মতামত

এবারের বাজেট: প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মিল-অমিল

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের শিরোনাম করা হয়েছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। সরকার যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু বাস্তবতা কি এই প্রতিশ্রুতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? বাজেটের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে।

ঋণ ও সুদ পরিশোধ

প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার এই বাজেটের ১৪.২ শতাংশ, যা প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা, খরচ হবে ঋণের সুদ পরিশোধে। এই বিশাল পরিমাণ সুদের বোঝা তুলে ধরছে সরকারের ঋণ নির্ভর উন্নয়ন কৌশলের বাস্তবতা। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কেননা ঋণ গ্রহণের ফলে দেশের জনগণকে দীর্ঘমেয়াদে বিপুল ঋণের বোঝা

বহন করতে হচ্ছে। এই ঋণ কি সত্যিই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, নাকি দুর্নীতির ছোবলে তা অধিকাংশই অপচয় হয়েছে? ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য এই বিপুল ব্যয় সরকার কতটা দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহারে আয়কর রিটার্ন

বাজেটে প্রস্তাবিত নতুন নিয়ম অনুযায়ী, কমিউনিটি সেন্টার বা কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হলে আয়কর রিটার্ন প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি স্পষ্টতই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর আরেকটি চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই আয়কর রিটার্ন দাখিলের সুযোগ বা প্রয়োজনীয়তা থেকে বঞ্চিত। এই নিয়মের ফলে তাদের জন্য সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যা একটি অসামাজিক ও বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ।

কালো টাকা সাদা করা

প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেউ যদি তার গোপন সম্পদ প্রকাশ করতে চান, তাহলে নির্দিষ্ট হারে কর প্রদান করে তা বৈধ করতে পারবেন। এই পদক্ষেপটি অবশ্যই বিতর্কিত। এটি একদিকে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়াতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে নৈতিকতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন তুলে ধরে। কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বৈধতা পাচ্ছেন, যা সুস্থ অর্থনৈতিক নীতি ও সুশাসনের পরিপন্থী।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ৫.১৯ শতাংশ। যদিও এই বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা এখনও যথেষ্ট নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮ থেকে ১০ শতাংশ বরাদ্দও সন্তোষজনক হতে পারে। বর্তমান বরাদ্দের পরিমাণে স্বাস্থ্য খাতের মানোন্নয়ন সম্ভব হবে না, বরং সংকট আরও বাড়বে। জনগণ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে।

পেনশন তহবিলের করহার

প্রভিডেন্ট, গ্র্যাচুইটি, সুপারঅ্যানুয়েশন ও পেনশন তহবিল থেকে অর্জিত আয়ের উপর করহার ১৫ শতাংশ থেকে পুনরায় ২৭.৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এটি অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য আরও একটি বড় ধাক্কা। অবসরকালীন এই তহবিল থেকে কর বৃদ্ধি তাদের আর্থিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এটি একটি অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ এবং অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াতে পারে।

সমাপ্তি মন্তব্য

‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এবারের বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবনা ও বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্ন উঠছে। ঋণের সুদ পরিশোধ, কালো টাকা সাদা করা, স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব এবং কমিউনিটি সেন্টার ব্যবহারে কঠোর নিয়মাবলী—এগুলো কি সত্যিই একটি স্মার্ট ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি বহন করে? সরকারকে এই বিষয়ে আরও সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে জনগণের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি না হয় এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা যায়।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি