বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৮): বিচ্ছিন্ন ভাবনা

-বিজন সাহা  

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)
বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

অনেক দিন আগের কথা। তখন এক মন্ত্রী মহাশয় সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করতেন। অনেকেই এসব তথাকথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে যোগসাজশ খুঁজে পেলেও তিনি সেসব আমলে নিতেন না। এখন যুগ বদলেছে। দুই সপ্তাহের বেশি হল দেশব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে রক্তপাত, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ সহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতে রঙ বেরঙের বিচ্ছিন্ন ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। এসব বিচ্ছিন্ন ভাবনাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।

মহাভারতে এক গল্প ছিল। এক রাজকন্যা এক সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়ে, কিন্তু রাজার তাতে সম্মতি ছিল না। কিছু বলতেও পারেন না। কী করা? একদিন রাজা সেই ছেলেকে নিয়ে শিকার করতে গেলেন। বেশ কয়েকদিন পরে তার হাতে একটি চিরকুট পাঠালেন রানীর জন্য। ছেলে সরল মনে রাজধানীতে ফিরল আর চিরকুটটি রাজকন্যার হাতে দিল রানীকে পৌঁছে দেবার জন্য। রাজকুমারী চিরকুট খুলে দেখে সেখানে লেখা আছে “পত্র পাওয়া মাত্র ছেলেকে বিষ দেবে”। রাজকন্যার নাম ছিল বিষে। সে চিরকুটে “বিষ”কে “বিষে” করে রানীকে দিল। রানী দেখলেন লেখা আছে “পত্র পাওয়া মাত্র ছেলেকে বিষে দেবে”। কী আর করা। রানী দ্রুত এই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন। তখন আমি ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। তাই এই ঘটনায় রাজকন্যার বুদ্ধিমত্তা আমাকে বেশ আলোড়িত করেছিল। পরে বুঝেছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসব হরহামেশাই ঘটে। না, এর জন্য সব সময় টেক্সট বদলাতে হয় না। শ্রোতা বা পাঠক বক্তা বা লেখকের কথা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করে। আর সেই ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে তার পরবর্তী পদক্ষেপ। এটাই যদি আজ হয় আমাদের চিন্তা ভাবনার মূলধারা তাহলে নিরপেক্ষ ভাবে কোন ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করা একেবারেই অসম্ভব। আর সেটা হলে জীবন থেকে এক সময় সত্য বিষয়টাই উধাও হয়ে যায়, থাকে শুধু নিজ নিজ ব্যাখ্যা। এটা অনেকটা ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মত। অথবা হতে পারে প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা আজকাল ভার্চুয়াল রিয়ালিটিকে অনেক বেশি বিশ্বাস করি, সেটাকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করি।

কোটা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে যখন সবাই কথা বলছে আমারও মনে হয়েছিল তিনি ভুল করেছেন, কোন রকম উস্কানি ছাড়াই ছাত্রদের ভুল ইঙ্গিত দিয়েছেন। পরে এক বন্ধু, যাকে কোন মতেই সরকার বা আওয়ামী লীগের সমর্থক বলা যাবে না, একটি ভিডিও পাঠাল। তাতে দেখলাম এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এটা বলেছেন। অর্থাৎ নিজে থেকে উস্কে দেননি, পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। আমরা সবাই প্রশ্ন করছি রাজপথ যখন গরম তখন এই প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার অসংখ্য পথ থাকতে তিনি সবচেয়ে বিপদজনক পথটি বেছে নিলেন কেন? মানুষ আবেগের বাইরে নয়, তবে তিনি সেখানে একজন শেখ হাসিনা নন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই তাঁর প্রতিটি কথার গুরুত্ব ভিন্ন। বিশেষ করে এ ধরণের পরিস্থিতিতে কেন ডিপ্লোম্যাটিক ভাষা ব্যবহার করা হল না। কিন্তু একই সাথে আমরা কখনোই এই প্রশ্নও করছি না কেন সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন ও উত্তর দুটোই পাশাপাশি না দিয়ে শুধু উত্তর দেয়া হল যখন যে কেউ নিজের ইচ্ছে মত এই উত্তরের ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই এটা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে করা তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্নটি কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত? কারণ এটা অনেকটা শাঁখের করাতের মত। ডিপ্লম্যাটিক্যালি এড়িয়ে গেলে সেটা সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারত। বিশেষ করে সরকার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে গেছে। তখন হয়তো ভিন্ন শিরোনামে এই সংবাদ আসত, সরকার আর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি দাড় করানো হত। তবে একটা কথা মনে হয় ঠিক তিনি যে উত্তরই দিন না কেন, এটা নিয়ে খেলা হত আর কোটা আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করা হত। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিরোধী দলের কাজই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, জনগণের কাছে তাকে হেয় করা। যেহেতু দেশে সুস্থ্য রাজনীতির পরিসর প্রচণ্ড রকম সীমিত সেহেতু তাদের বিভিন্ন আন্দোলনের লেজ ধরে নিজের কথাটি বলতে হয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে কোটা আন্দোলনের সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হওয়ার পেছনে সরকারের অবদান বিরোধী দলগুলোর চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। রুশরা বলে কথা হল চড়ুই পাখি, একবার বেড়িয়ে গেলে আর ফেরত আসে না। তাই কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সবারই খুবই সতর্ক হওয়া উচিৎ। অনেক সময় কথা কামানের গুলির চেয়েও বেশি বিধ্বংসী হতে পারে।

আজকাল প্রায়ই নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ করা হয়, তাদের বলা হয় আত্মকেন্দ্রিক, বলা হয় একাত্তর সম্পর্কে তাদের সঠিক কোন ধারণাই নেই। কিন্তু শিক্ষাক্রম থেকে যা কিছু বাঙালি জাতিস্বত্তার সাথে জড়িত তা তুলে দিয়ে কি কাউকে একাত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যায়? একাত্তর তো শুধু স্বাধীন ভূখণ্ড নয়, স্বাধীন ভাবে দুর্নীতি করার, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার লাইসেন্স তো নয়ই। একাত্তর মানে হাজার বছরের পুরানো বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, একাত্তর মানে এই মাটির গভীরে প্রোথিত যে মূল সেটাকে অবলম্বন করে বিকশিত হওয়া। আমরা একদিকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কথা বলব আর অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করব, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরী, সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের পরিবর্তে মডেল মসজিদ গড়ে তুলব আর চাইব জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ মুক্ত বাংলাদেশ – সেটা তো হয় না। আমরা যা চাই তা পেতে হলে সঠিক পথে চলতে হয়। তার জন্য খড়কুটা পুড়াতে হয়। আমরা কাজ করব একরকম আর ফলাফল চাইব অন্যরকম – সেটা তো হয় না।

শেষ পর্যন্ত কোটা আন্দোলন সফল হয়েছে। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু কী মূল্যে? মেট্রো রেল, বিটিভি, সেতু ভবন এসব নিঃসন্দেহে জাতীয় সম্পদ, কিন্তু মানুষ – মানুষ কি জাতীয় সম্পদ নয়? বাঙালি যদি না থাকে ভাষা থাকবে কি? থাকবে কি বাংলাদেশ? এত ঘটনার পরে থাকলেও কেমন থাকবে দেশ? কেমন হবে সেই বাংলাদেশের চেহারা? শত মৃত্যুর রেশ ধরে আমরা অনেকেই সবাইকে পথে নামতে বলছি। বলছি গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগ করতে। বাঙালি তো যুগ যুগ ধরেই আত্মাহুতি দিয়ে আসছে। ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তান আমলে, স্বাধীন দেশে। বাহান্নর শহীদদের পরিবারের খোঁজ কেউ রাখে? কোথায় আছে নূর হোসেনের পরিবার? ১৪ ফেব্রুয়ারি কেউ আর দীপালি সাহাদের স্মরণ করে না, ভালোবাসা দিবস পালন করে। আজ আমাদের এই যে চাকরির কোটা নিয়ে আন্দোলন সেই চাকরির অধিকার কে এনে দিয়েছে? মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি আমরা তাঁদের মেধাবী সন্তানদের (মেধাবী, কারণ তারা মেধা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই কোটায় আসার যোগ্যতা অর্জন করে) কয়েকটি কোটা পর্যন্ত দিতে পারি না, কিন্তু নতুনদের রাস্তায় ডাকি যখন নিজেরা, নিজেদের সন্তানরা ইউরোপ আমেরিকায় বসে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি। সবচেয়ে দুঃখজনক যেটা তা হল আজ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আরও বেশি দ্বিধাবিভক্ত। যে মুক্তিযুদ্ধ তাদের এক করে আজ সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা প্রশ্নই তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে।

আমাদের সমস্যা হল আমরা শুধু অন্যদের কাছে জবাবদিহিতা আশা করি কিন্তু নিজেরা নিজের কাজের জবাব কাউকে দিতে চাই না। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে সবাইকে, সব রাজনৈতিক দলকে, তা সে সরকারি দল হোক আর বিরোধী দল হোক। কোন দল যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দল বলে মনে করে তাদের দলের ভেতরে  যেমন গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, কোন দল নিজেদের সমাজতন্ত্রী বা সাম্যবাদী দাবি করলে তাদেরও এমন ভাবে রণকৌশল ঠিক করতে হবে যাতে তাদের রাজনীতি দেশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে তুলে না দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মনে রাখা দরকার যে দলের বাইরেও প্রচুর মানুষ এসব আদর্শ ধারণ করে। তাই তাদের অধিকার নেই রাজনীতির নামে হাজার হাজার মানুষের আদর্শ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার, যেমন সে অধিকার নেই সেই সব মানুষদের যাদের উপর এই সাধারণ মানুষ আস্থা রাখে বা রাখতে চায়। রাজনীতির জন্য রাজনীতি নয়, আদর্শের জন্য রাজনীতি – এই আদর্শ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। যদি এখন রাজনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা না যায় আমাদের পক্ষে আর কখনোই সেটা সম্ভব হবে না। সুযোগ বার বার আসে না।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৯): লাল বিপ্লব -বিজন সাহা

বিশ্বাসঘাতক মনে হয় এমন কেউ যখন অন্য কারো বিশ্বাসের প্রতিদান দেয় না, যেমন মীর জাফর বা খন্দকার মুশতাক। কিন্তু মানুষ যদি নিজের বিশ্বাসের সাথে বেইমানী করে অথবা হয়তো নিজের অজ্ঞাতেই হাজার মানুষকে ভুল জায়গায় নিয়ে আসে তখন কি সে বিশ্বাসঘাতক নয়? এই যে আমরা আজ কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংস যজ্ঞ নিয়ে কোন এক পক্ষ নিচ্ছি সেটা তো বুমেরাঙ্গ হতে পারে। কারণ এখন পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ – যেকোনো ধরণের আচমকা পরিবর্তন বা সরকার পতন ক্ষমতার দ্বার খুলে দেবে আর তাতে যে কেউ ক্ষমতা দখল করবে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির দিকে তাকালে মনে হয় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি উগ্র ধর্মীয় দলগুলোর। আমি বলছি না যে তারা খারাপ। হয়তো অনেকের কাছেই তারা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমার নিজের তো কিছু পছন্দ অপছন্দ আছে। তারা আমার পছন্দের নয় আদর্শিক কারণে। সেটা তারা যে ধর্মের প্রতিনিধিই হোক না কেন। যদি আজ আমার অন্ধ সরকার বিরোধিতা এদের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করে দেয়, যারা আমার কথা বিশ্বাস করে, আমার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একটি সরকার পায় তাহলে কি এর জন্যে আমি একটুও দায়ী হব না? এটা কি নিজের প্রতি, নিজের বিশ্বাসের প্রতি, আমার মত হাজার হাজার মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে না? তাই বলে কি আমি যে সরকারের ভুলের জন্য এতগুলো প্রানহানি ঘটলো তার বিচার চাইব না, সরকারের মানুষ হত্যার জবাব চাইব না? চাইব। তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি শান্ত হবার জন্য অপেক্ষা করব। যখন বুঝব এখন আর ঘোলা জলে মাছ শিকারের সম্ভাবনা নেই তখন প্রয়োজনে সরকারের পদত্যাগের দাবি তুলব। আর এখন আমার কাজ হবে এই ঘটনার যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষা তদন্ত হয় এবং সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয় সেই পরিবেশ তৈরিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। রাজনীতিতে আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রননীতি রণকৌশল তৈরির জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ফেসবুক ভরে গেছে লালে। এটা রাষ্ট্রীয় শোকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – লাল শোক। তবে কালো শোক যে একেবারেই ছিল না তা নয়। তাই দেখে মনে হল

লাল আর কালোয় লেগেছে আজ লড়াই
আমিই সঠিক – করছে দু’ জন বড়াই

কালো শোক নিয়ে বলব না। অনেকেই বলেছে। তাই লাল নিয়ে কথা। সব লাল কি একই রকম লাল ছিল? ছোটবেলা থেকে শুনেছি

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল

ভিতরে সবারই সমান রাঙা।

কিন্তু যতই বড় হয়েছি তত বেশি করে টের পেয়েছি সব লাল সমান লাল নয়। হাসপাতালে না হলেও সমাজে রক্তের বর্ণ আছে, ধর্ম আছে, জাত আছে আর এই রক্ত নিয়ে আছে মারামারি কাটাকাটি। ফেসবুকের প্রোফাইলে এই লালের আছে বিভিন্ন শেড। কোনটা কোটা আন্দোলনে নিহতদের রক্তে রঞ্জিত, কোনটা অধরা বিপ্লবের রং যার ভেতর কাস্তে হাতুড়ী শোভা পাচ্ছে, আবার কোনটা ভবিষ্যতে লাল সবুজের পরিবর্তে লাল পতাকার ডাক, সাথে নতুন জাতীয় সঙ্গীত। প্রতিটি লালের আছে নিজস্ব এজেন্ডা, নিজস্ব লক্ষ্য – কখনও কখনও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এখন সবাই জয়ের স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু জয়ের পরে শুরু হবে নতুন লড়াই, আসল লড়াই, নির্দয় লড়াই, অস্তিত্বের লড়াই। সেই লড়াইয়ে আমরা প্রস্তুত তো?

সমাজ বদলে গেছে, বদলে গেছে জীবন ভাবনা। একাত্তরের লড়াই ছিল সমষ্টির লড়াই সমষ্টির জন্য। এখন সমষ্টির লড়াই ব্যক্তির জন্য। তখন পাশাপাশি লড়াই করে প্রত্যেকে শুধু নিজের নয়, পাশের মানুষটির জন্যেও স্বাধীনতা চেয়েছিল, সে ছিল তার আজীবনের সহযোদ্ধা। কোটা আন্দোলন সমষ্টির হলেও সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী। আজ যারা সহযোদ্ধা চাকরির বাজারে তারাই একে অন্যের বিপরীতে দাঁড়াবে। এমনকি যদি সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় সেটাও কোন না কোন দলের জন্য ক্ষমতার লড়াইই হবে। যদি ৭১ এর মত একটা যুদ্ধ করতে চাই যা হবে সমষ্টির জন্য সমষ্টির লড়াই তবে সেটা হতে পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। কিন্তু কথা হল আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত কিনা সেই লড়াইয়ে। কারণ কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল সবাই আজ দুর্নীতি গ্রস্থ, দুর্নীতি দ্বারা পুষ্ট। সমস্ত রাজনৈতিক দলই কোন না কোন ভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত। তা সে  চাঁদাবাজি হোক বা অন্য কিছু। এরকম লড়াই হতে পারে আইনের শাসনের জন্য লড়াই – যখন দল, ধর্ম এসব দেখে অপরাধীর বিচার হবে না, বিচার হবে অপরাধ দেখে। আমরা জাতি হিসেবে সেটা চাই কি না সেটাই বড় প্রশ্ন।

রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ চায় শান্তি, চায় কাজের নিশ্চয়তা। দেশ কোন পথে চলবে এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা কম। তারা চায় ফসলের ন্যায্য দাম, তারা চায় কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক, চায় কষ্টার্জিত পয়সায় দুই বেলা পেট ভরে খাওয়ার নিশ্চয়তা। আমরা গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য আজ মাঠে নামতে বছি, নামতে বলছি জনগণের স্বার্থে। কিন্তু দেশ অচল হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ তাদের রুটি রুজি হারাচ্ছে, নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় এমন লাখ লাখ মানুষ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। আমরা কি তাদের কথা একবার ভেবেছি?

আর এ জন্যেই দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তাই যেকোনো যুক্তি সম্পন্ন মানুষের আজ দাবি হওয়া উচিৎ দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা, জনজীবনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। রাজনৈতিক আবহাওয়া দূষণ মুক্ত করা। আজ আমরা প্রায়ই বিকল্পের কথা বলি, কিন্তু বিকল্প এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, সেটা তৈরি করতে হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে মহাবিশ্বে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে – ক্ষমতা থেকে, জীবন থেকে। তাই আগে থেকেই যদি বিকল্প শক্তি তৈরি করা না যায় তাহলে পতনের পরে হাত বাড়িয়ে দেবার কেউ থাকবে না। দশ বছরের বেশি আগে শাহবাগ আন্দোলনের সময় লিখেছিলাম এই সুযোগে স্বাধীনতার পক্ষের এক বিকল্প বিরোধী শক্তি তৈরি করা দরকার। কিন্তু ক্ষমতার লোভে অন্ধ সরকার তখন সেটা করেনি। যখন বন্ধুরা বলেছে আওয়ামী লীগ গেলে কে আসবে জানিস, বলেছি জুজুর ভয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি এই নিঃশর্ত সমর্থন তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। কারণ নেগেটিভ সমর্থন কখনও পজিটিভ ফল আনে না। সেটা কিছুদিনের জন্য সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে রাখে কিন্তু সমস্যার মূল উতখাৎ করে না। আর আমাদের বড় সমস্যা সত্যিকারের রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতি যারা উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থনীতি আর নিজের পকেট বুঝবে না, বুঝবে জাতি হিসেবে আমাদের শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতির সার্বিক উন্নতি।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো