১৩ বিলিয়ন ডলারের কম রিজার্ভ থাকলে ঝুঁকি কতটা

বাংলাদেশের গত দুই মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ তের বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে আসার খবর প্রকাশ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তাদের হিসেবে গ্রস বা মোট রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের কারণে সামনে রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও ভালো হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য মোট তেইশ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ দাবি করলেও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফের হিসেবে রিজার্ভ আছে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন দুইটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে। এর একটা হচ্ছে গ্রস বা মোট, অর্থাৎ যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা হাতে আছে, যা এখন ২৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার। আরেকটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পদ্ধতি- বিপিএম৬। সে অনুযায়ী এখন রিজার্ভ ১৮.৩২ বিলিয়ন।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে খবর এসেছে যে এই রিজার্ভের মধ্যে এই মূহুর্তে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ তের বিলিয়ন ডলারের সামান্য কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইএমএফ এর এসডিআর হিসেবে থাকা ডলারসহ সব ধরনের দায় দেনা শোধের জন্য জমা রাখা অর্থ বাদ দিয়ে রিজার্ভের যে হিসাব তৈরি করা হয়, সে অনুযায়ী এখনই ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৩ বিলিয়নের ডলারের কিছুটা কম, যাকে গণমাধ্যমে নিট রিজার্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কখনোই নিট রিজার্ভের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত কয়েক মাসে কিছু পদক্ষেপ নিলেও রিজার্ভ প্রতিমাসেই কমছে। অর্থনীতিবিদরা এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য না থাকাকেই দায়ী করে আসছেন।
বাংলাদেশে ২০২১ সালের অগাস্টে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কোভিড মহামারি পরবর্তী সময়ে হুট করে আমদানি ব্যয় ব্যাপক বেড়ে গেলে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। এরপর আর কখনোই এটিকে উর্ধ্বমূখী করা যায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র অবশ্য বলছে, গণমাধ্যমে নিট রিজার্ভ যেভাবে হিসেব করা হচ্ছে সেটি সঠিক বলে তারা মনে করেন না। বর্তমানে যেসব ‘ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাতে সামনে পরিস্থিতি ভালো হবে’ বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে রিজার্ভ নিয়ে এসব আলোচনার মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে নতুন করে কোন রিজার্ভ চুরির ঘটনা আর ঘটেনি। ভারতীয় একটি অনলাইনে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে ওই বিবৃতিতে দেয়া হয়।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে দশ কোটি দশ লাখ ডলার চুরি করেছিল হ্যাকাররা। চুরি হওয়া এই অর্থের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র তিন কোটি ৪৬ লাখ ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলার হলে ঝুঁকি কোথায়?
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, প্রতিমাসে যে পরিমাণ আমদানি ব্যয় বাংলাদেশকে মেটাতে হয়, তাতে রিজার্ভ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। তবে রিজার্ভ যদি এভাবে থাকে বা আরো কমে যায়, তাহলে হুট করে কোন সংকট এলে মোকাবেলা কঠিন হবে।
“দুটি ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। একটি হলো ডলারের যোগান কমে আসলে তা মোকাবেলায় সক্ষমতা না থাকা এবং যে কোন ধরনের দুর্যোগ এলে তা সামাল দেয়া। রিজার্ভ যথাযথ না থাকলে উভয় ক্ষেত্রেই ঝুঁকিতে পড়ার আশংকা থাকে” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মূল যোগান আসে রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ অর্থাৎ রেমিট্যান্স থেকে।
সম্প্রতি আইএমএফ এর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বাজার ভিত্তিক করায় দেশের বাজারে ডলারের দাম ১১৭ টাকা হয়েছে। এর ফলে রেমিট্যান্স আরও অনেক বাড়বে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে রপ্তানি আয় কীভাবে কতটা বাড়বে অথবা আদৌ বাড়বে কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন কিংবা আলোচনা আছে।

