ফারদিন ‘আত্মহত্যা’ করেছেন – বলছে পুলিশ, তবে তার বান্ধবী এখনও জেলে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারদিন নূরের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে বর্ণনা করে বক্তব্য দিয়েছে পুলিশ।
ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং অর্থাভাবের মত নানা কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফারদিন আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে তারা মনে করছেন।
তিনি আরো বলেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন কোন প্রমাণ তারা পাননি।
তবে এর আগে ফারদিন নূরকে ‘হত্যায় জড়িত থাকার সন্দেহে’ আটক হওয়া তার বান্ধবী কবে কারাগার থেকে ছাড়া পেতে পারেন – তা এখনও পরিষ্কার নয়।
গত ৭ই নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূরের লাশ উদ্ধার হয়। মৃতদেহ পাওয়ার পরদিন ফারদিনের বাবা যে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন, সেই মামলায় হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে তার এক বান্ধবীকে আটক করে পুলিশ।
বিতর্ক প্রতিযোগিতার সূত্রে গত কয়েকবছর ধরেই ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা ওই তরুণী ও ফারদিনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল বলে জানায় পুলিশ ও মেয়েটির পরিবার।
তদন্তকারী পুলিশ ১০ই নভেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মেয়েটির পাঁচ দিনের রিমান্ড চায়। সেসময় আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন এবং রিমান্ড শেষে ১৬ই নভেম্বর তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
ফারদিন নূর চৌঠা নভেম্বর রাত থেকেই নিখোঁজ ছিলেন।
চৌঠা নভেম্বর দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ফারদিন তার বান্ধবীর সাথে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান এবং রাতে ১০টার দিকে তাকে রামপুরায় তার বাসার কাছে নামিয়ে দেন।
নভেম্বরের সাত তারিখ নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর প্রাথমিক তদন্ত শেষে ফারদিন নূর ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে বুধবার বিবৃতি দেয় র্যাব ও ডিবি পুলিশ।
তবে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন বলে জানানো হলেও তাকে হত্যার সন্দেহে আটক হয়ে কারাগারে থাকা মেয়েটি এখন ছাড়া পাবেন কিনা – বা তার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেবিষয়ে এখনও পরিষ্কার নন তার আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা কী বলছেন?
ফারদিনের বান্ধবীর আইনজীবী হাবিবুর রহমান চুন্নু জানিয়েছেন তার জামিন আবেদনের পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ই জানুয়ারি।
তবে তিনি বলছেন, এই শুনানির তারিখ যেন এগিয়ে আনা হয় সেজন্য আবেদন করবেন তারা।
হাবিবুর রহমান বলেন, “তদন্তকারী সংস্থা যেহেতু জানিয়েছে যে ফারদিন আত্মহত্যা করেছে, কাজেই মেয়েটির তার হত্যার সাথে জড়িত থাকার সম্ভাবনা নেই। তাই তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই আমরা পিটিশন ফাইল করবো যেন তার জামিন আবেদনের তারিখ আগানো হয়।”
১৬ই নভেম্বর প্রথম দফায় ফারদিনের বান্ধবীর জামিন নামঞ্জুর করার দিন তার জামিন আবেদন উপস্থাপন করেন আইনজীবী মোখলেসুর রহমান বাদল, যিনি বলছিলেন ফারদিনের ‘আত্মহত্যা’র খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তার মৃত্যুর সাথে মেয়েটির সংশ্লিষ্টতার আর কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে না।
“মেয়েটির সাথে ফারদিনের বন্ধুত্ব ছিল। প্রাথমিক তদন্তে কোথাও এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বা ফারদিন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্ররোচনার সম্ভাবনাও থাকছে না।”
অন্যদিকে ফারদিন নূর আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশ যে বক্তব্য দিয়েছে, ওই শিক্ষার্থীর পিতা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিনের দাবি, তার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ফারদিনের সহপাঠীরাও পুনরায় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন । এরপর দায়ের করা বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলা নানা মোড় ঘুরেছে।

তদন্তকারী সংস্থাগুলো কী বলছে?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারদিন নূর ‘হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন’ বলে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বিবৃতি দেয় ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন-অর-রশিদ।
সংবাদ সম্মেলনে মি. রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, “ফারদিনের রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তিনি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে স্পেন যাওয়ার জন্য টাকা যোগাড় করতে পারছিলেন না, মেয়েটির সাথে তার কথোপকথনেও হতাশার প্রকাশ হয়েছে বলে তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি।”
ফারদিনের মৃত্যুর পর প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সুরতহাল প্রতিবেদন শেষে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন যে তার বুকে ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে।
তবে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ডিবি প্রধান জানান যে ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে – এমন কোনো প্রমাণ তারা পাননি।
“তাকে (ফারদিনকে) যে মারপিট করা হয়েছে, এমন কোনো চিহ্ন তার মধ্যে ছিল না। কোথাও ধস্তাধস্তি হয়েছে কিনা, এমন কোনো আঘাতের চিহ্ন তার মধ্যে নেই। সুরতহালের প্রতিবেদনেও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই”, বলেন হারুন-আর-রশিদ।
কী হয়েছিল চৌঠা নভেম্বর?
মৃত্যুর আগের দিন ফারদিন নূর কোথায় গিয়েছিলেন এবং কী কী করেছিলেন – তদন্ত শেষে বুধবার সে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব।
র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মইন জানান, “চার তারিখ দুপুর তিনটার দিকে ফারদিন তার ডেমরার বাসা থেকে বের হন। পরদিন বুয়েটে তার একটি পরীক্ষা ছিল, রাতে বুয়েটের হলে থেকে সেই পরীক্ষা দেবেন বলে জানিয়ে যান তিনি।”
“পরে বিকাল পাঁচটার দিকে সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় এবং রাত দশটার দিকে রামপুরা এলাকায় তিনি ঘোরাঘুরি করেন। তথ্য-প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি যে এরপর রাতে তিনি বাবু বাজার ব্রিজ, পুরনো ঢাকার জনসন রোড ও গুলিস্তান এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন।”
“এরপর যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে রাত দুইটার দিকে তিনি একটি লেগুনায় ওঠেন এবং সুলতানা কামাল ব্রিজের পাশে বিশ্বরোডের মোড়ে লেগুনা থেকে নেমে যান রাত দুইটাা বিশ মিনিটে।”
এরপর ফারদিন রাত দু’টা চৌত্রিশ মিনিটে ব্রিজ থেকে স্বেচ্ছায় পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে বলে জানান তিনি।
সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ব্রিজ থেকে একজনের পানিতে পড়ার একটি ভিডিওচিত্র বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে ।
শুরুর দিকে পুলিশ ধারণা করেছিল যে ফারদিনের মৃত্যুর সাথে মাদক ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
তবে প্রায় একমাস তদন্তের পর পুলিশ ফারদিন আত্মহত্যা করেছিল বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালো তারা।