বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা হাজির করব, শহীদ মিনারে সমন্বয়ক নাহিদ
সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে একটি সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করার কথা জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা এ–ও জানিয়েছে, সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা সবার সামনে হাজির করবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত জনতার উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেন সংগঠনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তাবাহিনীকে সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় একত্র হন বিপুলসংখ্যক মানুষ। একপর্যায়ে সেখানে যান আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, আবদুল কাদেরসহ অনেকে। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজন প্রায় এক সপ্তাহ ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে ছিলেন।
সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে নাহিদ ৯ দফার বদলে নতুন এক দফা দাবি তুলে ধরেন। নতুন দাবি হলো, সরকারের পদত্যাগ। এ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আজ রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সর্বস্তরের জনগণকে আমরা অসহযোগে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এই সরকারের সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করব না।’
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রুতই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা আমরা সবার সামনে হাজির করব’, বলেন নাহিদ।
সমবেত মানুষের উদ্দেশে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হায়েনারা আমাদের বোনদের ওপর নির্মমভাবে হামলা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে আমাদের শাটডাউন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন শুরু করে। পুলিশ পিছু হটলে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ থামানো যায়নি।’
নাহিদ বলেন, ‘১৯ জুলাই থেকে আমাদের সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার ও জবরদস্তি করে আন্দোলন প্রত্যাহার ও সরকারের সঙ্গে সংলাপ করতে বলা হয়। পরে হাসপাতালে আমাদের জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সেটাও না পেরে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে জিম্মি করে আমাদের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া হয়। সেই বক্তব্য বিশ্বাস না করে রাজপথ দখলে রাখায় আপনাদের ধন্যবাদ।’
ডিবি কার্যালয় থেকে সমন্বয়কদের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আপনাদের আন্দোলন ও আমাদের অনশনের কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল।… এই যে এতগুলো খুন হয়েছে; যারা খুন করেছে, তারা খুনের কী বিচার করবে? আমরা তাদের কাছে খুনের বিচার প্রত্যাশা করি না। আজকে সর্বস্তরের নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের ব্লক রেইড (এলাকা ঘিরে রেখে অভিযান) দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, গুম ও নির্যাতন করা হচ্ছে।’
আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন ঘেঁটে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, একদিকে গ্রেপ্তার, নিপীড়ন ও নির্যাতন, অন্যদিকে সংলাপের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে।
নাহিদ বলেন, ‘আমাদের জন্য বাংলাদেশের জনগণ নেমে এসেছিলেন। জনগণকে মুক্ত করতে আমরা আবার রাস্তায় নেমে এসেছি। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এক দফাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে, মন্ত্রিসভাসহ পুরো সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।’
সব রাজবন্দীর মুক্তি নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, ‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর যেন কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে। আমাদের এক দফা দাবি আদায়ে আমরা ছাত্র-নাগরিকের অভ্যুত্থান আহ্বান করছি।’
নাহিদ আরও বলেন, ‘জীবনের বিনিময়ে, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এই লড়াই আমরা সবাই চালিয়ে যাব। জনগণকে আমরা আহ্বান করছি, যে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে, তার সঙ্গে এসে যোগ দিন। পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় সংগঠিত হোন।’
সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে নাহিদ বলেন, ‘সর্বস্তরের জনগণকে আমরা অসহযোগে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এই সরকারের সঙ্গে আমরা সহযোগিতা করব না।’
‘আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত—এগুলো বুঝি না। আমাদের বিভক্ত করা যাবে না। আমরা মনে করি, শেখ হাসিনার সরকার ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশ থেকে বিদায় করতে হবে। একটা ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। দলমত–ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের এই ঐক্যবদ্ধ জায়গায় আসতে পারে। এখানে যাতে কোনো বিভক্তির সুযোগ সরকার না পায়, সেই সুযোগ যেন আমরা সরকারকে না দিই’, যোগ করেন নাহিদ।