শিল্প সাহিত্য

ভ্যাম্পায়ার গ্রাম

— রাজেশ তালুকদার 

রাজেশ তালুকদার  (ফাইল ছবি)
আমাদের দেশের গেছো, মেছো, সর্ষ্য ভুত কিংবা প্রেত্নীর মত ইউরোপের মানুষদের কাছে রক্ত চোষা ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ারের গল্প চর্চিত হয়ে আসছে  সুদীর্ঘ হাজার বছর ইতিহাসের পাতা ভর করে। ব্রাম স্টোকারের “ড্রাকুলা” এর কারণে ভ্যাম্পায়ার ধারণাটি কুসংষ্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনো জগতে আলোচিত প্রভাব বিস্তারে অশেষ ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। তার ভাবনার প্রভাবেই অনেকে প্রভাবিত হয়ে ভেবে থাকেন ইউরোপের রোমানিয়াতেই প্রথম ভ্যাম্পায়ার ধারণার উৎপত্তি। কিন্তু নিরেট সত্য হল রোমানিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ সার্বিয়ার কিসিলজেভো গ্রামে প্রথম ভ্যাম্পায়ারের কবরের অস্তিত্বের কথা দাবি করা হয়। যেখানে ভ্যাম্পায়ার দিবালোকে কফিনে লুকিয়ে নিদ্রা যায় আর রাত্রিকালে মানুষের রক্ত পান করতে নিশাচারী হয়।
কিসিলজেভো হল সার্বিয়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। প্রায় ৮০০ লোকের বাস সেখানে। ফ্রেড ভার্গাস রচিত “আন আনসারটেন প্লেস” উপন্যাসে কিসিলজেভোকে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হিসাবে তুলে ধরতে দেখা যায়। এই গ্রামটি বিখ্যাত হয়ে আছে পেটার ব্লাগোজেভিচের কারণে।
এই গ্রামে এক দ্ররিদ্র কৃষক পরিবারে পেটার ব্লাগোজেভিচর জন্ম। তাঁর জন্ম সালটা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই কিন্তু মৃত্যু সালটা সালটা লেখা আছে ১৭২৫।
তাঁর মৃত্যু সালটা অতি প্রাকৃতিক এক বিশেষ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে লিপিবদ্ধ হয়। পেটার ব্লাগোজেভিচর মৃত্যু পরবর্তী কিছু দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে যায় ভয়ার্ত যম দূত রক্ত চোষা ভ্যাম্পায়ারের নাম। লিপিবদ্ধ ময়না তদন্ত থেকে জানা যায় পেটার ব্লাগোজেভিচের মৃত্যুর ৮ দিনের মাথায় তাঁর গ্রামে রহস্যজনক ভাবে আরো ৯ জন লোকের অকাল প্রয়াণ ঘটে। আশ্চর্যজনকভাবে এই ৯ জন ভুক্তভোগী প্রত্যেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে করুণ সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন তাদেরকে নির্মম ভাবে শ্বাসরোধ করে গেছে পেটার ব্লাগোজেভিচ।
গ্রামবাসীর মনে এই ভয়ঙ্কর অপ মৃত্যুগুলোর পিছনে পেটার ব্লাগোজেভিচের হাত নিয়ে বিশ্বাসে আরো শক্ত ভিত জুগিয়েছে পেটার ব্লাগোজেভিসের স্ত্রী স্বয়ং। তিনি গ্রামবাসীদের বলেছেন মৃত্যুর পর পেটার ব্লাগোজেভিচ এসে তাঁর সাথে দেখা করেছেন এবং তাঁকে পেটারের প্রিয় জুতো জোড়া দিতে বলেছিলেন !!
মৃত্যুর পর পরপার থেকে আবার ফিরে এসেছে !! সাক্ষী হিসাবে ঘরের বিশ্বস্ত লোক পাওয়া গেছে !! প্রমাণে ঘাটতির দ্বিধা আর কিসে !!
ব্যাস, দুয়ে দুয়ে চার। সমস্ত গ্রাম ভয় আর আতঙ্কের ছত্রছায়ায় আচ্ছন্ন।
বাড়ি থেকে একা বের হয়ে একটু যে হিসু করবে সে সাহসও উবে গেছে সবার। পিটারের সাথে জীবদ্দশায় যারা তাঁর সাথে বিবাদে জড়িয়েছিলেন তাদের অবস্থা তো হল আরো ভয়ানক। মৃত্যু ভয় তাদের হৃদয় জুড়ে মুদ্রার অপর পিঠের মত সঙ্গী হয়ে আছে।
পেটারের স্ত্রী পেটারের সাথে অভাবের কারণে প্রচুর বিবাদে জড়িয়ে ছিলেন পেটারের আয়ুষ্কালে। দুঃস্বপ্নময় সেই স্মৃতির পাতা ফুঁড়ে সে সব কথা মনে ঘাই গুই শুরু করলে পিটারের স্ত্রী নিজেই গ্রাম ছেড়ে হন অজানার উদ্দেশ্যে লাপাত্তা !!
গ্রাম বাসীদের মুখে মুখে আরো একটি গল্প জোরদার প্রচার পায়। ক্ষুধার্ত পিটার একদিন তার ছেলের কাছে কিছু খাবার চায় কিন্তু ছেলে তা দিতে অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পিটার ছেলেকে কামড়িয়ে নির্মম ভাবে যমালয়ে পাঠায়। এরপর ছেলের সমস্ত রক্ত পান করে।
আর কি সন্দেহের দানা টুকু অবশিষ্ট থাকার সামান্য অবকাশ থাকে!! মোটেই, না।
গ্রামের ছেলে বুড়ো যুবক সবাই একবাক্যে ভয় ও আতঙ্কে জুবুথুবু  হয়ে বলে বেড়াতে থাকল পেটার একজন ভ্যাম্পায়ার !! এখন উপায় !!
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে প্রচলিত বিশ্বাস থেকে তারা দিনের বেলায় কফিনে ঘুমায়।
আতঙ্কগ্রস্থ ভয়ার্ত গ্রামবাসী জড়ো হয়ে একদিন সিদ্ধান্ত নিল পেটারের মৃত দেহ দিনের বেলা কবর থেকে তুলে কফিন খুলে দেখা হোক। কিছু সাহসী যুবক মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে এগিয়ে এল। কফিন খুলতেই সবার চোখ চড়ক গাছ !!
একি !! ঠোট জুড়ে রক্তের দাগ মাখানো !! মৃত দেহ এখনো তাজা !! আর মুখমণ্ডল জুড়ে তাজা দাড়ি মোছে একাকার !! আঙ্গুলের নখগুলো ইয়া লম্বা লম্বা। দেখে প্রতীয়মান এখনো বাড়ছে !!
গা ছমছম করা প্রচন্ড ভীতিকর, অকল্পনীয়, অদ্ভু্‌ত, একেবারেই অতিপ্রাকৃ্তিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে সবাই আতঙ্কে মূর্ছা যায় যায় অবস্থা। তার উপর আছে যখন তখন পেটারের জেগে উঠার ভয় !!
ভীত গ্রামবাসীরা এই সব দেখে তড়িঘড়ি করে স্থানীয় ধর্মীয় যাজক ও তৎকালীন হ্যাবসবার্গ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি ফ্রমবাল্ডকে সেখানে হাজির করেন। যিনি ছিলেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। একটি প্রচলিত বিশ্বাস ভ্যাম্পায়ার হত্যার  অন্যতম উপায় হৃদপিন্ড বরাবর আঘাত হানা। তবেই ভ্যাম্পায়ার কাবু হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
সে লক্ষ্যে শুরু হল পিটারের হৃদপিন্ড বরাবর বিষ্ফোরক বসানোর পালা সাথে যাজকের মন্ত্র জব। কম্পমান হস্তে হৃদপিন্ডে যখন বিষ্ফোরক বসানোর প্রক্রিয়া চলছিল বিস্ময়কর ভাবে তখন তার মুখ ও কান দিয়ে গলগল করে তাজা রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়েছিল অনেক দূর।
এভাবে আগুনের শিখায় বাষ্পীভূত করা হয় পেটারের তাজা হৃদপিন্ড।
পেটার ভ্যাম্পায়ার হত্যার পর সেই গ্রামে আর কোন দুঃসংবাদের মুখোমুখি হয়নি, আর কোন অপমৃত্যুর খবর রটে নি।
রোমাঞ্চকর এই মামলাটিকে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অতিপ্রাকৃত ঘটনার অনন্য নজির রূপে ভ্যাম্পায়ার হিস্ট্রির ইতিহাসে একটি কালো নথিভুক্ত, রহস্যময় এবং অনুদ্ধঘাটিত মামলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ভ্যাম্পায়ার হত্যার লোমহর্ষক এই ঘটানার ইতিহাস পৃথিবীবাসি জানতে পারে ফ্রমবাল্ড এর লিখিত দালিলিক প্রমাণের কল্যাণে।
ভ্যাম্পায়ারের ভয় কিছু কিছু  কিসিলজেভোবাসীকে এখনো নাকি তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক লোকজন সেখানে এখনো ঘরের দরজায় এবং জালানার ফাঁকে রসুন গুজে আগামী ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখে।
(টিপস- আপনি যদি সার্ভিয়ার কিসিলজেভো গ্রামে কখনো ভ্রমণে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে বগল দাবা করে রসুন রাখতে ভুলবেন না। আমি কিনে রেখেছি। এতে রসুনের দাম বেড়ে গেলে লেখক দায়ী নহে😀😀 )
# রাজেশ তালুকদার, (ইটালী প্রবাসী