চলমান সংবাদ

নির্যাতন ও আক্রমণে ঘেরা অভিবাসন রুট- পর্ব ১

তুরস্ক-ইরান সীমান্তের একটি অংশে একদল অভিবাসী। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে স্নাতক শেষে বেশ কয়েকবছর চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন আহসান (ছদ্মনাম)। ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে ১৪ লাখ টাকায় ইটালি আসতে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। কিন্তু ঢাকা থেকে শুরু করা হওয়া সেই যাত্রায় ছিল নানা আক্রমণ ও নির্যাতনের গল্প। আহসানের অভিবাসন যাত্রা নিয়ে পড়ুন ইনফোমাইগ্রেন্টসের তিন পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৬ সালে ইংরেজিতে স্নাতক শেষ করেন আহসান। বারবার আবেদন করেও চাকরি পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ৩০ বছর বয়সি আহসান। নিজ দেশে কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে ইটালি গিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

আহসান ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন,

আমার বাবা বিএনপির একটি জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে সক্রিয় আছেন। আমি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। কিন্তু বাবার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেক সরকারি চাকরিতে লিখিত পরীক্ষায় টিকেও ভাইবা বা মৌখিক এবং গোয়েন্দা রিপোর্টে বারবার বাদ পড়েছিলাম।”

তিনি আরও যোগ করেন, “২০১৬ সালে স্নাতক পাশ করে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে সমাজসেবা অধিদপ্তর, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ও এর অধীনস্থ দপ্তরগুলোতে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু আবেদনে লিখিত পরীক্ষায় প্রথম চেষ্টায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ সহকারি পদেও নিয়োগের শেষ পর্যায়ে ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর শেষ পর্যন্ত নিয়োগ নির্ধারিত হয়। প্রতিবেদনে বেশিরভাগ সময় আমার বাবা ও পরিবারের বিএনপি সংশ্লিষ্টতার তথ্য দেয়া হতো। যার ফলে সকল ধাপে উত্তীর্ণ হয়েও শেষ পর্যন্ত কোথাও চাকরি পাইনি।”

উপায় না দেখে ১৪ লাখ টাকায় ঢাকা থেকে ইটালি পৌঁছাতে একজন দালালের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছেন তিনি। কিন্তু দালালের দেখানো পথ যে কন্টাকীর্ণ যাত্রা সেটি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি অভিবাসনপ্রত্যাশী আহসান।

চুক্তি অনুযায়ী আহসানের ইটালির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রথমে ঢাকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ে পৌঁছান তিনি।

দুবাই থেকে আহসানসহ অন্যরা দেশটির শারজাহ শহরে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে দালালের বাসায় এক মাস থাকেন।

“রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের আশ্রয় দেয় ইরানি পরিবার”

দালালের পরিকল্পনা মতো ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়ার ফ্লাইটে ইরানের উদ্দেশের যাত্রা করেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন বাংলাদেশি অভিবাসী।

ইরান পৌঁছে তাদেরকে তেহরান থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় তুরস্ক সীমান্তবর্তী মাকু শহরে। কারণ তাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল তুরস্ক।

ইরানের মাকু অঞ্চলে খোলা আকাশের নিচে একটি জায়গায় বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জন অভিবাসীকে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশি ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও নেপালের অভিবাসীরা তাদের সঙ্গে ছিলেন বলে জানান আহসান।

আহসান বলেন,

মূলত জায়গাটি ছিল একটি গবাদি পশু রাখার স্থান। সেখানে আমাদের সবাইকে রাখা হয়েছিল। আমরা মোট ২৪ জন বাংলাদশি ছিলাম। সিলেট, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যক্তিরা ছিল আমাদের সঙ্গে।

মাকু শহর থেকে একেবারে তুর্কি সীমান্ত পর্যন্ত অভিবাসীদের একদিন রাতে নিয়ে আসে দালালচক্র। উদ্দেশ্যে তুর্কিতে গেইম মারা বা অনিয়মিত উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়া। প্রথম দফায় অভিবাসীদের মধ্যে ২৭ জনের দলকে পাঠানো হয়।

কিন্তু ইরান সীমান্ত থেকে হেঁটে তুরস্কে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রথম দলটির সবাই তুরস্কের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে যান। ওই সময় তাদেরকে নির্মম নির্যাতন ও রক্তাক্ত করে আবারও ইরানের দিকে পুশব্যাক করে তুরস্কের বাহিনী।

ইরানে ফিরে ৩০ মিনিট হাঁটার পর একদল কথিত মাফিয়া বা সন্ত্রাসীদের সামনে পড়েন আহসানসহ অন্যান্যরা। তারা তাদের সবাইকে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করেন।

উপায় না দেখে এক পর্যায়ে সবাই টাকা দিয়ে দিলে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।

আহসান বলেন,

তুর্কি সীমান্তরক্ষীদের নির্যাতনের পর আমরা সবাই রক্তাক্ত, ক্ষুধার্থ ও দুর্বল অবস্থায় ছিলাম। মাফিয়াদের দাবি করা অর্থ দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলাম। সেখান থেকে হাটতে থাকলে কিছু দূরে কিছু পরিবার আমাদের মধ্যে গুরুতর আহতদের আশ্রয় দেন। তারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিল।

তিনি আরও যোগ করেন, “পরিবারগুলো মূলত সীমান্ত এলাকায় স্থানীয়। তারা গবাদি পশু লালন পালন করে থাকেন। তারা আমাদেরকে এভাবে দলবদ্ধ অবস্থায় বাইরে থাকতে বারণ করেছিলেন। আমাদের দলের মধ্যে সাত জন ভাগ হয়ে কয়েকটি পরিবারে ২০ থেকে ২৫ দিন আশ্রয়ে ছিলাম। এর বিনিময়ে তারা আমাদের কাছ থেকে কোন অর্থ বা সুবিধা দাবি করেননি। আমাদের দলের অন্যরা বিভিন্ন গুহা ও পাহাড়ের ঝোপে রাত কাটিয়েছিলেন।”

আহসান স্মরণ করে বলেন,

সীমান্তের সেই ইরানি পরিবারগুলোর কথা আমি কোনদিন ভুলব না।

তুরস্কের নির্যাতনের দিনগুলো

আহসানসহ অনেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তুর্কিতে প্রবশে দ্বিতীয় গেইমের জন্য বেশ সময় নেন। পরবর্তীতে নতুন এক দালালের সহায়তায় তারা ২০২২ সালের মার্চে তুরস্কে প্রবশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তুরস্কে ঢুকে তারা গাড়িতে রাজধানী আঙ্কারা পৌঁছে দুবাইতে অবস্থানরত দালালকে জানান। দালাল তাদেরকে ইস্তাম্বুলে চলে যেতে বলেন। ইস্তাম্বুলে পৌঁছে তারা দালালের পরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজে চড়ে তুরস্ক থেকে সরাসরি সমুদ্রপথে ইটালিতে গেইম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

জাহাজে চড়ার আগে আহসানসহ প্রায় ৪৫০ জন অভিবাসীকে একটি লরিতে ঢুকানো হয়। কিন্তু লরিটি জাহাজের কাছে পৌঁছার আগেই তুরস্ক পুলিশের হাতে আটক হন তারা।

তুরস্কের পুলিশ সবাইকে আটকের পর বেধড়ক মারধর করে বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়।

আহসান বলেন, “আমিসহ আটক হওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের কাছাকাছি ইস্তাম্বুল অঞ্চলের একটি আটককেন্দ্রে বন্দি ছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনগুলো কেটেছিল এই কেন্দ্রে। অভিবাসন রুটে আমার দেখা সবচেয়ে অমানবিক ও নির্মম পুলিশ হচ্ছে তুরস্ক ও গ্রিসের পুলিশ সদস্যরা।”

তিনি ব্যখ্যা করেন, “ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেখানে দায়িত্ব পালন করা নিরাপত্তারক্ষীরা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকা কক্ষে নিয়ে গিয়ে বিনা কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। সকালে নাস্তা আনতে গেলে কেউ যদি পাঁচ মিনিট আগে চলে যান ঘটনাস্থল থেকে তুলে নিয়ে আলাদা কক্ষে চলে নির্যাতন। আমি অন্তত ছয় থেকে সাত বার নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। অনেক সময় মনে হতো যেন দুনিয়ায় জাহান্নাম দেখছি।”

আহসান যোগ করেন,

বাংলাদেশি, আফগান, পাকিস্তানি ও নেপাল থেকে আসা অভিবাসীদের উপর নির্যাতনের একটি মাত্রা ছিল। কিন্তু সেখানে থাকা সিরীয়দের উপর ছিল না কোন সীমা। আমার সামনেই এক সিরীয় যুবককে তিন থেকে চারজন রক্ষী নির্মম নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমাদের শুধু দুই বেলা খাবার দেওয়া হতো। সকালে তিনটি বিস্কিট এক গ্লাস দুধ এবং রাতে সেদ্ধ গম। এভাবে দুই মাস পার করেছিলাম আমরা।

এক পর্যায়ে ডিটেনশন সেন্টার থেকে বের হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। আহসানসহ অন্যান্য বাংলাদেশিদের জিজ্ঞেস করা হয় তারা কোত্থেকে এসেছেন। তারা বুদ্ধি খাটিয়ে বলেন গ্রিসে প্রবেশ করতে গিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

কারণ অভিবাসীরা যে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার তথ্য দেন সেখানেই তাদেরকে রেখে আসে তুর্কি পুলিশ। বাংলাদেশি অভিবাসীদের সরাসরি বাংলাদেশে ডিপোর্ট না করে ইরান সীমান্তে ফেলে আসার দীর্ঘ একটি প্রথা তুরস্কে চালু রয়েছে।

এটির কোন আইনি ভিত্তি না থাকলেও বছরের পর বছর ধরে এই অনুশীলন চালিয়ে আসছে তুরস্ক পুলিশ।

অভিবাসীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, আহসানসহ অন্যান্য বাংলাদেশিদের গ্রিস সীমান্তের পাশ্ববর্তী একটি শহরে রেখে আসে তুর্কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আহসান বলেন, “আমরা মুক্তি পেয়ে আনন্দিত ছিলাম কিন্তু এত দূর্বল শরীর নিয়ে হাটতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে দালালকে ফোন দিলে আমাদের জন্য ট্যাক্সি পাঠানো হয়। গাড়িতে ইস্তাম্বুল পৌঁছে চলে আবারও গ্রিসের দিকে গেইম দেয়ার অপেক্ষা।”

গ্রিস পৌঁছাতে আহসানের অপেক্ষা এবং গ্রিক পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা এবং সেখান থেকে আলবেনিয়া, বসনিয়া, মন্টিনিগ্রো, ক্রোয়েশিয়ায় ঘটে যাওয়া সব রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে থাকবে এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব।

(সাক্ষাৎকার প্রদান করা ব্যক্তির অনুরোধে নাম গোপন করা হয়েছে।)

সতর্কবার্তা: অভিবাসীদের ব্যক্তিগত গল্পে শুধুমাত্র তাদের অভিজ্ঞতা জানানো হয়। এক্ষেত্রে দালালের মাধ্যমে পৌঁছানোর সফলতা আমলে নেয়া উচিত নয়। শুধু বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন। এমন ভয়ংকরা যাত্রায় নিহত অনেকের লাশ দুর্গম অঞ্চলে পড়ে থাকার নিয়মিত সংবাদ পাওয়া যায়।