পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে নগরের ১১ ওয়ার্ড
নগরের পৃথক ১১টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা পাহাড় ধসের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ওয়ার্ডগুলোর ৪ হাজার ৬২৫টি ভবন এবং অবকাঠামো আছে এ পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। আছে ২৮টি প্রথমিক বিদ্যালয় এবং ১৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। এছাড়া ওয়ার্ডগুলোতে বিদ্যমান পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসতি গড়ে উঠায় ধস হলে বাড়তে পারে প্রাণহানি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) প্রণীত ‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ বা চট্টগ্রাম শহরের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে। এতে পাহাড় ধসের কারণ এবং পাহাড় ধস রোধ ও প্রাণহানি এড়াতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে।
আপদকালীন কর্মপরিকল্পনাটি পর্যালোচনায় জানা গেছে, অতীতে নগরের যে সব পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যকবার পাহাড় ধস হয়েছে এবং সর্বাধিক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেই ওয়ার্ডগুলোকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই হিসেবে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে– ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী, ২নং জালালাবাদ, ৩নং পাঁচলাইশ, ৭নং পশ্চিম ষোলশহর, ৮নং শুলকবহর, ৯নং উত্তর পাহাড়তলী, ১৩নং পাহাড়তলী, ১৪নং লালখান বাজার, ১৫নং বাগমনিরাম, ১৬নং চকবাজার এবং ২২নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ড। এসব ওয়ার্ডে লালখান বাজার মতিঝর্ণা, টাঙ্কির পাহাড়, বাটালি হিল, গোলপাহাড়, এ কে খান পাহাড়, রৌফাবাদ পাহাড়, ফিরোজশাহ, কুসুমবাগ, জালালাবাদ পাহাড়, মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়, আরেফিন নগরসহ ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় রয়েছে।
কর্মপরিকল্পনাটির তথ্য অনুযায়ী, নগরে প্রায় ৩০ হাজার ৭৮৬ জন মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৭১ জন শিশু আছে। নিয়মিত পাহাড় ধস হলে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ ধসে পড়া কাঠামোর ভিতরে আটকা পড়বে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ মারা যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের অন্যান্য জায়গায় পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত শহরের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের বেশিরভাগ ঢালে অবৈধ দখলদার থাকে। পুনর্বাসন সমস্যার সমাধান করা না গেলে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাহাড় ধসের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়বে।
এদিকে নগরে পাহাড় ধসের ঘটনা পর্যালোচনায় জানা গেছে, গত দুই যুগে নগরে ২৫৯ জন মারা গেছেন পাহাড় ধসে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল (২০২৩) আকবর শাহ থানার বেলতলী ঘোনায় মারা যায় একজন। এছাড়া দুই যুগ আগে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। ওইদিন সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা যায় ১০ জন।
অবশ্য গত দুই যুগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওইদিন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। আজ রোববার সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছ। ওই ঘটনার পর তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসনকে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে ওইদিন রেলওয়ে পাহাড়তলী এলাকার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ১২ জনের মৃত্যুর জন্য গঠিত একটি কমিটি ১৪টি এবং নগর ও আশেপাশের এলাকায় ভূমিধসে প্রাণহানির জন্য গঠিত ৩৬টি সুপারিশ করে। ওইসব সুপারিশের বেশিরভাগ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে প্রায় প্রতিবছর নগরে পাহাড় ধসে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
চসিকের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কনসাল্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য সিলড্রেন ও ইপসা কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়নে সহযোগিতা করে। চলতি মাসে প্রকাশিত কর্মপরিকল্পটি গত বুধবার সিটি মেয়রের কাছে হস্তান্তর করে সহযোগী দুই প্রতিষ্ঠান।
‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ এ পাহাড় ধসের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত, মাটির একসাথে লেগে থাকার শক্তির স্বল্পতা, পাহাড়ের ঢালে বৃক্ষরোপণের কমতি, অবৈজ্ঞানিক এবং অবৈধভাবে পাহাড় কাটা, নিম্ন নিষ্কাশন ক্ষমতাকে দায়ী করা হয়।
অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে– স্থানীয় প্রভাবশালী দ্বারা অবৈধ পাহাড় দখল ও কাটা। পাহাড়ে জোরপূর্বক অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন এবং রিয়েল এস্টেট কোম্পানির দ্বারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় কাটা। এতে বলা হয়, পাহাড়ের পাদদেশ হল প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, যেখানে মাটি দখলকারীরা পাহাড় কাটে। এগুলো পাহাড়ের খাড়া ঢালের সৃষ্টি করে। তাই পাহাড়ের খাড়া ঢালে মাটি পিছলে যাওয়ার জন্যই উক্ত এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষাকালে ঢালগুলো তাদের স্থিতিশীলতা হারায় এবং কর্দমাক্ত মাটি আলগা হয়ে যায়। এসময় বৃষ্টির জলের অতিরিক্ত ওজন ধরে রাখতে না পেরে ভূমিধস হয়।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাহাড় কাটার ফলে ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, গাছপালার আচ্ছাদন বিনষ্ট হয়, মাটির দৃঢ়তা হ্রাস পায় এবং বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ধস হয়।’
চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক জানান, ভূমিধস এড়াতে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নের গুরুত্ব বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজন হলে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন বিষয়ক কর্মশালা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য তাদের সামর্থ্যের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার আশেপাশে ভবন নির্মাণের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য তাদের সামর্থ্যের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সমাধানের দিকে জোর গুরুত্ব দিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের সঠিক সময়ে পুনর্বাসন করতে পারে এমন স্থান সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করার জন্য প্রতি বছর ঝুঁকি মানচিত্র ও সঠিক পূর্বাভাস প্রদানকারী মডেল তৈরি করতে হবে।