পরিবেশবান্ধব কারখানা ও শ্রমিক অধিকার: বাংলাদেশে শ্রমিকদের জীবনমানের বাস্তবতা -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের জন্য গর্বের বিষয়। সাম্প্রতিককালে গাজীপুরের কাশিমপুরের কটন ক্লাব লিমিটেড এবং ঢাকার ধামরাইয়ের গ্রাফিক্স টেক্সটাইল পরিবেশবান্ধব কারখানার ‘লিড’ সনদ পেয়েছে। কিন্তু এই উন্নয়ন কী শ্রমিকদের জীবনমানে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমমানের আলোকে শ্রমিক অধিকার ও তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব কারখানা: বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশে বর্তমানে ২২০টি কারখানা পরিবেশবান্ধব সনদ পেয়েছে, যার মধ্যে ৮৪টি প্লাটিনাম, ১২২টি গোল্ড, ১০টি সিলভার এবং ৪টি সার্টিফায়েড সনদ অর্জন করেছে। এসব কারখানার সনদ প্রদান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। এই কারখানাগুলোতে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা নির্মাণ ও উৎপাদন পদ্ধতির মান রক্ষার জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।
শ্রমিকদের জীবনমান ও অধিকার
যদিও পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নেও সমানভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কিছু মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ন্যায্য মজুরি: শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। শ্রমিকদের এমন মজুরি দেওয়া উচিত যা তাদের এবং তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত থাকেন। গার্মেন্টস সেক্টরে ২০২৩ সালে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি এখনো অনেক কারখানায় বাস্তবায়িত হয়নি বলে আমাদের কাছে সংবাদ আছে।
- কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা: কর্মপরিবেশ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া উচিত। পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোতে সাধারণত কারখানার অবকাঠামো ও কর্মপরিবেশ উন্নত হয়, তবে শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিষয়ে তা মানা হয় কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
- স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সুবিধা: শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারের স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে অসুস্থতার সময় সহজে ও সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। এই ব্যাপারেও আমাদের মালিক পক্ষ খুব সচেতন কিনা তা আমাদের জানা নেই।
- শিক্ষার সুযোগ: শিক্ষা প্রতিটি শিশুর জন্মগত অধিকার। সকল শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। শ্রমিকদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত হলে তারা সন্তানদের শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। এই ব্যাপারে মূলত রাষ্ট্রকেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
- সামাজিক নিরাপত্তা: কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হলে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রমমানের সাথে সংগতি বজায় রেখে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা উচিত। এছাড়া শ্রমিক কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়লে বা বয়সের কারনে শ্রমিক চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করলে তার জীবন ধারণ করার মত আয় যেন থাকে তার নিশ্চয়তা থাকা উচিৎ।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের জীবনমান নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন উঠেছে। পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ উন্নত হলেও শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ে এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেক সময়ই শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পান না, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া, অনেক কারখানায় স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল।
সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
- জীবনধারণ উপযোগী মজুরি : শ্রমিকদের জীবনধারণ উপযোগী মজুরি দিতে হবে যাতে তাদের ন্যুনতম মৌলিক অধিকার সমূহ পূরণ হয়।
- স্বাস্থ্যসেবা: শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রত্যেক শ্রম ঘন এলাকায় শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য ফ্রি হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। এই ব্যাপারে মালিক এবং সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে।
- শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: শ্রমিকদের সন্তানদের উন্নত ভবিষ্যত নিশ্চিতকল্পে শিক্ষা সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে । প্রয়োজনে দেশের প্রত্যেক শ্রম ঘন এলাকায় শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য উন্নতমানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এছাড়া শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
- নিরাপত্তা ব্যবস্থা: কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে এবং শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
- আইন প্রয়োগ: আন্তর্জাতিক শ্রমমানের সাথে সংগতি রেখে দেশের শ্রম আইনকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে শ্রম আদালতকে আরও কার্যকর করতে হবে
উপসংহার
পরিবেশবান্ধব কারখানা প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শুধুমাত্র একটি সুষ্ঠু ও টেকসই শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই লক্ষ্যে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সহযোগিতা এবং সরকারের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এবং সমন্বয়ক, ওশ সেন্টার, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প)