চলমান সংবাদ

ফেনীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

-যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি দেশের আট জেলায় বানভাসি ২৯ লাখ মানুষ

ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী। এ জেলায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশিরভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।

ভারত ত্রিপুরার গোমতী নদীর উজানে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে আসা প্রবল পানির ঢল ও টানা বৃষ্টিতে দেশের আরো ৮ জেলা বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। তিনি বলেন, দেশে আট জেলার চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০ টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন। মৃত লোক সংখ্যা দুইজন। একজন ফেনীতে, আরেকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। খবর বিডিনিউজের।

ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার গতকাল রাতে বলেন, জেলা সদর ও তিনটি উপজেলা বন্যাকবলিত। এ ছাড়া দাগনভূইয়া ও সোনাগাজী উপজেলা আংশিকভাবে বন্যাকবলিত। এসব এলাকার চার লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে। সেখানে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। বন্যাকবলিত তিনটিসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪০ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো হতাহত বা নিখোঁজের সংবাদ তারা পাননি। বন্যা উপদ্রুত উপজেলাগুলোতে পানি স্থির রয়েছে। বুধবার যে হারে পানি বাড়ছিল বৃহস্পতিবার তা অনেকটা স্থিতিশীল রয়েছে বলে প্রশাসনের ভাষ্য। তবে জেলা সদরের দিকে পানির উচ্চতা বাড়ছিল। ফেনী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়াইপুরের বাসিন্দা জহিরুল হক জানান, তার এলাকার রাস্তাঘাটে তিন ফুট উচ্চতায় পানি ওঠেছে। বুধবার বেলা ২টা থেকে এখনও পর্যন্ত শহরের বেশিরভাগ এলাকাতে বিদ্যুৎ নেই। তিনি বলেন, শহরের নিচু এলাকার লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে গেছে। তবে পাকা ভবনের লোকজন ছাদে বা দোতলায় আশ্রয় নিয়েছেন। বেশি উপদ্রুত এলাকায় উদ্ধার কাজ চললেও সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১২ ঘণ্টা ধরে ফেনীতে বৃষ্টিপাত না হলেও সদরে পানির উচ্চতা বাড়ছে। তবে শহরের হাসপাতাল ও প্রশাসনিক এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে।

যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি : এদিকে ফেনীর কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ, পানিতে ডুবে আছে। যাদের ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে তাদের ঠিকানা হয়েছে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, স্থানীয় মসজিদ ও মন্দিরে। বিভিন্ন স্কুলের ছোট ছোট কামড়ায় পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তারা খাবার পানি, শুকনো খাবারের সমস্যায় রয়েছেন বলেও জানান।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। এর আগে প্রবল বৃষ্টিতে ২ অগাস্ট পরশুরামের মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ১২টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর গত চার দিনের ভারী বৃষ্টিতে মুহুরী নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে তিন উপজেলার ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফেনী সদরের ছনুয়া ইউনিয়নের ভাঙা তাকিয়া, কালিদহ ইউনিয়নের মাইজবাড়িয়াসহ সংলগ্ন এলাকায় দিনভর উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম থেকে আসা একটি দল। বেলা সাড়ে ৩টায় ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ–সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানান, সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত তারা ৫৫ জনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়েছেন।

চাঁদপুরে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি, নেই বিদ্যুৎ : চার দিনের টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে চাঁদপুর জেলার ৩১টি ইউনিয়নে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সেইসঙ্গে বন্যা কবলিত এলাকায় দুই দিন ধরে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। গত ২৪ ঘণ্টায় এ জেলায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এলাকার বাসিন্দারা। পানিবন্দি শত শত পরিবার খাবারের কষ্টের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু নিয়ে দুর্বিষহ দিন পার করছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সদর উপজেলার বাগাদী, ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা, কড়ইতলি, পৌরসভা, গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, অতি বৃষ্টির কারণে বহু ঘরবাড়ি ও সড়ক তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত জেলার ৩১টি ইউনিয়নে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন।

আখাউড়ায় ভেঙেছে হাওরা নদীর বাঁধ, পানিবন্দি ১২ শতাধিক পরিবার : ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার হাওরা নদীর বাঁধের দুইটি স্থানে ভেঙে গেছে। এতে করে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আখাউড়া উপজেলার কর্ণেল বাজার এলাকায় হাওরা নদীর বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। এর আগে বুধবার মধ্যরাতে প্রবল বেগে আসা পানির চাপে একই ইউনিয়নের খোলাপাড়া এলাকায় হাওরার বাঁধ আরেকটি পয়েন্টে ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এছাড়া পানির স্রোত বাড়ায় উপজেলার শান্তিপুর ও ছয়ঘরিয়া এলাকায় দুইটি স্থানেও হাওরার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেগুলো যে কোনো সময় ভেঙে নতুন করে আরও গ্রাম প্লাবিত হতে পারে। জানা গেছে, উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত আখাউড়া ও কসবা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে। আখাউড়ার অন্তত আটটি স্থানে বাঁধ ও সড়ক ভেঙে ৪০টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এসব গ্রামে পানিবন্দি আছেন ১২ শতাধিক পরিবার। বিভিন্ন স্থানে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ আছে।