মতামত

কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অংশীজনদের দায়িত্ব

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

প্রতি বছর, ২৮শে এপ্রিল, বাংলাদেশ সরকার কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস পালন করে। এই দিবসটি সকল শ্রম খাতে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজন তথা নিয়োগকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারী, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ভোক্তা প্রত্যকে নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরিতে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা শুধু একটি আইনী প্রয়োজনীয়তা নয়; এটা একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা। নিয়োগকর্তা, কর্মচারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং এমনকি ভোক্তাদের, কর্মক্ষেত্রগুলি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করতে হবে।

নিয়োগকর্তার দায়িত্বঃ

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা অগ্রগণ্য। তাদের কর্মীদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদান করার আইনগত এবং নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নিম্নে তাদের প্রধান কিছু দায়িত্বের বিষয় আলোচনা করা হলো:

১) ঝুঁকি মূল্যায়ন: কর্মক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ শনাক্ত করতে নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই নিয়মিত ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হবে। এরমধ্যে রয়েছে শারীরিক বিপদ যেমন ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি, সেইসাথে জৈবিক ও রাসায়নিক বিপত্তি।

২) নিরাপত্তা নীতি এবং পদ্ধতি: নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই ব্যাপক নিরাপত্তা নীতি এবং পদ্ধতিগুলি বিকাশ এবং প্রয়োগ করতে হবে। এগুলি জরুরী স্থানান্তর পরিকল্পনা থেকে যথাযথ সরঞ্জাম ব্যবহার পর্যন্ত সমস্ত কিছুকে কভার করা উচিত।

৩) প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা: নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা প্রদান করতে হবে। কীভাবে নিরাপদে সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে বিপদ সনাক্ত করতে হবে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়গুলো প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৪) সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা: নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই তাদের কর্মীদের নিরাপদে কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন হেলমেট, গ্লাভস এবং গগলস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

৫) নিয়মিত পরিদর্শন: নিরাপত্তার মান পূরণ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায় ভবনের অবকাঠামোর ত্রুতি, কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রের ত্রুতি, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ত্রুটি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় সমূহ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম কারন। সুতরাং পরিদর্শনের সময় উপরোক্ত বিষয় সমূহ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।

শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়িত্ব:

যদিও একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ প্রদানের আইনগত বাধ্যবাধকতা প্রধানত নিয়োগকর্তাদের, তথাপি শ্রমিক-কর্মচারীদেরও তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং তাদের সহকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়িত্ব সমূহ নিম্নরূপঃ

১) নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসরণ করা: কর্মচারীদের অবশ্যই তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমস্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিমালা ও নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সুরক্ষা সরঞ্জামগুলি সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিগুলির জন্য সঠিক অপারেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করা।২) ঝুঁকি ও বিপদ সম্পর্কে মালিক পক্ষকে অবহিত করাঃ শ্রমিক-কর্মচারীদের ঝুঁকি ও বিপদ সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্রে কোন অবকাঠামোগত, বৈদ্যুতিক কিংবা অগ্নি ঝুঁকি নজরে আসলে তা সাথে সাথেই মালিক পক্ষকে অবহিত করে তা দ্রুত সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্বেগ জানাতে হবে।৩) প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা: কর্মচারীদের অবশ্যই তাদের নিয়োগকর্তা দ্বারা প্রদত্ত যেকোন নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হবে। প্রশিক্ষণে কীভাবে নিরাপদে সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। ৪) ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া: প্রত্যেক শ্রমিক-কর্মচারীদের অবশ্যই তাদের নিজের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার যত্ন নিতে হবে যাতে তারা নিরাপদে কাজ করার জন্য উপযুক্ত থাকে। পর্যাপ্ত ঘুম, সুষম খাওয়া এবং মাদক ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা ইত্যাদি বিষয় সমূহ এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৫) সহকর্মীদের প্রতি নজর রাখাঃ শ্রমিক-কর্মচারিদের অবশ্যই তাদের সহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সহকর্মীদের কোন আচরনে নিরাপত্তা ঘাটতি পরিলক্ষিত হলে তা সাথে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে সহকর্মীদের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। ৬) ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্বেগ জানানোঃ নিরাপত্তা ইস্যু কোন একজন শ্রমিক-কর্মচারীর একক সমস্যা নয় বরং প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সমস্যা। তাই নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেকোন ইস্যুতে এককভাবে উদ্বেগ না জানিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্বেগ জানাতে হবে। এইজন্য শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে আইএলও কনভেশন ৮৭ ও ৯৮ অনুসরণ করে সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ থাকতে হবে।  নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমূহের দায়িত্বঃ শ্রম আইনের ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম এবং ৮ম অধ্যায়ে (ধারা ৫১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত ) শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যু সমূহ আলোচিত হয়েছে। এ বিষয় সমূহ বাস্তবায়নের দায়িত্ব মূলত শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপর বর্তায়। এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স ডিপার্ট্মেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সমূহেরও কর্মস্থলে নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রয়েছে। নিম্নে তাদের কিছু দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচিত হলোঃ

১) নিরাপত্তা সংক্রান্ত মান নির্ধারণ: প্রত্যেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের চাহিদা মোতাবেক  কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানের মান নির্ধারণ করবে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিবে। এই মান নির্ধারনের উদ্দেশ্য হবে  শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়োগকর্তা যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া।

২) আইন প্রয়োগঃ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা মান প্রয়োগের জন্য দায়ী থাকবে৷ নিরাপত্তার মান পূরণ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য কর্মক্ষেত্রের পরিদর্শন করা এবং আইন মেনে চলতে ব্যর্থ নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব।

৩) নির্দেশিকা প্রদান: কীভাবে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা মানগুলি পূরণ করতে হয় সে সম্পর্কে নিয়োগকর্তা এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের নির্দেশিকা এবং সহায়তা প্রদান করা নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমূহের দায়িত্ব। এর মধ্যে সর্বোত্তম অনুশীলনের তথ্য প্রদান, প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং নির্দিষ্ট নিরাপত্তা উদ্বেগগুলিকে কীভাবে মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

ভোক্তার দায়িত্বঃ

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভোক্তাদেরও ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দেশে  কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে ভোক্তাদের ভূমিকা খুব একটা দৃশ্যমান না হলেও উন্নত বিশ্বে ভোক্তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অবশ্য ভোক্তারা সরাসরি কোন শিল্পে কাজ করে না তবে তাদের পছন্দ এবং কাজ কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ভোক্তাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে:

১) নিরাপদ পণ্যের চাহিদা: নিরাপদ কাজের পরিবেশে উৎপাদিত পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা থাকা উচিত। এর অর্থ হল কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয় এমন সংস্থাগুলির পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের সমর্থন থাকা এবং যেগুলি করে না তাদের এড়িয়ে চলা৷

২) নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটলে উদ্বেগ জানানো: যদি ভোক্তারা দেখতে পান যে, একটি পণ্য বা কোম্পানির সাথে সম্পর্কিত কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে সে সম্পর্কে যথাযথ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দ্রুত উদ্বেগ জানানো উচিত। এটি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং আঘাত প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।

৩) অ্যাডভোকেসি ও সামাজিক সংলাপের উদ্যোগ নেয়া: ভোক্তারা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার মান উন্নত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মালিক পক্ষের সংগঠন সমূহের সাথে অ্যাডভোকেসি ও সামাজিক সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে। এতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন ও প্রবিধানগুলিকে উন্নত করতে করা সম্ভবপর হয়।

উপসংহারে বলা যায়, কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা  বিধান করা প্রত্যেক অংশীজনের দায়িত্ব। নিয়োগকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং ভোক্তা প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে যেন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও আঘাত প্রতিরোধে আমরা ভূমিকা রাখতে পারি এবং আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, “জীবনের জন্য কাজ, কাজের জন্য জীবন নয়” সুতরাং কাজ শেষে শেষে প্রত্যেক শ্রমিক-কর্মচারীর নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা থাকা খুবই জরুরি।

(লেখকঃ কো-অর্ডিনেটর, ওশ সেন্টার, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প)