৌসুম নির্ভর কৃষি খাতে। ফলে সারা বছর কর্ম সংন্থান ছিল না এবং সবসময় আয়ের নিশ্চয়তাও ছিল না। গ্রামের মজুরদের সংগঠনে একসময় দাবি ছিল দৈনিক মজুরি মাত্র সারা চার কেজি চাল। আর শহরের শ্রমিকদের দাবি ছিল রেশনে কম দামে চাল-ডাল-তেল-লবণ, ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। শ্রমিকদের মিছিলে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘’চাল-ডাল-তেলের দাম কমাতে হবে।‘’ ১৯৭৫ সালের পরিবর্তনের পর অর্থনীতিতে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাবাউট টার্নের সূচনা হয়। ‘’মুক্তবাজার অর্থনীতির’’ মতাদর্শকে অনুসরণ করা শুরু হয়। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদ ব্যাক্তি মালিকানায় ফেরত দেয়া হয় অথবা সে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। মাথা ব্যথা হলেই মাথা কেটে ফেলার প্রেসক্রিপশান কার্যকরী হতে থাকে। এতে সরকারের উপরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান ও ভর্তুকির চাপ কমে যায় ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে সৃষ্টি হয় প্রচুর লে-অফ এবং বেকার শ্রমিক। তখন অবশ্য শ্রমিকশ্রেণি SKOP গঠন করে এক বীরত্বপূণ লড়াই চালিয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ী শ্রেণির কোয়ালিশনের কাছে শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হন।

এ কথা ঠিক যে জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলিতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার দরুন নতুন এক ধরনের নিকৃষ্ট লুটেরা পুঁজির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তা সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে হয়নি—হয়েছিল অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনীতিবিদদের মধ্যে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই ত্রিভুজ আরো ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে তখন থেকেই। সে সময় কোন সুশাসনের বা মানবাধিকারের প্রশ্ন বা শর্ত আরোপ না করেই বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ জেনারেল এরশাদকে অঢেল বৈদেশিক সাহায্য দিয়েছিলো।

এ সময় বেকার নিরন্ন শ্রমিকদের মধ্যেও কিছু লুম্পেন প্রবণতা বাধ্য হয়ে বৃদ্ধি পায়। আমরা সমাজে তখন শ্রমিক-মালিকের মধ্যে নতুন প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট রাজনীতির জন্মও হতে দেখি। অবশেষে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রই টাকা-পেশীশক্তি-প্রশাসনিক কারসাজির হাতে বন্দি হয়ে যায়। নেমে আসে চতুর্দিকে শ্বাসরুদ্ধকর এক অন্ধকার। যদিও স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল শ্রমিকশ্রেণির বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের দ্বারা, কিন্তু আন্দোলনের ফসল শ্রমিকদের ঘরে উঠেনি। প্রধান দুটি বুর্জোয়া দল গন আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে হঠানের পর ক্ষমতায় পালাক্রমে শাসন চালালেও তারা কেউই স্বৈরাচার ও বিদেশী ব্যবস্থাপকদের নির্দেশিত “মুক্ত বাজার” অর্থনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

আমরা জানি, মুক্ত বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক পরিনতি হচ্ছে –ধনী আরো ধনী হবে এবং গরীব আরো গরীব হবে। আদি সমতাই ত্বরান্বিত হারে বর্ধিত অসমতার সৃষ্টি করবে। এই ধরণের অর্থনীতির মধ্যে প্রবৃদ্ধি হলেও তার চরিত্র সুষম বা অন্তর্ভূক্তিমূলক হয় না।  বর্ধিত প্রবৃদ্ধির অল্প অংশই দরিদ্রদের কাছে পৌঁছায়। তাই দরিদ্র মানুষেরা যতটুকু পায় তাতে চরম দরিদ্র অবস্থা থেকে সামান্য পরিমান উপরে উঠতে পারলেও আপেক্ষিকভাবে তাদের অবস্থানের কোন মৌলিক হেরফেরতো হয়ই না বরং আপেক্ষিকভাবে আরো নীচে নেমে যায়। এ জন্যই সারা পৃথিবীতে এখন যে লড়াইতা তীব্র হচ্ছে ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের লড়াই। তার মূল কারন সমাজের সর্বোচ্চ ১ শতাংশের আসন, ভূষণ, চলাফেরা ফ্যাশন সবই এত উপরে এবং তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিনোদন এতই উঁচুতে যে, নীচের যে মানুষেরা কম খেয়ে –কম পরে –কম শিখে –কম আয়ুতে জীবনযাপন করে বেঁচে থাকছেন, তাদের মধ্যে কোনভাবেই সন্তোষ তৈরি হচ্ছে না। কারন তাদের মনে হচ্ছে উপরের শাসকদের “আয় ও ভোগ বেশি হয়েছে শুধু তা নয় এটা হয়েছে তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে, শোষণ করে –“অন্যায় ভাবে অবিচার করে”। এই বিশাল আয় বৈষম্যকে তারা কিছুতেই Legitimate ভাবতে পারছেনা শ্রমিকশ্রেণিসহ ব্যাপক মানুষের মধ্যে আজ ভরসার অভাব, বিশ্বাসের অভাব, নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও অপাংক্তেয় ভাবার ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা বুঝতে পারছেন এ সমাজে বৈধ পথে উপরে ওঠার সুযোগ তাদের জন্য নেই।

চলবে  . . .

(প্রবন্ধটি বিগত ১৮ নভেমবর ‘২২ তারিখে টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয়েছে)

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