মতামত

ভারতে বাংলা ভাষা আন্দোলন-৪

-ইকবাল সরোয়ার সোহেল

ইকবাল সরোয়ার সোহেল (ফাইল ছবি)

আন্দোলন: মানভূম জেলার বাংলাভাষী মানুষদের ক্ষোভ আঁচ করে জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র মুক্তি পত্রিকায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ হিন্দী প্রচার, বাংলা ভাষাভাষীদের বিক্ষোভ ও মানভূম জেলার বঙ্গভুক্তির যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি বিবেচনার জন্য ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে জেলা কমিটির অধিবেশন হলে সেখানে প্রতিনিধিদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। ঐ বছর ৩০শে মে পুরুলিয়া শহরের অধিবেশনে মানভূমের বঙ্গভুক্তির প্রস্তাব ৫৫-৪৩ ভোটে খারিজ হয়ে গেলে অতুলচন্দ্র ঘোষ সহ সাইত্রিশজন জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুন পাকবিড়রা গ্রামে লোক সেবক সংঘ তৈরী করেন। বিহার সরকার বাংলাভাষীদের প্রতিবাদসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করলে মানভূম জেলায় আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। লোকসেবক সংঘ বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার দাবিতে মোট তিনটি আন্দোলন পরিচালনা করেছিল, যেগুলি হল ক) ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সত্যাগ্রহ আন্দোলন, খ) হাল জোয়াল সত্যাগ্রহ এবং গ) ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জানুয়ারি থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

সত্যাগ্রহ আন্দোলনঃ ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ এই সময়ে আন্দোলন দমনের জন্য বিহার সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। আন্দোলনের প্রধান মুখ অতুলচন্দ্র ঘোষকে বন্দি করা হয়, এবং ১৩৫ মাইল দূরের হাজারীবাগ জেলে পাঠানো হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়া হাজারো বাংলাভাষী আন্দোলনকারীকে কারাগারের প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। বিচারাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাঘব চর্মকার।

হাল জোয়াল সত্যাগ্রহঃ

বিহার সরকার অন্দলন আন্দোলন দমনে আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। হাটে-বাজার ও সমস্ত প্রকাশ্য যায়গায় হাল, জোয়াল ও মই ইত্যাদি কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদ হিসাবে লোকসেবক সংঘ চাষীদের স্বার্থে প্রকাশ্য স্থানে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রি করতে শুরু করার কর্মসূচি নেয়, যা হাল জোয়াল সত্যাগ্রহ হিসাবে পরিচিতি পায়।

টুসু সত্যাগ্রহঃ ১৯৫৪ – বাংলা ভাষার দাবিতে লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ শুরু হলে সত্যাগ্রহীদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। ঝালদা, পুরুলিয়া ও সাঁতুরির জনসভায় পুলিশ লাঠিচার্জ ও মহিলানেত্রীদের উপর অকথ্য নির্যাতন করে, ফলে সাধারণ জনগণ ক্ষোভে ফেটে পরে। তারা মানভূমের নিজস্ব গান, টুসু গানকে কেন্দ্র করে ৯ই জানুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ শুরু করেছিল। এই সত্যাগ্রহ চলেছিল তিনটি পর্যায়ে। টুসু সত্যাগ্রহের প্রথম পর্যায় ৯ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যায় ২০ থকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং তৃতীয় পর্যায় ২৭ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল।

হেমচন্দ্র মাহাতোর নেতৃত্বে ৯ জানুয়ারি রঘুনাথপুরে লোক সেবক সংঘের সদস্যরা শহর পরিক্রমা শুরু করেন। বিহার সরকার নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে ৮ আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। ১১ জন আন্দোলনকারী ১০ জানুয়ারি টুসু গান গাওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। অতুলচন্দ্র ঘোষ ১২ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের সরকারি বাধা উপেক্ষা করে টুসু গানে পুরো মানভূমকে মুখরিত করার নির্দেশ দেন। এরপরই মানভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে টুসু সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে পরে। বিহার সরকার তখন আন্দোলন কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া শুরু করে, যার প্রতিবাদে ২২শে জানুয়ারি লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ও ভজহরি মাহাতো, ২৫শে জানুয়ারি সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, কালীরাম মাহাতো ও ভাবিনী দেবী স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন।[৮]

নানা ছন্দে, বর্ণে প্রোথিত প্রতিবাদী টুসু লোকগানগুলো হয়ে ওঠে প্রবল জনপ্রিয়। কৃষক, দিনমজুর থেকে শুরু করে সব পেশার মানুষের গানে প্রকাশ পায় প্রতিবাদের সুর। এর মধ্যেই বিহার পুলিশ ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে টুসু দলের ৪০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করেছিল। অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্য প্রভা ঘোষ, ভজহরি মাহাতোসহ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পুলিশ ১১ মার্চ মধুপুর গ্রামের লোক সেবক সংঘের অফিস ভাঙচুর করে, এবং প্রচুর টুসু গানের বই বাজেয়াপ্ত করে। এছাড়া, সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ২১শে মার্চ মানবাজারের পিটিদারী গ্রামে সত্যাগ্রহীদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। মানভূমের বাঙালিদের বিরুদ্ধে চালানো হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার।

পড়ুন:  ভারতে বাংলা ভাষা আন্দোলন-৩ -ইকবাল সরোয়ার সোহেল

এই সময় বেশ কয়েকটি টুসু সঙ্গীত জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তার মধ্যে একটি হল,

“শুন বিহারী ভাই

তোরা রাখতে লারবি ডাঙ দেখাই

তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি

বাংলা ভাষায় দিলি ছাই৷”

পদযাত্রা: ১৯৫৬ – পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং ১৯৫৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার উভয় রাজ্যের সংযুক্ত করে পূর্বপ্রদেশ নামে এক নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাবনা করেন। প্রস্তাবে তারা বলেন, প্রদেশের কেন্দ্রীয় ভাষা হবে বাংলা ও হিন্দি। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা ছাড়াও বামপন্থী দলগুলিও প্রতিবাদ করেন। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্যে বিহার বিধানসভায় ২৪শে ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়।

লাবণ্যপ্রভা দেবী ও অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ২০ এপ্রিল ১৯৫৬ হাজারো মানুষ মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা ও পূর্বপ্রদেশ গঠনের বিরোধিতা করে পদযাত্রা শুরু করে। এই পদযাত্রা পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রামে শুরু হয়, এবং কলকাতায় সমাপ্ত হয়। পদযাত্রায় সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল হাজারো জনগণ। মানভূমের টুসু গান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানে কম্পিত হাজারো সত্যাগ্রহী ও জনতার মিছিল কলকাতা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। টানা ১৭ দিনে পাকবিড়রা গ্রাম থেকে বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খন্ডঘোষ, বর্ধমান, পান্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, শ্রীরামপুর, হাওড়া হয়ে ৩০০ কিলোমিটার পদযাত্রা শেষে ৬ই মে সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে হাজারো জনতার মিছিল কলকাতায় এসে পৌঁছায়। কলকাতায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার করে। সত্যাগ্রহীদের দ্বারা ৭ মে মহাকরণ অবরোধ করা হয়, এবং ৯৬৫ জন স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। প্রায় ১২ দিন কারাগারে আটক থাকার পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তিঃ এই আন্দোলনের ফলে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর ভারত সরকার সৈয়দ ফজল আলির সভাপতিত্বে, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু ও কবলম পানিক্করকে নিয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরী করে। এই কমিশন ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে মানভূম জেলায় তদন্ত করে ঐ বছর ১০ই অক্টোবর তাদের বক্তব্য জমা দেন। তাদের বক্তব্যে মানভূম জেলা থেকে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা নামে এক নতুন জেলা তৈরী করার প্রস্তাব দেন। তারা মানভূম জেলা থেকে ধানবাদ মহকুমার ১০টি থানা ও পুরুলিয়া মহকুমার ২টি থানা বিহার রাজ্যে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। অপরদিকে ধলভূম পরগণায় বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্বীকার করেও যেহেতু ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ ঐ জেলায় বসবাস করেন সেই কারণে কমিশন জামসেদপুরকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে বা ধলভূম পরগণা ভেঙ্গে বাংলায় আনতে রাজি ছিলেন না। এই প্রস্তাবে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ থেকে ২০শে জুন বিহারপন্থীরা মানভূম জেলায় ধর্মঘটের ডাক দেন। অপরদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীরা ধানবাদ বিহারের অন্তর্ভুক্তিতে খুশি ছিলেন না।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই আগস্ট বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল লোকসভায় ও ২৮শে আগস্ট রাজ্যসভায় পাশ হয়। ১লা সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন। এর ফলে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর ২৪০৭ বর্গ মাইল এলাকার ১১,৬৯,০৯৭ জন মানুষকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়া তৈরী হয়। সম্পূর্ণ ধানবাদ মহকুমা বিহার রাজ্যে রয়ে যায়।