বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১৭): দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

কিছুদিন আগে আমরা যখন অনলাইন আলোচনা করি তখন অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল এখানে আমরা বিজ্ঞান সম্পর্কে লিখি না, তারপরেও এর নাম কেন বিজ্ঞান ভাবনা। আসলে দেশে নবম শ্রেণীতে সেই যে আমাদের শিক্ষাকে আর্টস, কমার্স আর সাইন্স – এই তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এরপর থেকে দেশের অধিকাংশ মানুষের ধারণা বিজ্ঞান মানেই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি। আসলেই কি তাই? রাশিয়ায় কিন্ত আর্টসকে বলে হিউম্যানিটারিয়ান সাইন্স। অন্যান্য দেশেও তাই। আসলে এখানে প্রায় সব সাবজেক্টকেই বলে বিজ্ঞান। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে তাঁর আগে আমাদের ঠিক করতে হবে যে বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান আসলে কোন বিষয় নয়, এটা একটা পদ্ধতি। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার এবং যা কিছু জানা সেটাকে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে মানুষের কাছে তুলে ধরাই বিজ্ঞান। তবে সেই পদ্ধতি এমন হতে হবে যেন সেটা অনুরূপ যেকোনো ঘটনার ব্যাখ্যায় বা অনুরূপ কোন সমস্যার সমাধানেও কার্যকরী হয়। জানার মূলে আছে প্রশ্ন, প্রশ্ন করা মানেই উত্তর খোঁজা। সেদিক থেকে বলা চলে আমাদের জীবনটাই এক বিজ্ঞান। কারণ আমাদের শরীরের সবই চলে বিজ্ঞানের নিয়মে, আমাদের প্রতিটি কাজ সেটাও হয় সেই বিজ্ঞানের নিয়মেই। শুধু কেউ সেটা বোঝে, কেউ সেটা না বুঝেই করে যায়। আমার মনে পড়ে ছবি তোলার প্রথম দিনগুলির কথা। আমি ছবি তুলতে শুরু করি ১৯৮৩ সালে রাশিয়ায় এসে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার নেই এ ব্যাপারে। বিভিন্ন আর্টিস্টদের ছবির এ্যালবাম ছিল ঘরে। সেসব দেখেই ছবির কম্পোজিশনের আইডিয়া গড়ে ওঠে। ২০০৫ সালে দুবনায় যখন ফটোগ্রাফারদের সাথে আলাপ হল আর ওরা ছবি কম্পোজিশনের নিয়ম কানুন বলতে শুরু করল, দেখলাম আমি নিজেও সেসব মেনে চলতাম, শুধু নাম জানতাম না। এভাবেই সেই আদি কাল থেকেই মানুষ না জেনেই বিজ্ঞানের নিয়ম কানুন মেনে জীবন যাপন করেছে। অক্সিজেন আবিষ্কার করার আগেও তার অস্তিত্ব ছিল, যেমন অস্তিত্ব ছিল আরও অনেক কিছুর। যেমন ধরুন মানুষ উপাসনার আগে হাত পা ধুয়ে নেয়। সে এটা করে একান্তই ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে বিজ্ঞান যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মানে হাইজেনের কথা বলে সেটা পালন করে। অথবা ধরুন মানুষের প্রথম কৃষিকাজ, প্রথম সেচ ব্যবস্থা – এসবই বিজ্ঞান, যদিও তারা কোন প্রতিষ্ঠান থেকে এসব শিখে করেনি। জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাদের বাধ্য করেছে সেই পথে যেতে যাকে আজ আমরা বলি বিজ্ঞান সম্মত।

মানুষ মাত্রই বিভিন্ন ধরণের পরস্পরবিরোধী চিন্তাভাবনা দ্বারা আক্রান্ত। কীভাবে? একই মানুষ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন ধরুন ঘর তৈরি করতে দরকার মেঝে বা ফ্লোর, দেয়াল আর ছাদ বা চাল। এটা যেকোনো ঘরের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু আপনি যদি রাশিয়ায় ঘর তৈরি করেন তাহলে এখানকার শীতের কথা ভাববেন, জাপানে করলে সেখানকার সিসমিক অবস্থা, বাংলাদেশে করলে সেখানকার আর্দ্রতা আর গরম আবহাওয়া এসব পরিবেশ পরিস্থিতি মাথায় রাখবেন। প্রায় প্রতিটি মানুষ, হোক সে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত – বিভিন্ন দেশের ক্লাইমেট হিসেবে নিয়েই ঘর তৈরি করে। সেটা না করলে চার দেয়ালের ঘর হয়তো পাবেন, কিন্তু সেটা কতটুকু কাজে লাগবে সেটা বলা কষ্ট। গণিতে অনেক সমীকরণের সাধারণ সমাধান আছে। এখানে চার দেয়াল, মেঝে,  ছাদ – এটা সাধারণ সমাধান। কিন্তু সেই সাধারণ সমাধান তখনই কার্যকরী হয় যখন তা ইনিশিয়াল ও বাউন্ডারী কন্ডিশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। যেহেতু আমাদের সবই স্থান ও কালের উপর নির্ভরশীল তাই এই দুই ধরণের কন্ডিশন। এখন যে মানুষ এসব বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে ঘর তৈরি করে সেই মানুষই অন্য দেশে রাশিয়া বা চীনের স্টাইলে বিপ্লব করতে চায়, আমেরিকা বা ব্রিটেনের মত করে পুঁজিবাদ বা গণতন্ত্র গড়তে চায়। আবার এই মানুষই বাংলাদেশের গরমে আরব দেশের পোশাক পরতে চায়, যদিও আরবের পোশাক ইসলামের আগেও ছিল আর সেটা ধর্মীয় নয়, মরুভূমির আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয়েছিল। তাহলে আমরা কি দেখছি? একই মানুষ বিভিন্ন প্রশ্নে একদিকে যেমন বিজ্ঞান সম্মত পথে চলছে অন্য দিকে তেমনি অন্ধবিশ্বাসের পথ বেছে নিয়েছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১৮): যুদ্ধের অনির্বাণ শিখা -বিজন সাহা

আবার অন্য দিক থেকে পর্যালোচনা করলেও দেখব শিক্ষিত – অশিক্ষিত, ধার্মিক – নাস্তিক – আমরা সবাই জীবনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিজ্ঞান ভাবনা দ্বারা চলি। কীভাবে? বিজ্ঞানের মূল কথা কী? প্রশ্ন করা। আমরা কেন প্রশ্ন করি? যাচাই বাছাই করার জন্য। অর্থাৎ আমাকে যা দেয় সেটা নেবার আগে জানতে চাই এটা ভালো কি না, এর চেয়ে ভালো কিছু আছে কিনা বা পাওয়া যায় কি না। আপনি বাজারে গিয়ে জিনিস বাছাই করেন, ব্যবসা করতে গিয়ে ভাবেন কোন ব্যবসা লাভজনক, জামাকাপড় কিনতে গিয়ে বার বার দেখেন কোন রঙটা আপনাকে মানায়। আবার এই আপনিই ধর্মের এই অনুশাসন আপনার বা মানুষের জন্য বর্তমানে কতটুকু মঙ্গলকর সেটা ভাবতে চান না, যেহেতু মার্ক্স বলেছেন বা বেদে বা কোরআনে বা বাইবেলে লেখা আছে – সেটা চোখ বুজে বিশ্বাস করেন। এর মানে হল আমাদের সবার মধ্যেই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা বিদ্যমান – তা সে শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক। কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্নে আমরা অন্ধের মত কোন মত বা পথ গ্রহণ করি। তাই সমস্যা আমদের মধ্যে। এটা মনে হয় ইনহেরেন্ট। সোভিয়েত আমলে আমি দেখছি, আমার সোভিয়েত বন্ধুরা, যারা এথেইস্ট ছিল তারাও লেনিনকে প্রায় ঈশ্বরের মত মনে করত। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনায় কোনায় লেনিনের স্ট্যাচু দেখে আমি বলতাম সোভিয়েত শিব লিঙ্গ। আমার মতে কোন কিছুতে অন্ধবিশ্বাসই মৌলবাদ – তা সে আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মার্ক্সিজমে বিশ্বাস করেন আর বিজ্ঞানে বিশ্বাস করেন।

বিজ্ঞানে শেষ কথা বলে কিছু নেই, আছে অনবরত সামনে চলা, একটু একটু করে পরম সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এটা ক্যাল্কুলাসের লিমিটের মত, যদি অনন্ত কাল ধরে আপনি চলতে থাকেন তাহলে সেখানে পৌঁছুতে পারবেন। আসল কথা প্রতিনিয়ত উৎকর্ষ সাধন করা। একজন মানুষও তো তাই চায়। সে চায় আগামীকাল আজকের চেয়ে একটু হলেও ভালো থাকতে, আগামীকাল আজকের চেয়ে একটু বেশি জানতে। এটাই তো বিজ্ঞানের পথ। তারপরেও বেশির ভাগ মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক নয়। কেন? বিজ্ঞান পরমতসহিষ্ণু এই অর্থে যে একজন সত্যিকারের বিজ্ঞানী ভিন্ন মত গ্রহণ করুক বা না করুক সেই মতটা শোনে, এরপরে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বা ধারণার ভিত্তিতে সেটা গ্রহণ বা বর্জন করেন। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষ অন্যের কথা পর্যন্ত শুনতে রাজী নই সেটা গ্রহণ করা তো দূরের কথা। আবার আমরা অনেকেই বিজ্ঞানকে একমাত্র পথ বলে মনে করি। এটা ঠিক আমাদের জীবনে বিজ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তবে মানুষ শুধু ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডে বাস করে না, তার একটা মনোজগতও আছে। সেটা কি কম গুরুত্বপূর্ণ? দুটো উদাহরণ দিই। ভ্লাদিমির গেরত নামে আমার একজন কলিগ ছিলেন, করোনায় মারা গেছেন। খুবই নামকরা স্পেশালিষ্ট, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর উপর কাজ করতেন। মাঝে মধ্যে আমরা কাজ থেকে একসাথে বাসায় ফিরতাম, পাশাপাশি অফিস বলে মাঝমধ্যে ভুল করে একে অন্যের অফিসে ঢুকে পড়তাম। উনি প্রায়ই আমাকে অনুযোগ করে একটা কথা বলতেন। কয়েকদিন আগে ৯২ বছর বয়সী গেনাদি আসোসকভ একই কথা বললেন। «বিজন, তোমার এত সম্ভাবনা, এত মেধা  ছিল, আছে, কিন্তু তুমি মনে হয় সেটা ঠিকমত কাজে লাগাচ্ছ না।» আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। «এই যে তুমি ফটোগ্রাফি করে এত সময় নষ্ট কর, সে সময়টা ফিজিক্সের কোন সমস্যা সমাধান করলে আরও এগিয়ে যেতে পারতে।» কথা হল ফটোগ্রাফি আমার ফিজিক্স করার একটা অংশ, আমি ফটোগ্রাফি করে যে আনন্দ পাই সেটা আমাকে ফিজিক্স করার অনুপ্রেরণা যোগায়। কথাটা এ জন্যে বলা বিজ্ঞানে কোন সহজ পথ নেই। আমার এক কলিগ পেস্তভ একবার বলেছিলেন, “বিজ্ঞান তো আর কাঠ কাটা নয়, কুড়ুল চালালে আর কাজ শেষ।» আমার মনে হয় আমরা প্রায়ই এই বহুমুখিতা ভুলে যাই, আর খুব সরল করে দেখতে গিয়ে বিজ্ঞানকেও ধর্মে পরিণত করি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো