আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় স্থানান্তর পরিকল্পনা ‘বেআইনি’: ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট
বুধবার (১৫ নভেম্বর) দেশটির শীর্ষ আদালতের পাঁচ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আলোচিত এই মামলার রায় দেন৷ বিতর্কিত এই মামলাটি বছরজুড়ে ইউরোপীয় রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল৷
আদালতের রায়ে বলা হয়, ‘‘এই পদক্ষেপের ফলে আশ্রয়প্রার্থীরা ‘দুর্ব্যবহারের প্রকৃত ঝুঁকিতে’ থাকবেন৷ কারণ তাদের একবার রুয়ান্ডায় পাঠানো হলে সেখান থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা থাকবে৷’’
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের একটি নিম্ন আদালত রুয়ান্ডাকে নিরাপদ তৃতীয় দেশ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না বলে দেশটিতে অপসারণের নীতি ‘বেআইনি’ বলে রায় দিয়েছিল৷ পরবর্তীতে একই রায় বহাল রেখেছিল হাইকোর্ট৷
শেষ পর্যন্ত বর্তমান রক্ষণশীল সরকার রুয়ান্ডা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে আপিল আবেদন করেছিল৷
আপিল আদালতের দেয়া পূর্বের সিদ্ধান্তের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের প্যানেল বলেন, ‘‘আমরা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত৷ আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকারের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রুয়ান্ডায় ‘সত্যিকারের ঝুঁকি’ আছে৷’’
এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের আদালতের দেয়া চারটি রায়ের মধ্যে তিনটি রায়ে বলা হয়েছে, রুয়ান্ডা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়৷ কারণ দেশটির আশ্রয়ব্যবস্থার মধ্যে ‘গুরুতর ঘাটতি’ রয়েছে৷ আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রেও আদালত জানিয়েছে, সেখানে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন৷
কি ছিল পরিকল্পনায়?
বছর খানেক আগে আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ দেশে না রেখে ‘তৃতীয় নিরাপদ দেশে’ স্থানান্তরে রুয়ান্ডার সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাজ্য৷ এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাইতে আসা ব্যক্তিদের রুয়ান্ডায় পাঠিয়ে তাদের আবেদন যাচাই-বাছাই করতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার৷
সরকারের যুক্তি ছিল, এর মধ্য দিয়ে মানবপাচারকারীদের তৎপরতা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে৷
ব্রিটেন ইতিমধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নে রুয়ান্ডাকে ১৪ কোটি পাউন্ড অর্থ দিয়েছে৷ তবে, আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখানে একজন অভিবাসীকেও পাঠাতে পারেনি তারা৷ এর আগে, গত ডিসেম্বরে ব্রিটেনের হাইকোর্ট এক রায়ে জানিয়েছে, সরকারের অভিবাসী স্থানান্তর নীতিটি আইনি এবং জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি বিরোধী নয়৷
কিন্তু ইরাক, ইরান এবং সিরিয়া থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যাদের রুয়ান্ডায় পাঠাতে সরকার উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাদের অনেকে আবারো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন৷ তারা দাবি করেন, সরকারের এই পরিকল্পনাটি ‘পদ্ধতিগতভাবে অন্যায্য’ এবং আশ্রয়প্রার্থীরা সেখানে নিরাপদ নন৷
বরখাস্ত সুয়েলা ব্রাভারম্যান
কট্টর অভিবাসন বিরোধী হিসেবে পরিচিত সাবেক ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান নিম্ন আদালতের রায়ের পর দাবি করেছিলেন, ‘‘বিদ্যমান আশ্রয়ব্যবস্থা ইউরোপে অর্থনৈতিক অভিবাসনপ্রবাহকে উৎসাহিত করে, পাচারকারীদের পকেটে অর্থের যোগান দেয়, আর আমাদের সমুদ্রকে কবরস্থানে পরিণত করে৷ আর সবকিছুই হয় মানবতাবাদের ধোঁয়া তুলে৷’’
চলতি সপ্তাহে মন্ত্রিসভার রদবদলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন আলোচিত এই রাজনীতিবিদ৷ সোমবার তার পরিবর্তে দায়িত্ব পেয়েছেন জেমস ক্লেভারলি৷
মন্ত্রী পদ হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সুয়েলা ব্র্যাভারম্যান৷ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ব্রিটিশ জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন৷’’
রায়ের প্রতিক্রিয়া
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রুয়ান্ডা সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘রুয়ান্ডা আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ তৃতীয় দেশ নয় বলে আদালতের দেয়া রায় আমরা সন্তুষ্ট নই৷ কারণ শরণার্থীদের প্রতি আমাদের অনুকরণীয় আচরণের জন্য আমরা ইউএনএইচসিআর এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে স্বীকৃতি পেয়েছি৷ তবে এটি যুক্তরাজ্যের বিচার ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত৷’’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে৷
সুনাক এর আগে বলেছিলেন, ‘‘ছোট নৌকায় চ্যানেল জুড়ে ‘অনিয়মিত অভিবাসন’ কমাতে এই স্কিমটি প্রয়োজন৷’’
২০২৪ সালের প্রত্যাশিত যুক্তরাজ্যের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অভিবাসন সংস্থা রিফিউজি কাউন্সিল জানিয়েছে. ‘‘এটি নিরাপদ থাকতে চান এমন পুরুষ, নারী এবং শিশু আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকারের পক্ষে একটি বিজয়৷ সরকারের উচিত একটি কার্যকরী, ন্যায্য ও মানবিক আশ্রয় ব্যবস্থা তৈরি করা এবং নিয়মিত অভিবাসনের নিরাপদ রুট সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করা৷’’
# এমএইউ/টিএম