বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৪৯): মে ২০২৪

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

২০২৪ সালের মে মাসে রাশিয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে। মে মাসের শুরুই হয় মে দিবস দিয়ে। সোভিয়েত আমলের মত সেই আড়ম্বর না থাকলেও এখনও মে ডে এ দেশে সরকারি ছুটির দিন। ট্রেড ইউনিয়নের বাইরেও বাম দলগুলির বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকে। আগে এই দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালিত হত। রেড স্কয়ারে বিশাল প্রসেশন। বিভিন্ন কল কারখানা থেকে শ্রমিকেরা লাল পতাকা নিয়ে রেড স্কয়ারের উপর দিয়ে মার্চ করে চলে যেত। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার ভার্সিটির পক্ষ থেকে সেখানে গেছি। এখন মে দিবস পালিত হয় বসন্ত ও শ্রম দিবস নামে। একথা ঠিক ক্যালেন্ডারের হিসেবে পয়লা মার্চ মাসে এদেশে বসন্ত এলেও প্রকৃতপক্ষে সে আসে পয়লা মে। এরপর ৭ মে ভ্লাদিমির পুতিন পঞ্চম বারের মত রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। এটা এই দেশ তথা বিশ্বের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এরপর ছিল ৯ মে – ফ্যাসিবাদী জার্মানির বিরুদ্ধে বিজয়ের ৭৯ বছর। আর ১০ মে মিখাইল মিশুস্তিন নতুন করে রশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন – সেটাও কোন মতেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ সবই ছিল অনেকটা রুটিন মাফিক। তবে বড় ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে পরে যখন ভ্লাদিমির পুতিন পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও আইন ব্লকের সম্ভাব্য নেতাদের নাম পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদে পেশ করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এতদিন পর্যন্ত মন্ত্রী সভার সমস্ত সদস্যদের নাম আসত প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আর গসদুমা বা ন্যাশনাল পার্লামেন্ট সেটা অনুমোদন করত। সংবিধান সংশোধনের পরে এখন থেকে মন্ত্রী সভা গঠনে পার্লামেন্টের ভূমিকা বেড়েছে। এবারের মন্ত্রী সভায় অধিকাংশ সদস্য কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন। বাকিদের একজন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির, অন্যরা এদিনায়া রাশিয়া বা ইউনাইটেড রাশিয়ার। বিগত মন্ত্রী সভার প্রায় সবাই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, কিছু কিছু নতুন সদস্য এলেও তারা আগে থেকেই কমবেশি পরিচিত এবং বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছেন। শোইগু ছাড়া পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, আইন ইত্যাদি মন্ত্রনালয়ে কোন পরিবর্তন আসেনি। তবে সব দেখে মনে হয় আন্দ্রেই বেলাউসভের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় সবাই একটু অবাক হলেও এটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হয়নি, তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিতি লাভ করেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোন ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তারপরেও, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সময়ে, যখন রুশ সেনারা আক্রমণে যাচ্ছে, তখন এ ধরণের পরিবর্তন বিভিন্ন গুজবের জন্ম দেবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা এখানে ততটা দেখা বা শোনা যাচ্ছে না যতটা না বাইরে। অনেকেই শোইগুর অপসারণ প্রিগোঝিনের ভাগনার বিদ্রোহের সাথে যুক্ত করছে, কেউ বা শোইগুর ডেপুটির দুর্নীতি কেলেঙ্কারির সাথে এর যোগাযোগ দেখছে, এর পরেও আরও এক উচ্চপদস্থ জেনারেল দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে। তবে এখানে প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞ বেলাউসভের আগমন নতুন সময়ে নতুন চ্যালেঞ্জের সাথে জড়িত বলে মনে করছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সামরিক খাতে রশিয়ার ব্যয় কিছুদিন আগেও ছিল জিডিপির ৩% যা বেড়ে এখন হয়েছে ৬.৭%। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি পেসকভের মতে এটা এখনও ক্রিটিক্যাল না হলেও তা ক্রমশ ১৯৮০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক খাতে ব্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে যা ছিল জিডিপির ৭.৪%। স্মরণ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অনেকগুলো কারণের একটি ছিল সামরিক খাতে লাগামহীন ব্যয় যার জন্য দেশের অর্থনীতি প্রস্তুত ছিল না। তাহলে কি এখন যুদ্ধও ক্ষেত্রে অর্থ সরবরাহ কমবে? এ বিষয়ে গসদুমায় বেলাউসভ নিজে বলেছেন যে তাঁর কাজ হবে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ও ফলপ্রসূ ব্যবহার।

বেলাউসভ সম্পর্কে বলার আগে উল্লেখ করতে চাই যে সেরগেই শোইগু রাশিয়ার রাজনীতিতে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী চরিত্র। নতুন রাশিয়ার প্রথম দিন থেকেই তিনি ছিলেন জরুরি অবস্থা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। ইয়েলৎসিনের রাশিয়ায় সেই মন্ত্রণালয় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদার দিক থেকে না হলেও কাজের দিক থেকে। কারণ সেই সময় সমস্ত দেশটাই এক অকল্পনীয় জরুরী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরপর তিনি কিছুদিনের জন্য মস্কো রিজিওনের গভর্নর ছিলেন, যদিও গভর্নর হিসেবে তিনি খুব বেশি সফল ছিলেন বলে মনে হয় না। অনেকের ধারণা তিনি সেনাবাহিনী বা সেই ধরণের সংগঠনে সফল হলেও বেসামরিক কাজে ততটা দক্ষ নন। তবে তিনি অচিরেই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং এতদিন পর্যন্ত সাফল্যের সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান। ভ্লাদিমির পুতিন নিজেও এক সময় এই দায়িত্ব পালন করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি অফিসিয়ালি কেউ না হলেও কার্যত ছিলেন দেশের প্রধান ব্যক্তি। রাশিয়ার নিরপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নন, এই পদটি অফিসিয়ালি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারপরেও রাশিয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই শোইগুকে আমরা আরও অনেকদিন যে রাশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে জ্বলতে দেখব তাতে সন্দেহ নেই। তিনি বর্তমানে ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে চীন ভ্রমণ করছেন। চেয়ারম্যান সির সাথে ওয়ান প্লাস ফোরের যে মিটিং পুতিনের উপদেষ্টা উশাকভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেলাউসভের সাথে নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান শোইগুও উপস্থিত ছিলেন। এটাই এই পদের ও শোইগুর গুরুত্ব বলে দেয়। সেখানে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন – এখনও তাঁর প্রধান কাজ ইউক্রেনের যুদ্ধে জয়লাভ করা।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫০): যুদ্ধ প্রদর্শনী -বিজন সাহা

এবার আসি বেলাউসভের কথায়। তিনি অর্থনীতিবিদ, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স, পরে ডিএসসি ডিফেন্ড করেন। সেই দিক থেকে তাঁর একাডেমিক যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে কাজ করেছেন। কিছুদিন আগেও মিশুস্তিনের মন্ত্রী সভায় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন, এর আগে ছিলেন পুতিনের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি বেসামরিক লোক এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত নন। এর আগেও রাশিয়ায় বেসামরিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন সেরগেই ইভানভ ও আনাতোলি সেরদুকভ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে শোইগুর প্রশংসা করে বলেছেন যে এই সময়ই রুশ সেনাবাহিনী এক ডাইনামিক ফোর্সে পরিণত হয়। সিরিয়া ও ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সাফল্যের পেছনে শোইগুর অবদান অনস্বীকার্য। তবে যুদ্ধ শুধু যুদ্ধের মাঠে জয়লাভ করা নয়। যেসব সেনেরা ফিরে আসছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এদের আফগানিস্তানের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। চেচনিয়া যুদ্ধের পর সবাই যে যথাযথ ভাবে পুনর্বাসিত হয়েছিল সেটাও বলা যায় না। ইউক্রেন যুদ্ধের সেনাদের পুনর্বাসনের সমস্যা নতুন মন্ত্রীকেই সমাধান করতে হবে। তাছাড়া বর্তমান যুদ্ধ শুধুমাত্র গোলাগুলি নয়। এর সাথে হাইটেক জড়িত। বিশেষ করে ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি। নব্বইয়ের দশকের তুলনায় বা দশ বছর আগের তুলনায় সেনাবাহিনীতে দুর্নীতি কম হলেও একেবারে নির্মূল হয়নি। শোইগুর ডেপুটি ও আরেক জেনারেলের আরেস্ট সেটাই বলে। যুদ্ধের কারণে বেড়েছে সামরিক বাজেট। সামরিক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্প চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বেলাউসব এতদিন মন্ত্রীসভায় এসব কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। এখন তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে এসব করবেন। তাঁর মূল কাজ হবে নতুন বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতির সাথে সামরিক বাহিনীর অর্থনীতিকে একই রেলসে নিয়ে আসা। প্রথমে সিরিয়া, পরে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রুশ সেনাবাহিনী এক দীর্ঘ ও ফলপ্রসূ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা শুনে মনে হয় এই যুদ্ধের আশু সমাপ্তি নেই। তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে যুদ্ধের মধ্যে রেখে রাশিয়াকে দুর্বল করতে। তাই এখন প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। যে ভিত্তির উপরে শোইগু সেনাবাহিনীকে দাড় করিয়ে রেখেন গেছেন সেটাকে সামনে নিয়ে যাওয়া। এখানকার বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের বিশ্বাস সেই দায়িত্ব পালনে বেলাউসভ অন্যতম যোগ্য ব্যক্তি। মনে রাখতে হবে যে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এদেশের শিল্প চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শেষ হলে সেই উদ্যোগ যাতে চাপা পড়ে না যায়, সামরিক শিল্পকে যাতে বেসামরিক খাঁতে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা করার ক্ষেত্রেও বেলাউসভের অর্থনৈতিক শিক্ষা খুবই প্রয়োজনীয়। সেই সাথে প্রয়োজন রুশ বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করা, এর সংখ্যা বাড়ানো। তাই সামরিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দরকার অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা। এছাড়াও বেলাউসভ সবসময় প্রায় সব ব্যাপারে নিজস্ব মতামত পোষণ করেন এবং সেসব বলতে দ্বিধা করেন না। তবে এসবই আশা। একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে তিনি কতটুকু সফল হবেন। এই মুহূর্তে বলা যায় বর্তমান রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সামনে যেসব সমস্যা আছে সেসবের সমাধানে তিনি অন্যতম যোগ্য ব্যক্তি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো