মতামত

রাজনৈতিক দলের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার নেতিবাচক প্রভাব ও গণতন্ত্রের গুরুত্ব

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

একটি রাজনৈতিক দল যদি একাধারে অনেক বছর ধরে ক্ষমতায় থাকে, তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা, স্বৈরতন্ত্র, সুবিধাবাদ, এবং হাইব্রিড আচরণ ভর করে। এসব প্রবণতা ধীরে ধীরে দলটির জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ণ করে এবং দলটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করা গেছে, যেখানে জনপ্রিয় দলগুলো ক্রমান্বয়ে জনগণের আস্থা হারিয়েছে এবং একসময়ে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরতন্ত্রের প্রভাব

দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। স্বেচ্ছাচারিতা বলতে বোঝায় এককভাবে বা দলীয়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার। স্বৈরতন্ত্র হল এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে সাধারণ মানুষের মতামতের গুরুত্ব কমিয়ে ফেলা হয় এবং একক ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে, গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায্য নির্বাচন, এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।

সুবিধাবাদ ও হাইব্রিড আচরণ

দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতার আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব হলো সুবিধাবাদ ও হাইব্রিড আচরণ। সুবিধাবাদীরা নিজেদের স্বার্থে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, ফলে দলের আসল উদ্দেশ্য ও আদর্শ বিকৃত হয়। হাইব্রিড আচরণ বলতে বোঝায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের মিশ্রণ, যা শেষ পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট আদর্শে স্থিতিশীল থাকে না এবং জনগণের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।

দল পরিবর্তন ও পরিশুদ্ধি

এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি কার্যকর উপায় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে নিয়মিত ক্ষমতার পরিবর্তন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি সম্ভব, যেখানে ক্ষমতা পরিবর্তনের দায়িত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। জনগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সঠিক সময়ে সঠিক দলকে ক্ষমতায় আনতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বিরোধী দলে পাঠাতে পারে। এর ফলে দলগুলি নিয়মিতভাবে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতে বাধ্য হয় এবং জনগণের আস্থা ও সমর্থন ফিরে পেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশের পরিচালনা

একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ পরিচালনার কিছু মৌলিক নীতিমালা ও উপাদান রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. মত প্রকাশের স্বাধীনতা

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। জনগণকে তাদের মতামত ও চিন্তাভাবনা প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। এটি নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যমের প্রয়োজন।

২. ন্যায্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন

নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করতে পারে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া যাতে কোন প্রকার দুর্নীতি বা প্রতারণামুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. আইন ও শৃঙ্খলা

একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশে সবার জন্য সমান আইন প্রযোজ্য হবে। বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে, যাতে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা না পায়।

৪. মানবাধিকার

মানবাধিকার সংরক্ষণ একটি গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য, ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. শক্তিশালী বিরোধী দল

গণতন্ত্রে শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজন, যারা সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরবে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে। বিরোধী দল সরকারের কার্যক্রমে নজরদারি করবে এবং বিকল্প নীতিমালা প্রণয়নে সাহায্য করবে।

উপসংহার

একটি দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। ক্ষমতা পরিবর্তনের দায়িত্ব জনগণের হাতে থাকা উচিত, যাতে তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিশুদ্ধ হতে হবে এবং জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হবে। এতে করে দেশ পরিচালনা আরও কার্যকর এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)