চলমান সংবাদ

ডিজিটাল থেকে সাইবার: মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

-শুভ চন্দ্র শীল

শুভ চন্দ্র শীল (ফাইল ছবি)

‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ সবার পরিচিত এবং বহুল আলোচিত-বিতর্কিত একটি আইন। লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কার্টুনিস্ট, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষসহ কেউ রেহাই পায়নি এই আইনে। বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। তবে পার্লামেন্টে পাস হওয়া কালা আইনসমূহের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অন্যতম। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ‘ডিজিটাল’ শব্দটির আবির্ভাব। ডিজিটাল শব্দটির সাথে মিল রেখে বলা হয় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। যদিও পরবর্তীকালে অর্থাৎ বর্তমান সময়ে সেই ‘ডিজিটাল’ শব্দটা ‘স্মার্ট’ শব্দে পরিণত হয়েছে। দেশ এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে কথিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ প্রবেশ করছে। তাই হয়তো সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-কে স্মার্ট বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ নাম দিয়ে আপডেট করার ঘোষণা এসেছে। অথচ নামে পরিবর্তন আনা হলেও আইনটির সারবস্তু একই রয়ে গেছে। যা এক কথায় ‘মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’।
মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মুখের ভাষাকে লেখায়ও রূপ দেয়। ভাষার এ লেখ্য গাঁথুনিই প্রকাশ হয় বিভিন্ন গ্রন্থের অবয়বে। লেখা হয় পত্রপত্রিকায়ও। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের সত্যভাষণ লিখতে গিয়ে অনেককেই ধরা পড়তে হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের জালে। বহুলাংশে বিনাকারণে বরণ করতে হয়েছে জেল-জুলুম-নির্যাতন। আমরা দেখেছি লেখক মুশতাক আহমেদকে কীভাবে আইনি হেফাজতে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রত্যন্ত গ্রামের ঝুমন দাশ, রাজনীতিবিদ মিহির ঘোষ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, তনু, কাজল কিংবা কারাভোগরত শিক্ষার্থী খাদিজা। এরকম হাজারো নাম আছে যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ফাঁদে এই আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন। আইনটিতে ডিজিটাল শব্দটি অনেকাংশে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও। কথা বলা, সঠিক তথ্য প্রকাশ করা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরা, রম্য রচনা, প্রচ্ছদ-কার্টুন, গ্রাফিতি কিংবা ছবি আঁকা- এরকম হাজারো কারণে এ আইনের শিকার হতে হয়েছে অনেককে। ধারাগুলোকে ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দল কিংবা ভিন্নমতের মানুষের ওপর চালানো হয়েছে আইনের অপপ্রয়োগ।
বিভিন্ন ব্যক্তি, গবেষক-বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক-লেখক-ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট, বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনসমূহ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চিকিৎসক-প্রকৌশলী, সাধারণ মানুষ সবাই এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে নাম দিয়েছেন ‘অ-নিরাপত্তা আইন’। অনেকে এ আইনকে বাক-স্বাধীনতা বিরোধী বলেও আখ্যা দিয়েছেন। তাছাড়া ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা এই আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এই আইনের প্রয়োগ স্থগিত করার আহ্বান জানান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা বিল নিয়েও তীব্র প্রতিবাদ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’।
প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে আইনটির সংশোধন করার কথা বললেও এখনো তা করা হয়নি। শুধু আইন সংশোধন নয়, বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা, সেমিনার, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং অব্যাহত রয়েছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী ৭ আগস্ট ’২৩ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, বাতিল নয়, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ নামে প্রতিস্থাপিত হবে। মানহানি মামলার ক্ষেত্রে কারাদÐ নয়, থাকবে জরিমানার বিধান। অনেক ধারায় বড় সংশোধনী আনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তবে এই আইনের সব মামলা চলমান থাকবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। ৯ আগস্ট ’২৩ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির’ ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রকাশ করে সরকার। আইনটি মন্ত্রিসভায় প্রস্তাব হওয়ার পর বেশকিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর ’২৩ সংসদে ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল ২০২৩’ উত্থাপন করেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সংসদে তার বক্তব্যে আইনটিকে ‘উদার’ ও ‘ভবিষ্যতমুখী’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নতুন এই আইনটিতে পুনরায় থাকছে ৬০টি ধারা, পরিবর্তন আসছে ৩১টি ধারায়। শাস্তি ব্যবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। অ-জামিনযোগ্য ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ১১টি ধারায় সাজা কমানো হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীরা এখনো ৫৭ ধারা আইনটি নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বা প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা যাই বলুন এই আইন বাতিলের দাবি করে আসছেন। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবশ্যই বাতিল করে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন তুলে নিয়ে নতুন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকা সময়ের দাবি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্রে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে এ আইনে ৭০০১টি মামলা হয়েছে।
ভারতে ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রোটেকশন বিল পাস-
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে এ বছরের গত আগস্ট মাসে ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রোটেকশন বিল’ সংসদে পেশ করা হয়েছিল। নাগরিকদের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রথমে প্রাথমিকভাবে এই বিল ১১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ সংসদে পেশ করা হয়েছিল। বিলটি পেশ করার পর এই বিলের বেশ কিছু বিষয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিরোধীরা। বিলটি নাগরিকদের ব্যক্তি গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণœ করবে এবং আইনটির সাহায্যে বিরোধীদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানে হস্তক্ষেপ করবে বলে মন্তব্য করেন তারা। বিরোধী সংসদ সদস্যদের তীব্র বিরোধিতার মধ্যে লোকসভায় এই বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। প্রস্তাবিত বিলটিকে অর্থ বিল হিসেবে পেশ করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন কংগ্রেস সংসদ সদস্য মনীশ তিওয়ারি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাজনীতিবিদদের মতপার্থক্য থাকলে বিলটি মানুষের উপকারে আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে আইনটির বিষয়ে প্রয়োজনে আবারও আলোচনায় বসবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
ভারত সরকার যেখানে একটি আইন পাস করার পূর্বে বিভিন্ন মহল ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনা করে এবং বিরোধীদলগুলোর মতামত গ্রহণ করে তা উত্থাপন করে, সেখানে বাংলাদেশে কোনো আইন পাস করার পূর্বে কোনো প্রকার জনশুনানি কিংবা সংশ্লিষ্ট মহল ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই তা পাস করানো হচ্ছে। নিতান্তই যা নাগরিক অধিকারবিরোধী।

৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
লেখক: সাংবাদিক।