বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(১৫৫): জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ  

– বিজন সাহা

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো মহাকাশের ছবি নিয়ে সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে বাংলাদেশ পোর্টালেও অনেক লেখালেখি হয়েছে এ নিয়ে। এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে যে এ নিয়ে কথা বলেনি বা ছবি শেয়ার করেনি। সবাই নিজের নিজের মত করে ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আসলে দেশে যে এত লোক মহাকাশ নিয়ে এত আগ্রহী সেটা আগে জানা ছিল না। নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কারণ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্ধার করা, মহাবিশ্বের উৎপত্তি, বিবর্তন, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এসবের গঠন এবং মহাবিশ্বের চরম পরিণতি সম্পর্কে জানা। সেদিক থেকে এই মিশনের গুরুত্ব অপরিসীম।

এ নিয়ে ন্যাচারে একটি প্রতিবেদন বের হয়েছে। সেখানে কিছু ছবি বাদেও আছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু সত্য বলতে কি এটা কোন ফাইনাল রেজাল্ট নয়, বরং মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার জন্য কিছু কাঁচামাল। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞরা এই মিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন তত্ত্ব উত্থাপন করবেন মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যাখ্যা কতটুকু গ্রহণ যোগ্য? কারণ সব কিছুর ব্যাখ্যা নির্ভর করে আমাদের উদ্দেশ্যের উপর আবার কি পদ্ধতিতে আমরা ব্যাখ্যা করছি তার উপর। সেটা কেমন? যেমন কাগজে আঁকা একটা গোলাকার বস্তুকে বৃত্ত বলে ধরে নেই। আবার সেই গোলাকার বস্তু ময়দার তৈরি হলে আমরা জ্যামিতি ভুলে গিয়ে খাবারের কথা মনে করি আর সেই বস্তু আমাদের সামনে রুটির রূপ নিয়ে দাঁড়ায়।

অনেকেই বুঝতে চাইছেন না বা বুঝতে পারছেন না যে এসব তথ্য আসলে আজকের নয়। যেসব গ্যালাক্সির ছবি আমরা পেয়েছি সেটা আসলে আজ থেকে কয়েক বিলিয়ন বছর আগে তাদের অবস্থার প্রতিবেদন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বসে এটা বুঝতে হয়তো কষ্ট হয়, তবে বছর তিরিশ আগের ঘটনা দিয়ে আমরা সেটা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। তখন আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি। দেশ থেকে মস্কোয় চিঠি আসতে প্রায় এক মাস সময় লাগত, যখন চিঠি হাতে পেতাম সেখানে যে খবর থাকত তা আসলে এক মাস আগের। আরও সহজ করে বোঝার জন্য কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। ছোটবেলায় আমরা বিভিন্ন ধরণের খেলা খেলতাম যার একটা ছিল অনেক উঁচুতে টেনিস বল ছুঁড়ে সেটাকে ধরা। ছোড়া থেকে ধরা পর্যন্ত অনেকটা সময়ের ব্যাপার। ধরুন একজন গোলে ফ্রি কিক করছে। কিক স্পট উৎস আর গোলকিপার রিসিভার। কিক স্পট থেকে বল কতটা সময়ে গোলকিপারের হাতে আসবে সেটা নির্ভর করে এই দুজনের দূরত্ব আর বলের উপর প্রযুক্ত শক্তি ও বলের বেগের উপর। যদি সব সময় বেগ এক হয় তবে সময় নির্ভর করবে তাদের দূরত্বের উপর। ফুটবল না ভেবে ক্রিকেট বলের কথাও ভাবতে পারেন। আমাদের বর্তমান উদাহরণে বোলার নিহারিকা আর ব্যাটসম্যান টেলিস্কোপ। কঠিন কঠিন উপমার পেছনে না গিয়ে নিজেদের জীবনের ঘটনা দিয়ে যদি বোঝার চেষ্টা করেন দেখবেন কাজটা সহজ হয়ে গেছে।

মহাবিশ্বে খবরের আদান প্রদান হয় আলো বা ফোটন কণার মাধ্যমে। হয়তো একদিন আমরা নিউট্রিনোকে বশ মানাতে পারব আর তখন হয়তো নিউট্রিনোর মাধ্যমেও কিছু খবর জানতে পারব। তবে এখন আমাদের তথ্যের একমাত্র মাধ্যম বিদ্যুৎ তরঙ্গ (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ), সেটা হতে পারে দৃশ্যমান আলো, রেডিও বা বেতার তরঙ্গ, এক্স-রে ইত্যাদি। যেহেতু আলোর বেগ সসীম (ফিনিট) তাই উৎস থেকে পর্যবেক্ষকের চোখে (আমাদের ক্ষেত্রে টেলিস্কোপে) পৌঁছুতে সে কিছুটা সময় নেয় আর এই সময় নির্ভর করে উৎস থেকে পর্যবেক্ষকের দুরত্বের উপর। যেমন সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল, আর এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর ৮ মিনিট সময় লাগে। নিউটনের বিশ্বে মানে নিউটন যে বিশ্বের ধারণা করতেন সেখানে সব ঘটত মুহূর্তের মধ্যে। আইনস্টাইনের বিশ্বে যেহেতু কোন কিছুই আলোর গতির চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না আর আলোর গতি সীমিত তাই উৎস থেকে প্রাপকের কাছে আলো পৌঁছুতে সময় লাগে আর আমরা যখন সেই তথ্য পাই তা আসলে ততটাই পুরনো যতটা সময় লেগেছে এই তথ্য প্রাপকের হাতে পৌঁছুতে। আমরা এখানে উৎসকে সোর্স হিসেবে উল্লেখ করব আর প্রাপক হবে রিসিভার।

প্রশ্ন আসতে পারে যে আমরা কীভাবে জানব যে যে গ্যালাক্সি থেকে আলো এসে পৌঁছিয়েছে তা এতটা দূরে? এজন্যে আমরা ডপলার এফেক্ট ব্যবহার করি। এর অ্যানালগ আমরা পেতে পারি দৈনন্দিন জীবনে। যদি আপনি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকেন আর একটা গাড়ি হর্ন দিতে শুরু করে তাহলে সেটা একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে আপনার কানে আঘাত করবে। তার থাকবে নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। কম্পাঙ্ক হল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ব্যস্তানুপাতিক। তাই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত বেশি কম্পাঙ্ক তত কম মানে সেটার শব্দ তত নিচু (সাধারণের ভাষায় মোটা গলা)। আবার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যত কম কম্পাঙ্ক তত বেশি আর সেক্ষেত্রে শব্দ হবে যাকে বলে তারস্বরে বা চিকন গলায়। আগেই বলেছি গাড়িটি একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে মানে নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে হর্ন দিচ্ছে। এখন গাড়িটি যদি চলতে শুরু করবে তাহলে সেই শব্দ ভিন্ন মাত্রা নেবে। যদি গাড়িটি আপনার থেকে দূরে সরে যায় তাহলে তাহলে গাড়ি ও আপনার মধ্যে দূরত্ব বাড়বে অর্থাৎ সিগন্যাল বা শব্দ এক্ষেত্রে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করবে। ফলে বাড়বে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। শব্দ হবে নিচু স্বরে। পক্ষান্তরে গাড়ি আপনার দিকে আসলে সিগন্যাল অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব অতিক্রম করবে আপনার কানে পৌঁছুতে। ফলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট হবে আর সেটা তারস্বরে বাজবে আপনার কানে। অর্থাৎ দূরে সরে গেলে শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়বে, কাছে আসলে কমবে। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটে কারণ সেটা অনবরত প্রসারিত হচ্ছে। ফলে সোর্স ও রিসিভার ক্রমাগত একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। আসুন এখন ফিরে আসি আলোর জগতে। আমরা সবাই রংধনু দেখেছি, জানি সেখানে সাতটি রঙ – বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল বা বেনীআসহকলা। এগুলো দৃশ্যমান আলো। এদের আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। এখানে লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, বেগুনী আলোর সবচেয়ে কম। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়লে সেটা লালের দিকে যায়। আমরা কিছুক্ষণ আগে দেখলাম যে সোর্স ও রিসিভার একে অন্যের থেকে দূরে সরে গেলে সোর্স থেকে নিক্ষিপ্ত তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। তাই কোন তরঙ্গের দৈর্ঘ্য যদি লালের দিকে যায় তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে সেটা আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একে বলে রেড শিফট। উল্টোটা হলে মানে সোর্স ও রিসিভার পরস্পরের কাছে চলে এলে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে মানে নীলের দিকে যায়। একে বলা হয় ব্লু শিফট। এই রেড শিফট হাবল প্যারামিটারের সাথে জড়িত। রেড শিফট জেনে আমরা হাবল প্যারামিটার জানতে পারি আর সেটা জেনে আলোর উৎস কত দূরে সেটা হিসেব করে বের করতে পারি। হাবল প্যারামিটার আমাদের জানায় পরস্পর থেকে ১ মেগাপারসেক (৩.৩ মিলিয়ন আলোকবর্ষ) দূরে অবস্থিত দূর গ্যালাক্সি কি বেগে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী হাবল প্যারামিটারের মান ৭০ কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেক। তার মানে ১০০ মেগাপারসেক দূরে অবস্থিত দুটো গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে ৭০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড বেগে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য ভাবে বললে যে গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে যত দূরে সেটা তত দ্রুত গতিতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৬):নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া ভ্রমণ -বিজন সাহা

তবে মনে রাখতে হবে আমরা যেটা দেখছি, মানে যেসব ছবি দেখছি সেটা নির্ভর করে সুদূর মহাকাশ থেকে প্রাপ্ত ডাটা আমাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর মানে কী? ছোট্ট দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আপনি একই দোকান থেকে রান্নার বিভিন্ন সামগ্রী কিনে দু’ জন লোককে রাঁধতে দিলেন। যুক্তির খাতিরে ধরা যাক তাদের হাড়ি পাতিল, তেল মশলা, এমন কি চুল্লী পর্যন্ত আইডেন্টিক্যাল। তারপরেও খুব সম্ভব দু’ জনের রান্নার স্বাদ ভিন্ন হবে এমনকি তারা যদি একই পদ্ধতি অনুসরণ করেও রান্না করে। আবার ধরুন আপনি ছবি তুললেন ফিল্ম কোথাও প্রসেস করতে দিলেন। সেখানেও দেখবেন বিভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ভিন্ন রেজাল্ট। এমনকি যদি ফটোশপে একই ছবি একাধিক বার প্রসেস করেন, দেখবেন ফলাফল ভিন্ন হয়েছে। কারণ সবকিছু নির্ভর করে অ্যালগোরিদমের উপর। ছবি তোলার সময় আমরা যেমন ক্যামেরার ম্যাট্রিক্সে আলোক সংকেত পাই, মহাকাশের ছবির ক্ষেত্রেও তাই। শক্তিশালী টেলিস্কোপ দূর দূরান্ত থেকে আসা বিভিন্ন আলো ডিটেক্ট করে আর সেটা পরবর্তীতে প্রসেস করা হয় অ্যালগোরিদমের সাহায্যে। আর সেই অ্যালগোরিদম তৈরি করা হয় মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন অনুমান বা হাইপোথেসিসের উপর ভিত্তি করে যার অন্যতম হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব হোমোজেনাস ও আইসোট্রপিক। হোমোজেনাস মানে হল মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু একই রকম বা অন্য কথায় মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দুই তার কেন্দ্র। মনে আছে মহাবিশ্ব ভূকেন্দ্রিক না সৌরকেন্দ্রিক সেই বিতর্ক যে জন্যে জরদানো ব্রুনোকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল আর গ্যালিলিওকে অন্তরীন থাকতে হয়েছিল? অথচ দেখছি মহাবিশ্বের কোন কেন্দ্রই নেই। আর আসিসোট্রপিক মানে মহাবিশ্বের প্রতিটি দিকই একই রকম বা অন্য অর্থে মহাবিশ্ব সব দিকেই একই হারে প্রসারিত বা সংকুচিত হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের মহাবিশ্বের বিবর্তনের চিত্র আঁকতে সাহায্য করে তবে সেটা কতটুকু রিয়ালিস্টিক সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এটা অনেকটা গণতন্ত্রের মত। কথায় বলে গণতন্ত্র আইডিয়াল সিস্টেম নয় তবে তা অন্য যেকোনো ব্যবস্থার চেয়ে ভালো। এর মানে আবার এও নয় যে বর্তমানে আমাদের যে ছবি দেখানো হয় সেটা মিথ্যা। বিজ্ঞানের কাজই হচ্ছে ধীরে ধীরে সত্যের দিকে যাওয়া। প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে একটু একটু করে সামনে নিয়ে যায়।

বিঃ দ্রঃ লেখাটি শুরু করেছিলাম ২০২৩ সালের জুনের শুরুতে। তবে বিভিন্ন কারণে অন্যান্য লেখা সামনে চলে এসেছিল। আশা করি এখনও এটা প্রাসঙ্গিক। এর নতুন বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ভবিষ্যতে আরও লেখার আশা রাখি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো