বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৯): লাল বিপ্লব

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটিত হল – লাল বিপ্লব। হ্যাঁ, শোক দিবসের কালো রঙ লালে লাল করে দিল ফেসবুক। লৌহ মানবী শেখা হাসিনা লাখ লাখ মানুষের প্রতিবাদের মুখে শুধু ক্ষমতাই ছাড়লেন না, দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন জীবন বাঁচাতে। সেই বিপ্লবের রেশ এখনও কাটেনি। যে হত্যা বন্ধ করতে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, যে ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মানুষ বিপ্লবে সামিল হয়েছিল – সেই ত্রাস, সেই হত্যা, সেই ধ্বংস যজ্ঞ চলেছে দেশব্যাপী। ভেঙ্গে পড়েছে আইন শৃঙ্খলা; জাতীয় সংসদ, গণ ভবন, ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর কিছুই রক্ষা পায়নি, রক্ষা পায়নি ইতিহাস। কেনই বা পাবে। আজ নতুন ইতিহাস লেখার দিন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা ম্লান হয়ে গেছে ২০২৪ সালের “স্বাধীনতা”র কাছে।

হাসিনা সরকার পতনের আগে লিখেছিলাম সরকার, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ – এদের ভুলে শত শত প্রাণ ঝরেছে। সব হত্যার বিচার চাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার। একে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন গড়ে উঠছে তার লক্ষ্য হোক মৃত্যুকে না বলা। সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের অতি উৎসাহ যেন কোনোভাবেই আরও বেশি রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে রূপান্তরিত না হয়, নতুন নতুন লাশ সরবরাহের কারখানা না হয়। সেটা হলে তার দায়িত্ব কিন্তু নিতে হবে আন্দোলনকারীদের। দেশকে রণাঙ্গনে পরিণত করা কি এখন এতটাই জরুরি? সব যুদ্ধ শেষ হয় হয় আলোচনার মাধ্যমে অথবা প্রতিপক্ষের সমূলে বিনাশের মাধ্যমে। দ্বিতীয় পথ কাম্য নয়। এটা ধ্বংসের পথ। আর আলোচনার জন্য দরকার সব পক্ষের গ্রহণযোগ্য বাস্তবসম্মত যৌক্তিক দাবি উত্থাপন। কী সেই দাবি? অবাধে অহিংস রাজনীতি করার পরিবেশ ও সংস্কৃতি সৃষ্টি। কারণ একমাত্র সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্থ ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গড়ার পথ করে দেবে। এখন দেশের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা এরকম রাজনৈতিক শক্তির অভাব। আলোচনার পথ খুঁজুন। মনে রাখবেন শুধু ভেতরে ঢোকার জন্য নয়, বাইরে বেরুনোর জন্যেও খোলা দরজা দরকার আর দরকার নিরাপদে প্রবেশ ও প্রস্থানের নিশ্চয়তা। কিন্তু আমরা মনে হয় সবাই অভিমন্যু – শুধু প্রবেশের পথ জানি, নির্গমনের পথ আমাদের জানা নেই। সেটা আবারও প্রমানিত হল। জনতার বিজয় দেশের পরাজয়ের কারণ হল। আমরা অনেক দিক থেকেই অনেক বছর পিছিয়ে গেলাম। জানি এসব কথা এখন অতীত। তবে অভিজ্ঞতা বলে আমাদের দু’ দিন আগে হোক আর দু’ দিন পরে হোক আবারও এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এজন্যেই পুরানো কথা আবারও বলা, কাজে লাগতে পারে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে একে একে এসেছে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯২, ২০১৩। শেষ এলো ২০২৪। ১৯৭১ সালে আমাদের উপর স্বাধীনতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমরা মনে হয় সব অর্থে সেজন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তাই বার বার নতুন করে পথে নামতে হয়। এবারও আমাদের উপর ওপর থেকেই এই “স্বাধীনতা” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই অনেকটা প্রস্তুতিহীন ভাবেই অনেক কিছুর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। হতে পারে যে পেছন থেকে যারা উৎসাহ দিয়েছেন তাদের অনেকেই এটা জানতেন, কিন্তু ছাত্র জনতার বেশির ভাগ মানুষই সরকার পতনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর এ কারণেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় খেতে বাধ্য হলেও সব কিছু ঠিক হজম হচ্ছে না।

রাশিয়ায় এক সময় একটি কথা প্রচলিত ছিল – যে রাজনৈতিক দলই গঠন কর না কেন এক সময় সবই সিপিএসইউ (কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন) হয়। বাংলাদেশের অবস্থাও তাই। যুদ্ধ হোক, গণ অভ্যুত্থান হোক, নির্বাচন হোক আর সামরিক অভ্যুত্থান হোক – যে পদ্ধতিতেই সরকার গঠন হোক না কেন এক সময় সবই স্বৈরাচারী রূপ নেয়। এ যেন এক দুষ্ট চক্র। এর সাথে আছে “হয় তুমি আমার সাথে না হলে আমার বিরুদ্ধে” – রাজনীতিতে এই তত্ত্বের প্রয়োগ যা সমাজকে বারবার সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর হাজার পথের সবগুলো যে পরস্পর বিরোধী নয় বরং ভিন্ন পথে চলমান অনেকেই সহযাত্রী হতে পারে সেই সত্য বুঝতে না পেরে একদল যেমন অনেককে শত্রু শিবিরে ঠেলে দেয়, আরেক দল তেমনি শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এই তত্ত্বে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে শত্রু শিবির ভারি করে। মূখ্য লক্ষ্য যখন ক্ষমতা, দেশ আর মানুষ সেখানে গৌণ। এ যুদ্ধে যেই জিতুক সে পায় ক্ষত বিক্ষত মৃতপ্রায় এক মা যে আমার দেশ। যে দেবতার জন্য এত লড়াই সেই দেবালয়ে আগুন দিয়ে দেবতাকে গৃহহীন করার আগে আবারও আমাদের ভাবা উচিৎ ছিল। ভাবিনি। সুস্থ চিন্তা এখনও পর্যন্ত কাউকে বিট্রে করেনি। কিন্তু আমরা চিন্তা করতেই ভুলে গেছি, সুস্থ চিন্তা তো দূরকে বাৎ।

ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর হলেও ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ তা চায় না। তাই যে যেভাবে পারে দেশ ছেড়ে চলে যায়। আর যাদের সেই সুযোগ নেই তাদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হয় উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে। এদের বেশিরভাগ মারা যায় যুদ্ধ শুরু না করেই। যারা আত্মসমর্পণ করে জীবন রক্ষা করতে চায় তাদের ইউক্রেনের সেনারাই পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। এটা ঘটছে সেই ২০২২ সাল থেকেই। এর একটাই কারণ এই সেনারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে যারা তাদের হাতে জিম্মি। কেন যেন মনে হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা জিম্মি তাদের বর্তমান সাফল্য আর আন্দোলনে যোগদান কারী লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাছে এবং পেছন থেকে যেসব রাজনৈতিক দল উস্কানি দিয়েছে তাদের কাছে। যেকোন আন্দোলনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। সেটা অর্জনের পরও যদি আন্দোলন চলে তাহলে সমস্ত অর্জন হারানোর তো বটেই আরও অনেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। সব সমস্যার হাজারটা সম্ভাব্য সমাধান থাকে। জয় বা পরাজয় দুটোই সমাধান। সব আমাদের পক্ষে যাবে তার কোন কথা নেই। বিচক্ষণ মানুষ সময় মত থামতে জানে আর অর্জিত সাফল্যের উপর দাঁড়িয়ে উপযুক্ত সময়ে নতুন লড়াইয়ে নামতে জানে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় এরাই জেতে। একাত্তর তার জ্বলন্ত প্রমাণ বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তরের পরে। মনে হতে পারে এখন এসব অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু শীত তো এক মাঘেই যায় না। সামনে আরও বড় লড়াই। দেশ গড়ার লড়াই। আমাদের গতকালের বন্ধু আজ প্রতিপক্ষ। তারা আমাদের ক্ষমতার ভাগ দিতে লড়াই করেনি, সাথে থেকেছে সময় মত আমাদের অপরিপক্ক হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে। সেই অর্থে এখন হাসিনা বিরোধী শিবির দ্বিধা বিভক্ত। সবাই সবার সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত। তাই এখনকার লড়াই হবে আরও কঠিন, আরও নির্মম।

আমাদের সমস্যা অনেক। স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, দুর্নীতি …..। তারচেয়েও বড় সমস্যা হল অধিকাংশ মানুষ একসাথে এই সবগুলো সমস্যার সমাধান চায় না। দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়ায় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বিজয়ের পরেও সংখ্যালঘুরা আতঙ্কগ্রস্ত। স্বৈরাচার গেছে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা যায়নি। এই শক্তি এখন দ্বিগুণ উৎসাহে বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করছে। আমার স্বৈরাচার বিরোধী প্রগতিশীল বন্ধুদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে তারা কি আন্দোলনের এই বাই প্রোডাক্টের বিষয়ে আগে থেকে কিছু ভেবেছিলেন? ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ও আপনার স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এক হলেও তার ফলাফল দুজনের জন্য ভিন্ন। কীভাবে সেটাকে সবার জন্য এক করা যায় সেটা ভেবেছেন কি? ভাবুন। এখন প্রচুর সময় পাবেন। অনেকের ইদানিং কালের স্ট্যাটাস দেখে মনে হয় তারা এসব আগে ভাবেননি। ভাবেননি বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল আবেদীন, সাত বীরশ্রেষ্ঠ এরা সবাই ভূলুণ্ঠিত হবেন। আগে থেকে এসব নিয়ে ভাবলে হয়তো এতটা তাণ্ডব ঘটত না। কারণ দিনের শেষে আমরাই রিসিভিং এন্ডে থাকি, আমাদের কাঁধে পা রেখে আমাদের আদর্শিক শত্রুরা বিজয়ের ফসল চুরি করে নিয়ে যায় ঠিক যেমন দেবতারা চুরি করেছিল দানবদের মন্থন করা অমৃত।

যেকোনো যুদ্ধের দুটি মূল কথা হল সেটা কার বিরুদ্ধে ও কিসের লক্ষ্যে। কোটা আন্দোলন কার বিরুদ্ধে সেটা পরিষ্কার থাকলেও কিসের লক্ষ্যে সেটা পরিষ্কার ছিল না। মানে লক্ষ্য যাই হোক সেটা অর্জনের রূপরেখা জন সম্মুখে আসেনি আগে থেকে। হাসিনা সরকারের পতন কোন সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হতে পারে না। হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেই অটোম্যাটিক্যালি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা বিদায় নেয় না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, জনগণের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। ভারত ভাগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এদেশে বহু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, একটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রতিবারই শাসকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলেও একমাত্র স্বাধীনতা ব্যতীত আর কোন লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। কারণ লক্ষ্যগুলো আন্দোলনের স্বার্থে কখনো কখনো উচ্চারিত হলেও সেটা অর্জনের জন্য কোন বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনও আন্দোলনকারীদের অবস্থান স্পষ্ট নয়। উল্টো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে ইসলামী শাসনের কথা কেউ কেউ বলছে আর যারা বলছে তারা যে আন্দোলনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পেছন থেকে ব্যবহার করেছে সেটা আজ স্পষ্ট। বাংলাদেশের দেড় কোটির বেশি বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘুদের ভাগ্য কোন ভাবেই হিসেবে আসেনি। তাই নামে বৈষম্য বিরোধী হলেও সবার স্বার্থ এখানে সমান ভাবে দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর ঘটে যাওয়া হামলা সাম্যের আশা জাগায় না। দুই এক জায়গায় উগ্রপন্থীদের হাতে বামপন্থী  নেতাদের হত্যার খবর পাওয়া গেছে। বিপ্লব সফল হবার পরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী অনেক মারা গেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে খবর এসেছে। তাই যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে জাহির করেন তাদের আন্দোলনের আগুনে কেরোসিন ঢালার আগে এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার কথা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা উচিৎ ছিল। কিন্তু তারা আবারও চোখে লাল পট্টি বেঁধে সব দেখার চেষ্টা করেছেন, স্বপ্নে বিভোর হয়ে এক সময় স্বপ্নটাই হারিয়ে ফেলেছেন।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৮): বিচ্ছিন্ন ভাবনা -বিজন সাহা  

২০১৪ সালে ইউক্রেনে ময়দানে বিরোধীরা লড়াইয়ে নামে ইনুকোভিচের বিরুদ্ধে। ইস্যু ছিল ইউক্রেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়া নিয়ে। এদিকে রাশিয়া প্রস্তাব দিয়েছিল ইউরেশিয়ায় যোগ দেয়ার জন্য। ইউক্রেন তখন রাশিয়ার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বানিজ্যিক সুবিধা পেত। ইউক্রেন একই সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরেশিয়ায় থাকলে ইউরোপীয় পণ্য বিনা শুল্কে রাশিয়ার বাজারে আসবে তাই রাশিয়া ইউক্রেনকে বলে হয় নিরপেক্ষ থাকতে অথবা কোন একটা দিক বেছে নিতে। ইনুকোভিচ শেষ মুহূর্তে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে চুক্তি না করায় পশ্চিমা পন্থী, বিশেষ করে ফ্যাসিবাদীরা ময়দানে নামে ও কিছু লোক হত্যা করে যেটা এখন নিজেরাই স্বীকার করে। সেই সময় স্পেশাল ফোর্সের উপর আক্রমণ হলেও ইনুকোভিচ তাদের অস্ত্র প্রয়োগে বাধা দেন মৃত্যু এড়ানোর জন্য। ফলাফল – এক কোটির বেশি মানুষ আজ দেশত্যাগী, লাখ পাঁচেক মৃত। অনেকের ধারণা ইনুকোভিচ কিছু রক্ত এড়াতে গিয়ে এক সাগর রক্ত ঝরিয়েছেন। গল্পটা এ জন্যেই বলা যে সময় মত সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক দিনে বাংলাদেশে এমনটা যে ঘটবে না সেই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। অভ্যুত্থান অনেকটা করোনা ভাইরাসের মত। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও বেশি ভয়ঙ্কর। যত দূর জানি এই আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পরের মৃতের সংখ্যা পতনের আগের মৃতের সংখ্যাকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। সারা দেশের থানা আক্রান্ত হয়েছে, ডাকাতি হয়েছে মহল্লার পর মহল্লা, পুড়ছে মন্দির, মাজার, পুড়ছে ঘরবাড়ি। বিশেষ করে আক্রমণের শিকার হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুরা। শুনেছি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় অফিসের সামনে মালিকের পাপেট রাখা হয় যাতে ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা কিল ঘুষি দিয়ে ক্ষোভ মেটাতে পারে। বাংলাদেশেও এখন মোড়ে মোড়ে এরকম কৃত্রিম হিন্দু পাড়া গড়ে তোলা দরকার যাতে বিজয়ী বিজিত সবাই সেখানে আগুন দিয়ে বা ভাঙচুর করে মনের জ্বালা মেটাতে পারে। এতে অন্তত রক্তক্ষয় হবে না। তাছাড়া এভাবে চললে দেশ একদিন হিন্দু শূন্য হবে। সেদিক থেকে এটা হবে খুব দূরদর্শী এক পদক্ষেপ।

ইতিমধ্যে প্রফেসর ইউনুস অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন। অনেকেই বলছে যতদিন প্রফেসর ইউনুস গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন ততদিন আমি তাঁকে সমর্থন করব। তিনি স্বৈরাচারী আচরণ করলে তাঁর বিরোধিতা করব। তিনি শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ। এজন্য তাঁর প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তবে তিনি কতটুকু বাংলাদেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন আর কতটুকু আন্তর্জাতিক পুঁজির সেটা ভবিষ্যত বলবে যদিও এ ব্যাপারে তাঁর স্বাধীনতা সন্দেহাতীত নয়। আর যারা সমর্থন বা বিরোধিতার কথা বলছেন তাদের সামর্থ্য এটুকুই। এটা অনেকটা কোন কোটিপতি কাঙালি ভোজ দিলে ফেসবুকে তার প্রশংসা করা আর অন্য কোটিপতিদের নিয়ে পার্টি দিলে ফেসবুকে তার নিন্দা করা। কিন্তু আসল যে কথাটি আপনারা ভুলে যান তা হল কাঙাল না কোটিপতি কাদের আমন্ত্রণ জানাবে সে ব্যাপারে কেউ আপনাদের মতামত জানতে চায় না, চায়নি, চাবে না। দূর থেকে লাফানোই আপনার আনন্দ। আমরা ভুলে যাই ইমরান খানের কথা, ভুলে যাই বিগত দিনে ভারত, রাশিয়া ও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা, ব্রিকসে যোগদানের ইচ্ছার কথা, অপেক্ষাকৃত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কথা, বিশেষ করে রাশিয়া প্রশ্নে। অনেকের ধারণা এই আন্দোলনের পেছনে আমেরিকার মদত আছে। আর সেটা ভাবার পেহনে জোরালো যুক্তিও আছে। তাই বর্তমানে যে দেশে প্রো-আমেরিকান শাসন প্রতিষ্ঠা হবে তাতে সন্দেহ নেই। আর যে দেশ একবার আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধে তাদের ভাগ্যের ইতিহাস কমবেশি সবার জানা। আমেরিকা তার কোন বান্ধবীকে বৌয়ের মর্যাদা দেয় না আবার হারেম থেকে সহজে পালাতেও দেয় না। তাদের একটাই কাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মালিকের মনোরঞ্জন করা। সাধে কী বলে আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর অভাব নেই। আমি বলি আমেরিকার বন্ধুত্বও দিল্লিকা লাড্ডু – বন্ধুত্ব করলেও পস্তাবে, না করলেও পস্তাবে। তবে না করার সুবিধা একটা – অন্তত আগে থেকেই সতর্ক থাকতে পারবে।

তলস্তোইকে বলা হয় রুশ বিপ্লবের দর্পণ। যেকোনো ভালো সাহিত্যিক একজন ভালো মনস্তাত্ত্বিক, সমাজের পালস খুব ভালো করে বোঝার কথা তার। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের চিন্তার অগভীরতা দেখে অবাক হই। দেশে নদী-নালার সাথে সাথে এদের চিন্তা ভাবনার খালবিলও শুকিয়ে গেছে। এই যে একের পর এক রাষ্ট্রনায়করা স্বৈরাচারী হন তা দেখে কি মনে হয় না আমাদের সামাজিক দর্শনের ভেতরে সেটা লুকিয়ে আছে। অরাজকতা, অন্যের জিনিস দখল, ভাঙচুর করা, প্রতিবেশীকে ভিটেমাটি ছাড়া করা এটা আমাদের অস্থিমজ্জায়। আর তাই বারবার আমরা লক্ষ্যচ্যুত হই। ঘৃণা দিয়ে শুধু ধ্বংস করা যায়, সৃষ্টির জন্য চাই ভালোবাসা। এত ঘৃণা জমে আছে বাঙালির মনে সেটা যেন একদিন দেশটাকেই ভাসিয়ে নিয়ে না যায়। সময় মত হাল ধরতে না পারলে ভালোবাসা একদিন যখন মনে জাগবে তখন আর যার উপর সৃষ্টি হবে সেই ভিতটাই থাকবে না। আমরা এসব নিয়ে কথা না বলে বার বার শুধু সরকার বদলাই। জনগণ ও সরকার পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফল পেতে চাইলে সবার আগে সামাজিক মনস্তত্ত্ব বদলাতে হবে। আমাদের চাওয়া পাওয়ার হিসেব বিশ্বের সব দেশের মতই, হয়তো একটু বেশি। তাই আন্দোলনের ফসলের সুষম বণ্টন হয়নি, হবে না। আবারও কেউ সেই ফলাফলের উপর দাঁড়িয়ে সব পেয়েছির দলে যাবে, অধিকাংশ মানুষ কিছুই পাবে না সাময়িক উল্লাস আর দীর্ঘকালীন হতাশা ছাড়া। আমি পেসিমিস্ট নই, তবে ইতিহাস পড়তে পারি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের ইতিহাস শুধুই অদূরদর্শিতার ইতিহাস। অনেকটা দিল্লি কা লাড্ডু। এই ইতিহাস থেকে শিখলেও পস্তাবেন, না শিখলেও পস্তাবেন।

বিজয়ের আগে ফেসবুকে বিভিন্ন মিছিলের ছবি ও ভিডিও দেখলাম। খুব ভালো লাগলো লাখো কণ্ঠে ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা গানটি শুনে। ঘৃণা নয়, একমাত্র দেশপ্রেমই আমাদের পথ দেখাতে পারে। নতুন প্রজন্ম দেশকে ভালোবাসার জন্য মুখিয়ে আছে। ওদের কন্ঠে দেশাত্মবোধক গান দিন, ওদের জাতীয় সঙ্গীত দিন। সেদিন গর্বে বুক ভরে গেছিল। কিন্তু বিজয়ের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ দৈর্ঘ্য মূর্তির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নামালো উত্তেজিত জনতা। মনে পড়লো বাগদাদের দৃশ্য। সেখানে একই ভাবে উন্মত্ত জনতা টেনে নামিয়েছিল সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি। এটা কি কাকতালীয় ঘটনা নাকি ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা? শেখ মুজিব ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দিয়ে শুরু করে ধর্মনিরপেক্ষতায় এসেছিলেন, তাঁর কন্যা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্মীয় রাজনীতির হাতে দেশকে সমর্পণ করে বিদায় নিলেন। ফুল সার্কেল।

সব দেখে মনে হয় বাংলাদেশ এক বিশাল সুন্দর বন। বাঘ আর কুমীর দিয়ে ভরা। জনগণ নিরীহ হরিণ। বাঘের পেটে যাবে না কুমীরের – চয়েজ তোমার। তবে কুমীরের পেটে গেলে শেষ মুহূর্তে এক ঢোক জল গিলতে পারবে এই যা সান্ত্বনা। তৃতীয় পথ বিদ্রোহ – সব বাঘ, সব কুমীর আর সব হিংস্র প্রাণীর বিরুদ্ধে। কোন নেতা থাকবে না, সবাইকে নেতা হতে হবে। না, অন্যকে হুকুম দিতে নয়, দায়িত্ব নিয়ে বনকে হরিণের বাসযোগ্য করতে, সুন্দরী পাতার ভাগ সবাইকে সমান ভাবে দিতে এমনকি কেউ যদি হরিণ না হয়ে বানরও হয়। কোন দিন সেটা হবে কি না জানি না, তবে আশা তো আমরা করতেই পারি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো