মতামত

দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি নিরসন: এবারের বাজেটের প্রধান চ্যালেঞ্জ

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বর্তমানে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বৈষম্য ও দুর্নীতি নিরসনকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির বর্তমান চিত্র

টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে:

  • মোটা চাল: ৩৪ থেকে ৪০ টাকা -> ৫০ থেকে ৫৫ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৪৭.০৬%)
  • দেশি মুসুর ডাল: ১০০ থেকে ১০৫ টাকা -> ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৩০%)
  • সয়াবিন তেল: ১০০ থেকে ১০৬ টাকা -> ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৬০%)
  • লবণ: ২৫ থেকে ৩৫ টাকা -> ৪০ থেকে ৪২ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৬০%)
  • পেঁয়াজ: ২২ থেকে ৩০ টাকা -> ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ১৯৬.৪৫%)
  • হলুদ: ১৮০ থেকে ২২০ টাকা -> ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৬৬.৬৭%)
  • শুকনা মরিচ: ১৮০ থেকে ২২০ টাকা -> ৩২০ থেকে ৪৫০ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ৭৭.৮%)
  • আলু: ১৫ থেকে ২০ টাকা -> ৫০ থেকে ৫৫ টাকা (মূল্য বৃদ্ধির হার ২৩৩.৩৩%)

মূল্য বৃদ্ধি: কারণ ও প্রভাব

দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে:

  • আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া একটি বড় কারণ।
  • স্থানীয়ভাবে উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি: বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং শ্রম খরচ বেড়ে যাওয়া।
  • মজুদদারির কারণে কৃত্রিম সংকট: বিশেষ করে পেঁয়াজ ও আলুর ক্ষেত্রে মজুদদারির কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়।
  • সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব: সমন্বয়হীনতার কারণে বাজারে সিন্ডিকেট গঠিত হয়। সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রন করতে রাস্ট্র বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ

বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এবারের বাজেটে এটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে:

  • কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা: বাজারে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সঠিক মনিটরিং ব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রতিদিনের বাজার দরের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
  • সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ চেইন উন্নয়ন করতে হবে।
  • কৃত্রিম সংকট প্রতিরোধ: মজুদদারির কারণে কৃত্রিম সংকট প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
  • আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের উৎস বৃদ্ধি: বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা।
  • কৃষিখাত উন্নয়ন: স্থানীয় কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।
  • বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা: ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাজার সিন্ডিকেটধারীদের কঠোর আইনের আইনের আওতায় আনতে হবে।

বৈষম্য নিরসন

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি এই সমস্যার সমাধান করতে সহায়ক হতে পারে:

  • সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন: বিভিন্ন অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমতা নিশ্চিত করতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
  • বিনা খরচে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে হবে।
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ: বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
  • নারীর ক্ষমতায়ন: নারীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি এবং প্রণোদনা চালু করতে হবে।

দুর্নীতি নিরসন

দুর্নীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি দুর্নীতি নিরসনে সহায়ক হতে পারে:

  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: সরকারি ও বেসরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
  • দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন কার্যকর করা: দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।
  • জনগণের অংশগ্রহণ: দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন ও সক্রিয় করতে হবে।
  • প্রযুক্তির ব্যবহার: ই-গভর্নেন্স ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা

সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের শক্তিশালী ভূমিকা প্রয়োজন। সাধারণত সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলগুলোর উচিত সংসদে জনগণের দাবি ও সমস্যাগুলি উত্থাপন করা কিন্তু আমাদের দেশে ২০১৪ সালের পর হতে সংসদে কোন কার্যকর বিরোধী দল নেই। সুতরাং বামদল গুলোসহ প্রকৃত বিরোধী দল সমূহের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা সমূহ চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে কার্যকর গণ আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোও গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করতে পারে।

সাধারণ জনগণের করণীয়

সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তারা সচেতনভাবে কেনাকাটা করতে পারেন এবং অবৈধ মজুদদারি বা মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন।

উপসংহার

বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এবারের বাজেটে দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও স্বস্তিদায়ক হয়। বৈষম্য ও দুর্নীতি নিরসনেও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আশা করি, সরকার সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)