চলমান সংবাদ

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নতুন যুগের সূচনা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ৭৫ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। তাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় আছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এছাড়াও, এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ৯ বছরের দীর্ঘ আন্দোলনেও দলটির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কিন্তু এসব সাফল্যের বিপরীতে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের পর দলটি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে শুরু করে। ক্ষমতাকে ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষায় তারা ধীরে ধীরে এক নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদী অবস্থান গ্রহণ করে, যার ফলে দেশের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণের অপসংস্কৃতি শুরু হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন লাভের পর, আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা দেশের বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ প্রশাসনসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া দেশের প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এছাড়াও, সরকারি প্রশাসনের প্রায় প্রতিটি স্তরে দলীয় ও অনুগত লোকদের বসিয়ে দেয়া হয়, যা রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করেছে। সাধারণ জনগণের ভোটাধিকারও হারিয়ে যেতে থাকে।

এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, তা আওয়ামী লীগ সরকার ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়কে কাজে লাগিয়ে শহীদ নূর হোসেন ও ডা. মিলনের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিরোধী দলসমূহের ব্যাপক বিরোধিতার মুখে আওয়ামী লীগ এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। এর পরের নির্বাচন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসের এক অন্ধকারতম অধ্যায়। জনগণ ভোট দিতে পারেনি; দিনের ভোট রাতে সম্পন্ন হয়েছে। এমন কলঙ্কিত নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরো অবনতির দিকে এগোয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও জনগণ তাদের পছন্দমতো প্রার্থী নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। এই সকল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের মনে একটি গভীর অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। এক পর্যায়ে, ছাত্রদের মধ্যে এই অসন্তোষ আরও তীব্র আকার ধারণ করে, যখন উচ্চ আদালত কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে বাতিল করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে রায় দেয় এবং ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল হয়। ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।

কিন্তু এই আন্দোলন কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসনের দলীয়করণ, বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এবং সমাজের সর্বত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্রোধ জমা হয়েছিল, তা কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এক বিশাল গণবিস্ফোরণ ঘটে। এর ফলাফল ছিল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। এই ঘটনাকে কেউ কেউ গণ অভ্যুত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, আবার কেউ কেউ একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে দেখছেন। দেশের সর্বত্র নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

এখন, দেশের মানুষ নতুনভাবে আশাবাদী হয়েছে, বিশেষ করে যখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারকে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের সবার আগে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন করে তাদের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দলীয়করণ এবং দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে এসব প্রতিষ্ঠানকে জনগণের সেবায় নিবেদিত করতে হবে।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগ উঠছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সব ধর্মের মানুষ শান্তিতে ও সম্প্রীতির সাথে বসবাস করতে পারে। সাম্প্রদায়িক হামলার মতো ঘটনা আমাদের সেই চেতনার পরিপন্থী এবং এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। একই সাথে, পতিত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কর্মীদের উপরও হামলা করা হচ্ছে। এই ধরনের আক্রমণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদি বিগত সরকারের বিভিন্ন অপকর্মের সাথে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কর্মীর সংশ্লিষ্টতা থাকে, তবে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই সমুচিত হবে। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো অধিকার কারও নেই।

এই আন্দোলনে শহীদ আবু সায়েদ, মুগ্ধসহ শত শত মানুষ শহীদ হয়েছে, অসংখ্য মানুষ পঙ্গু হয়েছে। এত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই সাফল্য যেন ম্লান না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এখন দেশের সব স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি – সাম্য, মানবিক মর্যাদা, এবং ন্যায়বিচার – বাস্তবায়িত হয়। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে আমরা এই মূলনীতিগুলো খুঁজে ফিরেছি, কিন্তু বারবার প্রতারিত হয়েছি। তবে এবার যেন আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জগদ্দল পাথরের মত বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের উপর যে কালো ছায়া ভর করেছে, তা দূর করতে হবে। দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনকে সঠিকভাবে পুনর্গঠিত করতে হলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

এখন সময় এসেছে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো আবারও প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের আরেকবার স্বাধীনতার সংগ্রামে নামতে হবে, যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। দেশকে পুনর্গঠিত করার এই যাত্রায় আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। জনগণের স্বপ্ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

শহীদদের আত্মত্যাগের মূল্য যেন আমরা কখনো ভুলে না যাই। তাদের ত্যাগের মধ্য দিয়েই একটি নতুন সূচনা সম্ভব হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমাদেরকে একটি নতুন, উন্নত, এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, সম্মান এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এই বিজয়কে যেন আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করি, যাতে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তাদের স্বপ্নের একটি সুখী এবং সমৃদ্ধ দেশ দেখতে পায়।

(লেখকঃ বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)