মি. হোসেন বলছেন, “কাগজে কলমে রপ্তানি যতটা ভালো করছে বলে দেখানো হয় প্রকৃত চিত্র সেটা নয়। আবার রপ্তানিকারকরা ডলারের মার্কেট রেট পেলে ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দেশের বাইরে ফেলে রাখার প্রবণতা তৈরি হতো না”।
এছাড়া কোন প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যে কোন কারণেই কোন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলেও ডলারের চাহিদা বাড়বে, বিশেষ করে কোন কারণে শস্য উৎপাদন কমে গেলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
“জুলাই থেকে নভেম্বরে দুর্যোগের আশঙ্কা সবসময়ই থাকে। বন্যা হলে শস্য উৎপাদন কম হতে পারে। কিংবা অন্য কোন দুর্যোগ হলে হয়তো দাতা সংস্থারা এগিয়ে আসবে বা জরুরি সহায়তাও আসবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য পরিপুষ্ট রিজার্ভ থাকতে হয়। মনে রাখতে হবে রিজার্ভ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনারও একটা মাধ্যম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জাহিদ হোসেন।
তবে গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে গড়ে দুশো কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসাটাকে ইতিবাচকই মনে করেন তিনি।
“রিজার্ভ তো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটা মাধ্যম। ডলারের দর বেধে দিলেই হবে না। বরং যোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের রপ্তানি আর রেমিট্যান্স ছাড়া সোর্স নেই। সে কারণে ঝুঁকির শঙ্কা থেকেই যায়,” বলছিলেন মি. হোসেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলছেন মানি মার্কেট (মুদ্রা বাজার) সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এখন ডলার ট্রেড বাড়লে রিজার্ভের ওপর আর চাপই থাকবে না বলে তিনি মনে করেন।
“প্রথমত নিট রিজার্ভের হিসেবটিই ঠিক নয়। আর এখন রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশ ভালো দেখছি। ব্যাংকে ডলার আসলে তো আর রিজার্ভ থেকে ডলার দেয়ারই প্রয়োজন হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. হক।
প্রসঙ্গত, গত ৮ই মে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে ব্যাংকগুলোকে ১১৭ টাকায় মার্কিন ডলার ক্রয় বিক্রয় করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দিনই ডলারের দাম সাত টাকা বেড়েছিল।
‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়।
এছাড়াও আইএমএফ এর সাথে বাংলাদেশ যে ঋণচুক্তি করেছে তার তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার ছাড়াও বেশ কিছু সংস্থার ঋণ ও অন্য সহায়তা আগামী দু’মাসের মধ্যে ছাড় হওয়ার কথা, যা রিজার্ভ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে বলে সরকার আশা করছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। সংস্থাটি জানিয়েছে, মোট সাত কিস্তিতে এই ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রথম দু কিস্তির অর্থ বাংলাদেশ পেয়েছে।
“আমি মনে করি রিজার্ভ ঠিক রাখতে এবং ইতিবাচক ধারায় নিতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর ফলে মুদ্রা বাজারে ট্রেড বেড়েছে। আশা করছি আন্ত:ব্যাংক লেনদেনও বাড়বে এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটবে। আমাদের বিশ্বাস প্রবলেম থাকবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. হক।
রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
কোন দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের আমানত হিসাবে নেয়া মোট অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে (বাংলাদেশ ব্যাংক) জমা রাখতে হয়। এই অর্থ তারা ঋণ বা অন্য কোন কাজে খরচ করতে পারে না।
আর রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা ইত্যাদি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকে, সেটাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
বৈদেশিক মুদ্রার যথেষ্ট সঞ্চয় যদি থাকে,তখন বৈদেশিক ঋণ নেয়ার সময় কম চিন্তা করতে হয়। পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ীও বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, যা বিদেশি মুদ্রায় শোধ করতে হয়।
আবার যেসব আমদানি করা হয়, সেই আমদানির মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।এজন্য যেকোনো দেশের যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থাকলে আমদানি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না।
বাংলাদেশের মতো দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হয়। ফলে এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি থাকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।