মতামত

আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের চেতনা: বাংলাদেশে শ্রম আইনের প্রয়োগ (১ম পর্ব)

-ড. মুহাম্মদ শাহীন চৌধুরী   

ড. মুহাম্মদ শাহীন চৌধুরী   (ফাইল ছবি)

 

মহান মে দিবস কেন পালন করা হয়

 বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের প্রতীকী হিসেবে মে মাসের প্রথম দিনটিতে মে দিবস পালিত হয় । মে দিবস  শ্রমজীবী মানুষদের কুর্নিশ জানানোর দিন, তাদের সংগ্রামকে স্বীকৃতির দিন ৷ শ্রমিকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর সারা বিশ্বে ১লা মে এই দিনটি পালন করা হয় ৷ তাই এই দিনটি শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবেও পালিত হয়। তবে এই দিবস পালনের পেছনে রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দী ও তার আগের শ্রমিকদের বঞ্চনার করুণ ইতিহাস। এই সংগ্রাম ও ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিনে। ইতিপূর্বে আমেরিকা জুড়ে কাজের ঘণ্টা কমানোর দাবিতে শ্রমিকরা সংগঠিত হচ্ছিল এবং দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ এবং দৈনিক ০৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার শ্রমিকরা দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়। শিকাগোর আন্দোলনরত শ্রমিকরা এই দিনে লাগাতার ধর্মঘটে শামিল হয়েছিল এবং শহরের হে মার্কেটে জড়ো হয়ে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া দীর্ঘদিনের অন্যায়-অবিচার ও বঞ্চনার প্রতিবাদে আওয়াজ তোলে ৷ সেই সময় একজন শ্রমিককে বাধ্যতামূলক ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হতো, বিনিময়ে পারিশ্রমিক ছিল খুবই সামান্য। সেই আন্দোলনের উত্তপ্ততায় পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ে ১০ থেকে ১২টি তাজা প্রাণ। পুলিশসহ ওই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক।

সেইদিন শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার পাশাপাশি কন্ঠরোধের চেষ্টার নির্মম এক ইতিহাস তৈরি হয় । আমেরিকার শিল্প-মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন সারা ইউরোপ ও পুঁজিবাদী দুনিয়ায় প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে পরের বছর থেকে এই প্রতিবাদের বার্ষিকী পালন করার প্রস্তাব করা হয়। মূলত: সেখান থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের সূচনা হয়। ১৮৯০ সালের ১লা মে থেকে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে এবং হে মার্কেটের শহীদদের স্মরণে মে দিবস পালন শুরু হয়।  ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলনে প্রাণ হারানো সেই মানুষগুলোর স্মরণে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। নিজেদের অধিকার আদায়ে ইতিহাস সৃষ্টির এক নিদর্শন হিসেবে বিশ্বজুড়ে এই দিবস পালন করা হতে থাকে।

এরপর ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শিকাগোতে প্রতিবাদে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যথাঃ বিশ্বজুড়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়, ১লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা, এবং এইদিনে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করা। ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে শ্রমিকদের উপর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীকী দিবস হিসেবে রাশিয়ায় মে দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।  ১৯২০ সালে পরাধীন ভারতবর্ষে সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন All India Trade Union Congress (AITUC) গড়ে ওঠে। কাজের ঘণ্টা হ্রাস, বাঁচার জন্য মজুরি, কাজের নিরাপত্তা ও অন্যান্য দাবিতে ভারতবর্ষে সুতাকল, চটকল সহ বিভিন্ন সেক্টরে AITUC’র নেতৃত্বে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালের ১লা মে মাদ্রাজের সমুদ্রতটে শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেটিয়ার নেতৃত্বে শ্রমিকরা ভারতে প্রথম মে দিবসের পতাকা তুলেছিল ও ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি উত্থাপন করেছিল। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই এই দিনটি সরকারী ও বেসরকারিভাবে পালিত হয়। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে প্রতিবছর পালন করে বাংলাদেশ। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য ইস্যু—“শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ”।

শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য শ্রম অধিকারের মর্যাদা

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের একটি মহান তাৎপর্য রয়েছে, যা শ্রমিকদের অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য করা সংগ্রামের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। ঐতিহাসিক মে দিবসের ১৩৮ বছর পর আজও শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের কাজের মেীলিক অধিকার রক্ষার জন্য সারা দুনিয়ায় লড়াই-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নিম্নমজুরী, আয়ের বৈষম্য, শ্রম শোষণ, ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে এই দিনটি আরও ন্যায়সঙ্গত, শ্রমবান্ধব সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি পালনের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে । অতএব, নির্দ্বিধায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস প্রকৃতপক্ষে শ্রমিক নিপীড়ন, কর্মসংস্থান এবং শ্রম অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে সমাধান করার একটি বৈশ্বিক উপলক্ষ্য ।

মে দিবস শুধু শ্রমিকদের অধিকার আদায় নয়, বরং কর্মক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকারের পাশাপাশি বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দিয়ে এসেছে যুগে যুগে। ১৮৮৬ সালের এই দিবসের ঘটনায় পুরো বিশ্বের খেটে-খাওয়া মানুষের উপযুক্ত মর্যাদা দানের স্বীকৃতি মেলে । যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা সেদিন শুরু হয়, তা আজকের পৃথিবীর অনেক অন্যায়, বৈষম্য আর শ্রেণী-বিভেদকে ভেংগে সমাজ-ব্যবস্থার নব-উত্থান ঘটায়। আর তাই এ মে দিবসে সেই প্রাণ হারানো শ্রমিকদের স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধাভরে। সেই সঙ্গে সমাজের বৈষম্য দুর করে ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নের প্রতীকী হিসেবেই বছরের পর বছর পালন করা হচ্ছে মে দিবস।

পড়ুন:  আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের চেতনা: বাংলাদেশে শ্রম আইনের প্রয়োগ (শেষ পর্ব)-ড. মুহাম্মদ শাহীন চৌধুরী

বাংলাদেশের শ্রম আইন তার বাস্তবায়ন

বাংলাদেশ স্বল্প-উন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। ফলে শ্রমবাজার, শ্রমিকের অধিকার ও শ্রম আইনের প্রয়োগ আলোচনায় আসছে। বিশেষত, ইউরোপের বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিএসপির আওতায় বিদ্যমান যেসমস্ত শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে তা আর বজায় থাকবে না। তখন ‘জিএসপি প্লাস’প্রযোজ্য হবে; আর তা পেতে হলে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে। আমরা তার জন্য সময় পাবো ২০২৭ সাল পর্যন্ত। দেশে বেসরকারি খাতে শ্রমিক নিয়োগ ও তার শর্তাবলী প্রতিপালন করার জন্য প্রযোজ্য প্রধান আইন হলো- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬। এই আইনটি মূলত: পূর্বেকার ২৫ টি প্রাসঙ্গিক আইনকে রদ ও রহিত করে রচিত হয়েছে। তবে উক্ত শ্রম আইনের প্রধানতম দুর্বলতা হলো– এর সীমিত প্রয়োগ।

শ্রম আইন এর সীমিত পরিধিঃ

দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অধিকাংশ শ্রমিক (কমপক্ষে ৮০%) নিয়োজিত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক, ফ্রীল্যান্স ও ডিজিটাল প্লাটফর্ম কর্মী, কৃষিখামার (যেখানে পাঁচ জনের কম শ্রমিক নিয়োজিত) এবং গৃহকর্মীরা শ্রম আইনের আওতার বাইরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ০৭ কোটি ৩৪ লক্ষ; তার মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ থেকে ১১ ভাগ শ্রম আইনের আওতায়। দেশে যেসব রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) রয়েছে তার জন্য রয়েছে আলাদা শ্রম আইন (যাতে নানান সীমাবদ্ধতা রয়েছে)। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে জাতীয় শ্রম আইনের প্রয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। একদেশে দুই ধরণের শ্রম আইনের প্রয়োগ দুর্বল শ্রম ব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই শ্রম আইনের প্রয়োগের ব্যাপ্তি বাড়ানো সময়ের দাবি। তা না হলে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কিংবা গৃহকর্মে ও ডিজিটাল মাধ্যমে কাজে নিয়োজিত তাদের জন্য আলাদা আইন করা দরকার।  একই সঙ্গে বিদ্যমান শ্রম আইনে নানান অসঙ্গতি ও অস্পষ্টতা রয়েছে। আর যা আইনে বিদ্যমান আছে তারও প্রয়োগ না হওয়া বড় পরিতাপের বিষয়।

কর্মক্ষেত্রে শ্রম আইনের বাস্তবায়নঃ-

শ্রম আইন বাস্তবায়ন ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ বা নিয়োগকারীর। যেমন, সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নিয়োগ ও তার চাকরির শর্তাবলী নির্ধারণ ও পালন; এর মধ্যে রয়েছে- নিয়োগপত্র প্রদান, আইন নির্ধারিত কর্ম-ঘণ্টা পালন, ছুটি মঞ্জুর, মজুরী পরিশোধ, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, চাকরি অবসানে আইন নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ তথা সার্ভিস বেনিফিট প্রদান প্রভৃতি। আর নারী শ্রমিক হলে তার জন্য কর্মক্ষেত্রে হয়রানি প্রতিরোধ এবং প্রসূতিকালীন ছুটি ও সুবিধাদি প্রদান। উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছন প্রধানতম কারণ হলো সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারীর (নিয়োগকারী) অনীহা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি তদারককারী সংস্থার দুর্বলতা।

বাংলাদেশে শ্রম আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারককারী সংস্থা হলো- সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে এবং অংশগ্রহণকারী কমিটি ও ভবিষ্যৎ তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে শ্রম অধিদফতরেরও ভূমিকা রয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন কারখানার নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী ইউনিয়নগুলোর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Accord) অনুযায়ী বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরী পোশাক কারখানগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা তদারকীর জন্য ৫৬ হাজারের বেশি অডিট ইনস্পেকশন করা হয়েছে; ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি নিরাপত্তা সমস্যা সমাধান করা হয়েছে এবং ২০ লাখ শ্রমিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় কলকারখানা পরিদর্শন সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয় যা এখনও চলমান রয়েছে।

সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে Corporate Sustainability Due Diligence আইন পাশ হয়েছে যা ২০২৯ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে। এই বিলে বলা হয়েছে, শিল্প–কলকারখানায় মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হলে যেসব ইউরোপীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড সে কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ দেয় তাদেরও দায়ী করা যাবে। এত দিন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লাগলে বা শ্রমিকের অধিকার লঙ্ঘিত হলে মূল ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানের দায় থাকত না। নতুন এই আইনের কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অধিকার, জীবনমান ও কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নতির অবকাশ তৈরি হবে। আমাদের দেশীয় কোম্পানীগুলোর প্রতিযোগীতা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য Due Diligence আইনটি একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।

চলবে . . .

(লেখকঃ অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)