বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৬):নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া ভ্রমণ

-বিজন সাহা

সপ্তাহ দুই আগে ক্লাবে ঢোকার সাথে সাথেই ভাসিলি বলল

– বিজন আমি তোমাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি?
– অবশ্যই। হঠাৎ কী ব্যাপার?
– না মানে মনে হল এ ব্যাপারে তুমি আমার চেয়ে ঢের বেশি জান তাই।

ভাসিলি অনেক পড়াশুনা জানা মানুষ। বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা করে। আর কথা বলে সে বিষয়েই যা ভালো জানে। আসলে এটা এদেশের বেশির ভাগ লোকজনই। এরা পড়তে ভালবাসে। আর কোন বিষয়ে কথা বলতে গেলে একটু জেনেশুনেই আসে। এমনকি আমার ছেলেমেয়েরা কোন ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আগে থেকে নিজেরা নেট ঘেঁটে জানার চেষ্টা করে তারপর কথা শুরু করে।

– যাকগে, তুমি না বললে বুঝব কেমনে কী জানতে চাইছ?
– মোদী সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?
– এক কথায় বললে আমি তাঁকে পছন্দ করি না। তবে আমার পছন্দ অপছন্দ তোমার প্রশ্নের উত্তর নয়। তুমি নিশ্চয়ই অন্য কিছু জানতে চাইছ। তাই?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আস আগে বলি কেন আমি তাঁকে পছন্দ করি না। সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর তার মূলে মোদীর রাজনৈতিক  দর্শন।
– সে আর বলতে।
– ভারত বহুজাতিক দেশ। আর যেকোনো দেশের মূল মন্ত্র হওয়া উচিৎ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার। আমি জানি আক্ষরিক ভাবে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। তবে সভ্য দেশে তার একটা সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকে। ভারতের সেটা ছিল। কিন্তু মোদী ও তাঁর দল এখন বিভিন্ন অজুহাতে একটা গ্রুপকে অন্যদের চেয়ে বড় করে দেখতে চায়। তাদের ধারণা ভারতে এদের অধিকার অন্যদের তুলনায় বিশেষ করে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে বেশি। কিন্তু যখনই তুমি আইন করে কাউকে অসমান করতে চাও সেটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। দেশ বিমূর্ত। তার ধর্ম, বর্ণ, জাতি এসব নেই। আর বিমূর্ত বলেই তার কাছে সবাই সমান। তাই যেকোনো সরকারের উচিৎ প্রজাদের এই অধিকারটুকু নিশ্চিত করা, অন্তত আইন করে সমান অধিকারের প্রতিশ্রুতিটুকু তুলে না নেওয়া। মোদীর সরকার তাই করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ আছে। এটাই আমার মোদীকে পছন্দ না করার কারণ।
– কিন্তু তাঁর আমলে তো ভারত অর্থনৈতিক ভাবে বেশ উন্নতি করছে। এখন বিশ্বের প্রথম দিকের অর্থনীতির একটা।
– তা ঠিক। তবে এটা শুরু হয়েছে অনেক আগে, ১৯৯০ এর দশকে যখন ভারত পশ্চিমা বিশ্বের জন্য অর্থনীতির দুয়ার খুলে  দেয়। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত না হলেও ভারতের অর্থনীতিতে যথেষ্ট রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল। সেটা তুলে দেওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় উন্নয়ন। তবে বর্তমান উন্নয়ন সারা বিশ্বের মতই – ধনীদের আরও ধনী করছে – গরীবদের আরও গরীব না করলেও সম্পদের মেরুকরণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢের বেশি। এটা আসলে পুঁজিবাদ তার নিজের চরিত্র বদলে ফেলার কারণে। কিন্তু ভালো মন্দ খুবই আপেক্ষিক। গণতন্ত্র বহুরূপী। যদি স্থানীয় আর্থসামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি বিবেচনায় না এনে সেটা উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় তবে ফলাফল খুব সুখের হয় না। সেটা যেকোনো আদর্শ এমনকি ধর্মের জন্যও সত্য। তাই এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসা কোন একজনকে মনে হয় একনায়ক আবার কেউ বা এতটাই লিবারেল যে দেশের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে। ঠিক ধরেছ আমি পুতিন আর ইয়েলৎসিনের কথা বলছি। মোদীকেও এখানে যোগ করতে পার। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন শক্ত হাতে শাসন করতে হয় তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে আবার নরম হতে হয়। এটা অনেকটা পরিবারের মত। বাবা মাকে কখনও কখনও কঠোর হতে হয়, কখনও কখনও নমনীয়। কিন্তু লক্ষ্য যদি থাকে দেশ ও জনগণের অবস্থার উন্নতি সাধন তবে সমস্যা কম। তবে সেটা আবার নির্ভর করে কে দেখছে। এই যেমন ভিক্টর অরবান – তাঁকে ইউরোপের সব দেশের সরকার গালিগালাজ করছে, পুতিনের চর বলছে। কিন্তু একটু গভীর ভাবে ভাবলে দেখবে তিনি তাঁর দেশের মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছেন, যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলছেন। তাই অনেক কিছুই নির্ভর করে তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে দেখছ।
– তার মানে মোদী ততটা খারাপ নয় তাই?
– দেখ, তিনি যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় বারের মত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তার মানে তাঁর পেছনে জনসমর্থন আছে, ভারতের জনগণের এক বিশাল অংশের কাছে তিনি ভালো। তবে তুমি তো মোদীর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ততটা চিন্তিত নও যতটা তাঁর বিদেশ নীতি নিয়ে। হ্যাঁ, তাঁর বা সেই অর্থে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি যথেষ্ট স্বাধীন। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের এত চাপের মুখেও সে দেশ এখনও পর্যন্ত রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারছে। সেদিক থেকে দেখলে এটা সম্ভব হচ্ছে মোদীর কারণেও। বিষয়টি যতটা না মোদীর তারচেয়ে বেশি করে পার্লামেন্টে তাঁর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। আসলে কেন্দ্রে যখন কোয়ালিশন সরকার থাকে তখন সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা সহজ হয়, যদিও স্বীকার করতেই হবে যে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ভারতের প্রায় সব দলই সরকারকে সমর্থন করে তা সে কেন্দ্রে যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। তবে সরকার নিজে স্থিতিশীল হলে এসব কাজে সুবিধা হয়। তাছাড়া নির্বাচনে জয়লাভের পর মোদীর প্রথম বিদেশ সফর রাশিয়ায়। এটাও রাশিয়ার প্রতি তাঁর সরকারের বিশেষ সম্পর্কের কথাই বলে। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার যে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়ার পাশেই থাকবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৭): কোটা আন্দোলন -বিজন সাহা

ভাসিলি খুব ভালো আইটি স্পেশালিস্ট। এক সময় ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করত। ভালো ফটোগ্রাফার। আমেরিকার ভক্ত বলব না, তবে রাশিয়ার চেয়ে আমেরিকাকেই বেশি পছন্দ করে। প্রচণ্ড রকম পুতিন বিরোধী। তাই আমার কথা শুনে ও খুশি হল নাকি অখুশি হল সেটা ঠিক বলতে পারব না। তবে অধিকাংশ রুশদের মত ভাসিলিও ভারতকে পছন্দ করে বলেই মনে হয়। জানি না কবে থেকে এর শুরু, তবে বিগত চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমার রাশিয়ার জীবনে খুব কম মানুষ দেখেছি যারা ভারতকে পছন্দ করে না। সোভিয়েত আমলে মধ্য এশিয়ার রিপাবলিকগুলোর মানুষজন তো ভারতীয় বলতে পাগল ছিল। বলিউডের নায়ক নায়িকাদের নাম ছিল সবার মুখে মুখে, বিশেষ করে রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, মিঠুন চক্রবর্তী এসব নাম।  কত বার যে শুধু ভারতীয় চেহারার কারণে বিভিন্ন ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছি। সেদিক থেকে বললে শুধু রাশিয়ার সরকার নয় রুশ দেশের মানুষও ভারতকে পছন্দ করে। এখনও অনেক অপরিচিত মানুষ হঠাৎ করেই বলে উঠে হিন্দি-রুশী ভাই ভাই। ভারতের কথা জানি না, তবে মোদী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন ভারতের জনগণের কাছে রুশ মানেই বিশ্বস্ত বন্ধু। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ে পুঁজিবাদী পশ্চিমা বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বাইরে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেহেরু নিজে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল বলেই জানা যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব চুক্তি দুই দেশকে আরও কাছে নিয়ে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ধ্বসে পড়লে প্রায় সব সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথেই রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে বিভিন্ন প্রতিকূলতার পরেও রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল, আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে চাপ থাকার পরেও এখনও পর্যন্ত সেই বন্ধুত্ব অটুট আছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে পশ্চিমা বিশ্ব আশা করেছিল যে ভারত এবার রাশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এদের মধ্যেও যে সে ভয় ছিল না তা নয়। তবে বিগত দিনে দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে বলেই মনে হয়। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার পরে ভারত ও চীন রাশিয়ার অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাইরেও ব্রিক্স সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জোটের মধ্য দিয়েও এই দুই দেশ পরস্পরের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আজ আমরা যে গ্লোবাল সাউথ বলি সেখানেও রাশিয়া ও ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মোদীর বর্তমান সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সহ প্রযুক্তিগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রকাশ্যে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তির বাইরেও সেখানে যদি গোপন চুক্তি থাকে তাতেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এসব দেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে কখনোই নিজেদের সম পর্যায়ের দেশ বলে মনে করে না, সুযোগ পেলেই বুঝিয়ে দেয় তারা কে আর আমরা কে। সেদিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া নিজেকে সুপেরিয়র মনে করে না যদিও হয়তো ওয়ারশ জোটের দেশগুলোর প্রতি সেটা ঠিক খাটে না। সেদিক থেকে ভারত ও রাশিয়া নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য। তার মানে এই নয় যে দুই দেশের মধ্যে সব কিছুই খুব মসৃণ। মনে রাখতে হবে যে ব্রিক্স সহ বিভিন্ন জোটে ভারত ও চীন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হবার পরেও তারা পরস্পরের বৈরি। রাশিয়ার সাথে এক পক্ষের ভালো সম্পর্ক অপর পক্ষের মনে প্রশ্নের জন্ম দিতেই পারে। বিশেষ করে চীনের সাথে রাশিয়ার বর্তমান সম্পর্ক। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে এক সময় চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল পরস্পরের অন্যতম প্রধান শত্রু, এদের মধ্যেও সীমান্ত নিয়ে সমস্যা ছিল। কিন্তু তারা দুই দেশের স্বার্থে এসব সমস্যা শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধান করতে পেরেছে। রাশিয়ার এই অভিজ্ঞতা এবং চীন ও ভারত উভয় দেশের সাথে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক এশিয়ার এই দুই শক্তির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। সব মিলিয়ে মোদীর রাশিয়া সফর গ্লোবাল সাউথকে শক্তিশালী করবে এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশুগুলোর উপর ইউরোপ ও আমেরিকার নব্য ঔপনিবেশিক নাগপাশ শিথিল করবে বলেই অনেকে মনে করেন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো