চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৭): কোটা আন্দোলন

-বিজন সাহা

আজকাল বাংলাদেশ থেকে ফেসবুক, হোয়াটসআপ ইত্যাদি মাধ্যমে পাওয়া খবর দেখে মনে হয় দেশে যেন যুদ্ধ চলছে, খণ্ড যুদ্ধ। ১৯৮৩ সালে দেশ থেকে চলে আসার আগে ফেব্রুয়ারিতে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিল। ছাত্র জনতা শিক্ষানীতি পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল করলে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী ট্রাকের তলায় পিষে অনেককে হত্যা করে। এরপরে এরশাদের পতন হয়েছে, শাহবাগ আন্দোলন হয়েছে, হয়েছে আরও একাধিক আন্দোলন, তবে এবারের মত এত মৃত্যু স্বাধীন দেশে হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। মনে তাই বিশাল প্রশ্ন – কেন এমন হয়? কেন আমরা রাজনৈতিক ভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারি না?

এবারের আন্দোলন কোটা ব্যবস্থা নিয়ে। কেউ বলছে তারা কোটার বিলোপ চায়, কেউ চায় সংস্কার। তবে একটা কথা ঠিক – এই কোটা নিয়ে রক্ত ঝরুক এটা কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাদে কেউ চায় না। আমি নিজে এই কোটা আন্দোলন সম্পর্কে খুব বেশি যে জানি তা নয়। যেটুকু জানি সেটা বিভিন্ন পোস্ট দেখে, কিছু কিছু ইন্টার্ভিউ শুনে। তাই কথা বলব সাধারণ ভাবে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে নিজের মত করে। আমার ধারণা সব কোটা ব্যবস্থার মূল কথা হল সমাজকে কোটা মুক্ত করা, মানে সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে বিশেষ সুযোগ দিয়ে উপরে তুলে আনা যাতে করে এক সময় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলে কিছু না থাকে। আর এটা করতে গেলে সব সময়ই অগ্রসর গোষ্ঠীকে কিছুটা হলেও ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল অগ্রসর গোষ্ঠীর মানুষ হলেই যে কেউ সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে তা কিন্তু নয়। যে সমাজ শোষণমুক্ত নয় সেখানে বিভিন্ন ধরণের নিপীড়িত মানুষ থাকবেই। ধরুন একজন মেধাবী তরুণ যে সরকারি বিবেচনায় পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর প্রতিনিধি নয় অথচ দারিদ্র্যের ভারে জর্জরিত সেও কিন্তু এই কোটা ব্যবস্থার শিকার হয়ে বেকার থাকতে পারে। আসলে সুবিধা জিনিসটা সব সময়ই গোলমেলে। তাকে ঠিক মত হ্যান্ডেল করতে না পারলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। মনে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কথা। স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের সুযোগ দিতে গিয়ে এক সময় সে দেশের জাতীয় ক্রিকেট দল শক্তিশালী দল থেকে অতি সাধারণ দলে পরিণত হয়েছিল। কথা ছিল কোটার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের মান উন্নত করা আর সেটা কোনক্রমেই জাতীয় দলের মানকে মাটিয়ে মিশিয়ে দিয়ে নয়। একই কথা বলা চলে বর্তমানে আমেরিকায় যান্ত্রিকভাবে আফ্রো-অ্যামেরিকান, এলজিবিটি ইত্যাদি সমাজের মানুষদের নিয়োগ নিয়ে। অবশ্যই এদের উপরে তুলে আনতে হবে, তবে সেটা যেন নিজেদের সার্বিক মান ক্ষুণ্ণ না করে। এখানে বিপ্লবের সময়ের রাশিয়ার একটি গল্প খুব প্রযোজ্য। বিপ্লবের পরে এক বনেদী বাড়ির গৃহকর্ত্রী তাঁর দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন
– বাইরে এত হল্লা কিসের?
– এটা শ্রমিকদের মিছিল। ওরা সবার জন্য সমান অধিকার চাইছে।
– কিন্তু ভাংচুর করছে কেন?
– ঐ যে বললাম, ওরা আপনাদের সমান হতে চায়।
– আমরাও তো সেটাই চাই। আমরাও চাই ওরা শিক্ষিত হোক, অনেক টাকার মালিক হোক। কিন্তু ভাংচুর করলে তো সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হব। সবাই গরীব হয়েও সমান হওয়া যায়, কিন্তু আমার মনে হয় না এটা ওদের বা আমাদের কারো কাম্য।

দেশের এই ঘটনার পরে আমি ইচ্ছে করে আমার সোভিয়েত বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ওদের এরকম কোন কোটা ছিল কি না। নিজের পড়াশুনা ও ওদের উত্তর শুনে বুঝলাম সেই সময় সেরকম কিছু ছিল না। সেই সময় সবাইকে কাজ করতে হত, কাজ না করলেই বরং বিপদে পড়তে হত। আর সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে সাহায্য করার জন্য অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছিল। শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। মূল কথা হল সবাইকে কমবেশি সমান সুযোগ দেয়া যাতে করে সে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। আমার ধারণা এখানেই যদি সোভিয়েত সরকার তার দায়িত্ব শেষ করত তাহলে দেশ অন্য পথে যেত। কারণ সবার জন্য কাজ – সেই ব্যবস্থার পাশাপাশি মেধা অনুযায়ী বেতনের ব্যবস্থা না করায় তখন এখানে অনেক সময় মেধাবীদের অনুৎসাহী করা হয়েছিল। কেন? কারণ মেধাবী আর সাধারণ মানুষ একই সমান বেতন পেত। ফলে মেধাবীদের মধ্যে এক ধরণের অসন্তোষ কাজ করত, অনেকেই মনে করত শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যায় বিরাজ করলেও চাকরীর ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না, মেধাবী নয়, চতুর লোকজন এক্ষেত্রে লাভবান হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের ইতিহাস বলে কোটা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলো যতটা না নিজেদের অবস্থার উন্নতি করে এই কোটা ব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায় তারচেয়ে বেশি করে সেসব সমাজের কিছু কিছু লোক এটাকে অনন্তকাল ধরে ব্যবহার করতে চায় নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থে। এটা অনেকটা রানীর অতিথির মত। শুনেছি আমাদের দেশের অনেক লেখক ইংল্যান্ডে গিয়ে বেকার ভাতা নিতেন আর সংবাদপত্রে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন করতেন। কিন্তু বেকারত্ব মোচনের জন্য ইংল্যান্ডে চাকরি খোঁজার প্রয়োজন বা বেকার ভাতা না নেবার সাহস দেখাতে পারতেন না। এসব কথা বলার একটাই কারণ – কোটা একটি খুবই ট্রিকি বা চাতুর্যপূর্ণ বিষয়। সঠিক ভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলে ও মাঝে মধ্যে পর্যালোচনা না করলে এ নিয়ে বিপদে পড়তে হতে পারে।

ফিরে আসা যাক দেশে। কোটাকে কেন্দ্র করে চলমান আন্দোলনকে বিভিন্ন মহল থেকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কাউকে সরাসরি রাজাকার বলা হয়নি তবে এ রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যেকোনো বক্তব্য বিভিন্ন রঙে রাঙানো হতে পারে, তাই কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে সবারই সংযমী হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের দেশের কিছু কিছু মন্ত্রীর অভ্যেস আছে সব কিছুতে বিরোধী দলের হাত দেখা। কিন্তু বিরোধী দল এজন্যেই বিরোধী দল। তাদের কাজ সরকারের ভুল ধরা, এমনকি সঠিক কাজও জনগণের কাছে ভুল বলে প্রতিপন্ন করা। এটা খুবই স্বাভাবিক। তাই সরকারের এমন কিছু করা উচিৎ নয় যাতে বিরোধী দল সেই সুযোগ ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। বিরোধী দল সেই সুযোগ নিয়েছে আর আন্দোলনকে সুপরিকল্পিত ভাবে বিতর্কিত করছে – অন্তত মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার প্রশ্নে। তবে অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রছাত্রী না বুঝেই, অনেকটা আবেগের বশেই এই বিতর্কের শিকার হচ্ছে বলে আমার ধারণা। তাই ঢালাওভাবে তাদের দোষারোপ না করে আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ কেন এরা আজ এই ধরণের শ্লোগান দিচ্ছে। একটা ন্যায্য দাবি নিয়ে তাদের আন্দোলন কীভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে চলে যাচ্ছে। ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় আগেই সব পক্ষের কথা বার্তা বলার বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। এটা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোটা সমস্যা – এটা  জাতীয় সমস্যা ও সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। সেটা সম্ভব সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত কোন ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে যেখানে শিক্ষক, ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দল, আইনজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ থাকতে পারে। চাকরি ক্ষেত্রে কোটা নিয়ে সমস্যা আজ সীমানা ছাড়িয়ে এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারেই তাই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান আজ সময়ের দাবি। আমার ধারণা কোন দলীয় রাজনীতির শিকার না হয়ে নির্দলীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য লোকদের নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠন ও অহিংস উপায়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা দরকার। লাখ লাখ মানুষ  কর্মবিরতি পালন করতে পারে এবং একই সাথে রাস্তা থেকে সন্তানদের সরিয়ে নিতে পারে। হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা দরকার। ইতিমধ্যে আইনমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। দেশের স্বার্থে, আরও রক্ত যাতে না ঝরে সেজন্যে এই সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৮): বিচ্ছিন্ন ভাবনা -বিজন সাহা  

আমরা অনেকেই নতুন প্রজন্মকে দায়ী করছি। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তী প্রজন্মকে দেখে শেখে। এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি আছে তবে তাদের সংখ্যা নগণ্য। আন্দোলনকারীদের সিংহভাগ আমার আপনার মত সাধারণ মানুষ যারা দুর্নীতিমুক্ত দেশ চায়, পড়াশুনা শেষে দেশেই চাকরি করে বাঁচতে চায়। কেন এরা আজ নিজেদের রাজাকার বলল সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? আমরাই কি একাত্তরের চেতনাকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করছি না? যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের এই প্রশ্ন না করব, যতদিন না নিজেদের ভুল স্বীকার করার সাহস অর্জন করব ততদিন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এভাবেই আমাদের ত্যাগ করে বিরোধী শিবিরে যোগ দেবে। আমরা অনেকেই কথায় কথায় বলি কী হবে যদি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে? এই প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল। ছোট্ট ঘর ঘরে অনেক মানুষ। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা তাই সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ। বাতাস ঢোকার পথ পর্যন্ত নেই। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে সকালে দেখা গেল সবাই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে।  একাত্তরের শত্রুদের হাতে ক্ষমতা যেতে পারে সেই ভয়ে রাজনীতি বন্ধ করে আমরাও ঠিক এদিকেই এগোচ্ছি বলে মনে হয়।

অনেকেই প্রশ্ন করেন বাইরে বসে আমরা দেশের কী বুঝি। শুধু দেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে কেন, প্রায় প্রতিটি বিষয়েই আমি আপনাদের যে কারো চেয়ে অনেক কম জানি এটা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি। অনেকেই এখানে সোভিয়েত ও বর্তমান রাশিয়ার তরুণ  প্রজন্মের কথা তুলেছেন। কিন্তু সোভিয়েত যুব সমাজের পচন কিন্তু পার্টির হাত ধরেই হয়েছে। পার্টির উপরতলার নেতারাই দেশ হারিয়ে ফেলেছিল জনগণের আস্থা হারানোর পরে। এমনকি পার্টির শত দুর্নীতির পরেও এই জনগণ ভোট দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে। কাজ হয়নি। বিরোধী দল তখন এদেশে ছিল না। আমাদের দেশে যখন বিরোধী দলীয় রাজনীতির সুযোগ সীমিত, ভোটের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন বিরোধী দল এসব আন্দোলন ব্যবহার করবে সেটা স্বাভাবিক। দুর্নীতিবাজদের হাত থাকবে এই আন্দোলনে সেটাও স্বাভাবিক। দুর্নীতি দমনে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেবার কারণে তারাই কি অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে এসব করাচ্ছে না? সেটা করার সামাজিক ও আর্থিক ভিত্তি তাদের আছে। আমার প্রশ্ন হল প্রায় সমস্ত বিষয়েই সরকার জনগণের আস্থা হারাচ্ছে – এর জন্য কি শুধু জনগণ দায়ী, জনগণের দেশপ্রেমের ঘাটতি দায়ী? এই জনগণ তো দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে না, মুক্তিযোদ্ধাদের এমন তালিকা তৈরি করে না যা নিয়ে শুধু অলসরা হাসে না। আমি বিশ্বাস করি বিষয়টি অনেক সুন্দরভাবে সমাধান করা যেত। সরকার সময় মত সঠিকভাবে সেটা হ্যান্ডেল করতে অক্ষম হয়েছে। রাজাকারদের প্রতি আমার ঘৃণা আপনার চেয়ে কম নয়, তবে কেন ছাত্ররা এই শ্লোগান দিচ্ছে সেটার আমাদের বুঝতে হবে। এর কোন সহজ সরল ব্যাখ্যা নেই। রাশিয়ার নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকটাই ভুল দনবাস সেটা প্রমাণ করছে যেমনটা শাহবাগ প্রমাণ করেছিল আমাদের নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা। শুধু একটা কথা জানি একমাত্র নিরপেক্ষ ভাবে কোন ঘটনার পর্যালোচনা আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।

আমাদের সমস্যা হল আমরা না পারি বিজয় ধরে রাখতে, না পারি পরাজয় স্বীকার করতে। জয় পরাজয় যে চিরস্থায়ী নয়, এটা ইস্যু ভিত্তিক সেটা আমরা মানসিক ভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। তাই সব বিষয়ে তাৎক্ষণিক ফলাফল চাই। দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আমাদের দরকার নেই। অনেকটা টিভি সিরিয়ালের মত – উত্তেজনা বজায় রাখতে সমস্যা অমীমাংসিত রাখতে হবে। সরকার যদি আন্দোলনকারীদের যে সমস্ত দাবি যৌক্তিক সেটা মেনে নিত আর যা যৌক্তিক নয় সেটা তাদের বোঝাতে সক্ষম হত তবে আন্দোলন তত দূর গড়াত না। মনে রাখতে হবে যে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা ও নিয়োগ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি কম ক্ষোভের সৃষ্টি করে না। কিন্তু প্রতিবাদ করা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। চাকরি থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে যদি সব ধরনের অলিখিত রাজনৈতিক বিশেষ করে সরকারি দলের রাজনৈতিক কোটা বাতিল করা হয় তাহলে বর্তমান কোটা সমস্যার সমাধান অনেকটাই হয়ে যায়।

যদিও কোটার আওতায় পড়ে মহিলা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি, অনগ্রসর জেলা ও মুক্তিযোদ্ধারা তারপরেও কেন যেন মুক্তিযোদ্ধাদের উপরেই সবার সব রাগ। কেন? সেটাও আমাদের দেখতে হবে। দেখতে হবে কারা এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জনগণের চোখে হেয় করল? ইদানিং কালে দনবাসে যুদ্ধ করা সেনাদের নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে নতুন এলিট শ্রেণি তৈরি করার। শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সেনাদের বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ও ইনস্টিটিউটে ভর্তির ক্ষেত্রে। কারণ যারা সেই সময় স্কুলে পড়াশুনা করেছে তাদের সাথে পরীক্ষায় সেই সেনারা পেরে উঠত না, যদিও তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক। আর এর ফলেই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে নতুন এলিট শ্রেণি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধে পোড় খাওয়া সেনারা দেশ ভাঙ্গেনি, ভেঙেছে তাদের উত্তরসূরিরা যারা দেশ গড়ায় নয়, দেশের সম্পদ ভোগে ব্যস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু চোরের খনির কথা বললেও সেটা বদলানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বা পেরে ওঠেননি। আজকে এই যে দুর্নীতির বাম্পার ফলন সেটা সেই না পারার ফল।

কোটা সমস্যার কোন রৈখিক সামাধান নেই। তবে এটা ঠিক শুধু কোটা নয় অন্যান্য অনেক সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি দুর্নীতি দমনে সরকারের সাফল্যের উপরে। তবে জল ইতিমধ্যে বহুদূর গড়িয়েছে। অনেক প্রাণ ঝরে গেছে। সেই দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আর বিরোধী দলগুলোর, বিশেষ করে একাত্তরের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রশ্ন যখন অস্ত্বিত্বের তখন অনেক সময় অনেক অনেক তেতো দাওয়াই খেতে হয়। দরকার শুদ্ধি অভিযান – বিশেষ করে সরকারের ভেতরে। দরকার ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করার। তাছাড়া শুধু চাকরির ক্ষেত্রে কোটাই নয়, আরও অনেক পদ্ধতি আছে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেবার। বর্তমানে রাশিয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে যেসব সৈনিক বেসামরিক জীবনে ফিরে আসছে তাদের বিভিন্ন ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা হচ্ছে যাতে তারা নতুন জীবনে নিজেদের খুঁজে পেতে পারে। আমাদের দেশে এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নেই, যেমন নেই রাজাকারদের তালিকা। এসব ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এটাও অসন্তোষের একটা কারণ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে এখনও তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়। বিভিন্ন ভাবেই তাদের সাহায্য করা যায়। আজকে কোটা নিয়ে যা চলছে সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননাও বটে। অবমাননা বাংলাদেশের প্রতি, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতি। আমরা বহুবার জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করেছি – এখন সময় ঐক্যবদ্ধ হবার।

রক্ত ঝরা বন্ধ হোক!

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো