মতামত

শ্রমজীবী মানুষের বাজেট ভাবনা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

আগামী অর্থ বছর ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষেরা আশা এবং নিরাশার সংমিশ্রণে জাতীয় বাজেট ঘোষণার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। বাজেট শুধু দেশের অর্থনৈতিক গতিপথকে প্রভাবিত করে না, কোটি কোটি শ্রমজীবী এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। আসন্ন বাজেটে শ্রমজীবী মানুষের মূল মূল কিছু প্রত্যাশা নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

১) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণঃ বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের একটা প্রাথমিক উদ্বেগ হল নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাল, ডাল, তেল এবং শাকসব্জির মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিষগুলোর দাম বেড়েই চলছে, যা নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের লোকদের পক্ষে বহন করা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আসন্ন বাজেটের অন্যতম প্রধান প্রত্যাশা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকার স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা হিসাবে টিসিবি’র উদ্যোগে ট্রাক সেলের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনের যে প্রচেষ্টা করছে তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। সুতরাং দ্রব্যমূল্য কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে সকল নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্থায়ী রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা খুবই জরুরী। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারের উচিৎ আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং আমদানী নির্ভরতা কমানোর দিকে মনোনিবেশ করা।

) উচ্চ আয় বৈষম্য কমানোঃ বাংলাদেশে বর্তমানে গিনি সহগ ০.৪৯৯। যার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ আয় বৈষম্যের দিক থেকে খুবই উঁচু স্থানে অবস্থান করছে। অর্থাৎ দেশে আয়ের বন্টন অত্যন্ত অসম, জনসংখ্যার একটি বড় অংশ গড় আয়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে কম আয় করে যখন দেশের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ যথেষ্ট বেশি আয় করে। আসন্ন বাজেটে এই উঁচু স্তরের আয় বৈষম্য মোকাবেলাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ। সরকারের উচিৎ সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির লক্ষে কর ব্যবস্থায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনিতিবিদদের অনেকেই মনে করেন আয় বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারন হচ্ছে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ কর ব্যবস্থা। বর্তমান কর ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি। সুতরাং আয় বৈষম্য কমাতে হলে সবার আগে পরোক্ষ কর কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ৩) অর্থ পাচার প্রতিরোধ করাঃ  এবারের বাজেটে অন্যতম প্রত্যাশা হচ্ছে বিদেশে টাকা পাচার প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে দৃঢ় অবস্থান নেয়া। অর্থ পাচার শুধু দেশের অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং সরকারকে অনেক প্রয়োজনীয় রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত করে। অর্থ পাচার কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য, সরকারের উচিৎ তার নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে শক্তিশালী করা, তার পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োগের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা। উপরন্তু, অর্থ পাচারের পরিনতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবৈধ অর্থ পাচার বিরোধী আইন ও বিধি-বিধান মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।

) দুর্নীতি প্রতিরোধ করাঃ দুর্নীতি প্রতিরোধ করা বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ। এটা শুধু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে না, সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কার্যকারিতাকেও ক্ষুন্ন করে। অতএব, বাজেটে অন্যতম প্রত্যাশা হচ্ছে দুর্নীতি মোকাবেলা করা এবং সরকারী-বেসরকারী উভয় সেক্টরেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা উন্নত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো। সরকারের উচিৎ দুর্নীতি বিরোধী আইন শক্তিশালী করা, দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সরকারী ও বেসরকারী উভয় সেক্টরে সততা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া। উপরন্তু, সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপের কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।

৫) জনগনের চিকিৎসা ব্যয় নাগালের মধ্যে আনাঃ আসন্ন বাজেটের প্রত্যাশায়, সরকারের কাছ থেকে প্রাথমিক প্রত্যাশাগুলির মধ্যে একটি হল বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা ব্যয় মোকাবেলা করা। ৬৫% এর বেশি মানুষ বেসরকারী স্বাস্থ্য সেবার উপর নির্ভর করে। কোভিড পরবর্তী চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি অনেকের জন্য চিকিৎসা পরিষেবাগুলিকে অসাধ্য করে তুলেছে। মহামারী শেষ হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা ব্যয় এখনো সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে এবারের বাজেটে নতুন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বিদ্যমান হাসপাতাল সমূহ সম্প্রাসারনের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকতে হবে।  এছাড়া গরীব ও প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের উপর সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালুর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

৬) শিক্ষা ব্যয় কমানোঃ  শিক্ষা হল সুযোগ উম্মোচন এবং সামাজিক গতিশীলতার চাবিকাঠি। যাইহোক, বাংলাদেশের শিক্ষাখাত অপর্যাপ্ত তহবিল, অবকাঠামোর অভাব এবং নিম্নমানের শিক্ষাসহ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ অপরিহার্য। পাশাপাশি শিক্ষা খাতে অধিকতর দক্ষতা ও জবাবদিহিতারও প্রয়োজন রয়েছে –যাতে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো, শিক্ষার গুনগত মান উন্নত করা এবং সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়। উপরন্তু, বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে বৃত্তিমূলক এবং কারিগরি শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।

৭) শ্রমিকদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যাঃ উপরে উল্লেখিত প্রত্যাশার পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষও আশা করে যে বাজেটে তাদের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে এমন অন্যান্য বিষয়গুলিকেও সমাধান করবে। এর মধ্যে রয়েছেঃ

  • জীবনধারণ উপযোগী তথা ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা।
  • শ্রম অধিকার ও সুরক্ষা জোরদার করা।
  • অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা।
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক সুযোগ বাড়ানো

উপসংহারে বলা যায়, অতিতের ৫২টি বাজেট ঘোষনায় প্রত্যেক সরকার শ্রমজীবী মানুষকে হতাশ করেছে। তারপরও আমরা মনে করি,  আসন্ন বাজেট আবার নতুন করে সরকারের জন্য শ্রমজীবী মানুষের উদ্বেগ দূর করার এবং জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি করেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আয় বৈষম্য হ্রাস, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সরকার শ্রমজীবী মানুষ তথা সমস্ত বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরও সমৃদ্ধ এবং ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে উদ্যোগী হতে পারে। একটি কল্যাণকর এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষের এটাই প্রত্যাশা।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)