জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী: শ্রমিক আন্দোলনের এক অকুতোভয় পথিকৃৎ -ফজলুল কবির মিন্টু
চট্টগ্রাম শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্র উপকূলবর্তী উত্তর কাট্টলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জননেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী। ছায়াঢাকা সুনিবির গ্রাম এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী এই এলাকাটি ছিল বৃটিশবিরোধী বিপ্লবীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিপ্লবীদের নিয়মিত যাতায়াতের কারণে এই স্থানটি ছিল অস্ত্র পরিচালনা ও প্রশিক্ষণের আদর্শ জায়গা। এমনকি মাস্টারদা সূর্যসেনও উত্তর কাট্টলিতে পদধূলি দিয়েছেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের পূর্বে উত্তর কাট্টলির সাগর তীরে তিনি ও তার সাথীরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন।
এমন বিপ্লবী পরিবেশে শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করে জহুর আহমদ চৌধুরীর রক্তে বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হওয়া ছিল স্বাভাবিক। নিজের জীবনের চেয়ে দেশের মানুষের শোষণ নির্যাতন থেকে মুক্তির পথে মনোনিবেশ করে তিনি ১৯৩৮ সালে রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে হলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তথা গরিব মেহনতি ও শ্রমিকশ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতার খিদিরপুরে শ্রমিক রাজনীতি শুরু করেন। খিদিরপুরে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ভিভি গিরি (যিনি পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন) ছিলেন তাঁর শ্রমিক রাজনীতির গুরু। ১৯৪৬ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী জ্যোতি বসুর সাথে ডক ইয়ার্ডে কার্সি ইউনিয়ন করতেন। পূর্ববঙ্গে ২৫ হাজার শ্রমিককে কেন্দ্র করে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে তিনি অন্যতম নেতা ছিলেন।
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সংগঠিত বন্দর শ্রমিকদের আন্দোলনে জহুর আহমদ চৌধুরী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম মেরিনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন এবং বেঙ্গল মেরিনার্স ইউনিয়নের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, মাহবুবুল হক, আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করেছিলেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জহুর আহমেদ চৌধুরী ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং পণ্ডিত ব্যক্তি। প্রচুর দেশি-বিদেশি বই পড়ার কারনেই তিনি প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও দক্ষতায় এক উচ্চ আসনে নিজেকে আসীন করেছিলেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামী নেতা। রাষ্ট্রে ও সমাজে যেখানেই অন্যায় অবিচার দেখেছেন সেখানেই তিনি ইস্পাতের দৃঢ়তা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি ২৪ বছরের মধ্যে ৮ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত আস্থাভাজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন এবং ৪টি মন্ত্রণালয় সততা ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছিলেন।
মন্ত্রী হিসেবে জহুর আহমদ চৌধুরীর অন্যতম বড় অবদান ছিল তৎকালীন শাহবাগ হোটেলকে পিজি হাসপাতালে রূপান্তর করা, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের প্রথম শ্রমনীতি প্রণয়ন করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
আজ, মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাঁর সাহসী ও অপোষহীন নেতৃত্বের কারণে শ্রমিকশ্রেণি বৃটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে অধিকার আদায় করতে পেরেছে। বর্তমানের শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান করোনা মহামারির সময়, তাঁর মতো একজন যোগ্য শ্রমিক নেতা থাকলে শ্রমিকেরা যথাযথ দিক নির্দেশনা পেত এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হতো।
(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)