তুর্কি অটোমান যোদ্ধা
তুর্কি অটোমানরা তাদের যুদ্ধ কৌশলের কারণে দীর্ঘ সময় শাসন করতে পেরেছে।

জহির-উদ-দীন বাবর ভালো করেই জানতেন যে তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা শত্রু বাহিনীর তুলনায় আট ভাগ কম, তাই তিনি এমন একটি পদক্ষেপ নেন, যা ইব্রাহিম লোদি কল্পনাও করতে পারেননি।

বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার মুসলিম সম্রাট ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আর সেই পানিপথের যুদ্ধে অটোমান তুর্কিদের যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেছিলেন বাবর।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
ছবির ক্যাপশান, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়।

অটোমানদের উপহার যুদ্ধ কৌশল

তুর্কি অটোমানের যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী বাবরের বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে প্রথম সারিতে চামড়ার দড়ি দিয়ে সাতশ গরুর গাড়ি বাঁধেন।

তাদের পেছনেই বসানো হয় যুদ্ধ কামান। বলে রাখা ভালো, এটি ছিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ এবং এর আগে ভারতের কোনও যুদ্ধে কামানের ব্যবহার হয়নি। কামানের বিষয়ে অনেকে তখন জানতোই না।

শুরুর দিকে এই কামানগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা খুব একটা ভালো ছিল না।

তবে বাবর বাহিনী কামান থেকে নির্বিচারে গোলা বর্ষণ শুরু করলে এর আকস্মিক কান-ফাটানো বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ায় আফগান বাহিনী বিভ্রান্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে।

অথচ ইব্রাহীম লোদির বাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য ছাড়াও এক হাজারের মতো যুদ্ধ হাতি বা গজবাহিনী ছিল, কিন্তু সৈন্যদের মতো ‌এই হাতিগুলোও আগে কখনও কামানের বিস্ফোরণ শোনেনি।

এ কারণে কামান থেকে গোলা বিস্ফোরণের সাথে সাথে হাতিগুলো যুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিবর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ধোঁয়ায় সবার শ্বাসরোধ হয়ে আসে।

অন্যদিকে, বাবরের ১২ হাজার প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী অর্থাৎ ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করা যোদ্ধারা এমন মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

তারা বিদ্যুতের গতিতে এগিয়ে গিয়ে লোদির সেনাবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বাবরের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইতিহাসবিদ পল কে. ডেভিস তার বই ‘হান্ড্রেড ডিসাইসিভ ব্যাটেলস’-বইটিতে এই যুদ্ধকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সেই থেকেই মহান মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল।

১৭ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি
ছবির ক্যাপশান, ১৭ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি

অটোমান বা উসমানীয় যুদ্ধ কৌশল ছাড়াও বাবরের ওই যুদ্ধে দুই তুর্কি গোলা নিক্ষেপকারী ওস্তাদ আলী ও মুস্তফা এই বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বাবরকে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম খলিফা সেলিম তার ওই দুই সেনাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, অটোমান সাম্রাজ্য ১৩ শতকে উসমান গাজীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এই সময়ের মধ্যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং আনাতোলিয়া অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল।

উল্লেখ্য, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বর্তমান ইতালি, গ্রীস ও তুরস্ক আর উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। অন্যদিকে, আনাতোলিয়া হচ্ছে বর্তমান তুরস্কের বড় একটি অংশ।

উসমান গাজী, ১২৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সোগুত নামে ছোট একটি রাজ্যের তুর্কি সেনাপতি ছিলেন তিনি।

একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবেন।

উসমান স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবেন।
ছবির ক্যাপশান, উসমান স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবেন।

উসমানের স্বপ্ন

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল তার ‘উসমানস ড্রিম’ বইতে লিখেছেন যে উসমান এক রাতে শেখ আদিবালি নামে এক বৃদ্ধ দরবেশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।

ওই রাতে উসমান স্বপ্ন দেখেন যে তার বুক থেকে একটি বিশাল গাছ বেরিয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে এবং সারা বিশ্বে ছায়া ফেলছে।

উসমান পরে শেখ আদিবালীর কাছে তার এই স্বপ্নের কথা জানান। শেখ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন: “হে উসমান, বাবা আমার, ধন্য হও, আল্লাহ তোমাকে এবং তোমার বংশধরদের কাছে রাজকীয় সিংহাসন অর্পণ করেছেন।”

এই স্বপ্নটি উসমান গাজীর জন্য একটি প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি এখন ঈশ্বরের সমর্থন পেয়েছেন।

তারপর আনাতোলিয়ার বেশিরভাগ অংশ জয় করে, আশেপাশের সেলজুক ও তুর্কোমান রাজ্যসহ বাইজেন্টাইন দখল করে নেন।

উসমানের স্বপ্নটি পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের যৌক্তিকতা এবং একইসঙ্গে মিথ বা পৌরাণিক কথায় পরিণত হয়।

এই অটোমান সাম্রাজ্য ছয়শ’ বছর ধরে শাসন করেছে। এমন দীর্ঘ সময় ধরে তারা কেবল আনাতোলিয়া নয়, বরং তিনটি মহাদেশের বিশাল অংশ শাসন করে গিয়েছে।

ইস্তাম্বুলের সামরিক জাদুঘরে সুলতান মুরাদ, সুলতান বায়েজিদ ও সুলতান মেহমেতের প্রতিকৃতি

ছবির উৎস, TIM GRAHAM/ GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান, ইস্তাম্বুলের সামরিক জাদুঘরে সুলতান মুরাদ, সুলতান বায়েজিদ ও সুলতান মেহমেতের প্রতিকৃতি

উসমানের উত্তরসূরিরা ইউরোপের দিকে নজর দেয়। তারা ১৩২৬ সালে গ্রীসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর থেসালোনিকি জয় করে। এরপর ১৩৮৯ সালে সার্বিয়া জয় করে।

কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক বিজয় ছিল ১৪৫৩ সালে। ওই বছর তারা বাইজেন্টাইনের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করে।

মুসলমানরা এর আগের সাতশ’ বছর ধরে এই শহরটি দখলের চেষ্টা করলেও এটির ভৌগলিক অবস্থান এমন ছিল যে, তারা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়।

কনস্টান্টিনোপলের তিন দিক বসফরাস সাগরে বেষ্টিত হওয়ায় এই শহরটি আশ্রয়ের শহর হয়ে উঠেছিল।

বাইজেন্টাইনরা গোল্ডেন হর্ন পথটি বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের ২৮টি যুদ্ধজাহাজ অন্য দিকে পাহারা দিয়েছিল।

গোল্ডেন হর্ন হচ্ছে বসফরাস সাগরের সরু এক প্রণালী, যা ছিল ইস্তাম্বুল শহরের প্রধান জলপথ।

উসমানীয় সুলতান মেহমেত ফতেহ ১৪৫৩ সালের ২২শে এপ্রিল এমন এক পদক্ষেপ নেন যা কেউ ভাবতেও পারেনি।

তিনি মাটিতে তক্তা দিয়ে একটি মহাসড়ক তৈরি করেন এবং তেল-ঘি মিশিয়ে পথটিকে খুব পিচ্ছিল করে ফেলেন।

তারপর গবাদি পশুর সাহায্যে তার ৮০টি জাহাজকে এই পথে টেনে নিয়ে যান এবং এভাবে সহজেই ওই শহরের বিস্মিত প্রহরীদের পরাস্ত করেন তিনি।

বিজয়ী হয়ে মেহমেত তার রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে স্থানান্তর করেন এবং তাকে ‘সিজার অব রোম’ (রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা) উপাধি দেয়া হয়।

কনস্টান্টিনোপলে সুলতান মেহমেতের বিজয়ী আগমন
ছবির ক্যাপশান, কনস্টান্টিনোপলে সুলতান মেহমেতের বিজয়ী আগমন

প্রথম উসমানীয় খলিফা

এরপর বিজয়ী মেহমেতের নাতি ‘প্রথম সেলিম’ অন্যান্য দিকে দৃষ্টিপাত করেন।

তিনি ১৫১৬ ও ১৫১৭ সালে মিশরের মামলুকদের পরাজিত করে, মিশর ছাড়াও বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডানসহ সর্বোপরি হিজাজ জয় করে তার সাম্রাজ্যের আকার দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফেলেন।

এর পাশাপাশি, আজ থেকে ঠিক পাঁচশ বছর আগে হিজাজের দুটি পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা অধিগ্রহণ করে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হয়েছিলেন প্রথম সেলিম।

ধারণা করা হয়, উসমানীয় খিলাফত ১৫১৭ সালে শুরু হয়েছিল, এবং প্রথম সেলিমকে প্রথম খলিফা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তার আগ পর্যন্ত উসমানীয়দের ‘সুলতান’ বা ‘পাদশাহ্’ বলা হতো।

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইস্যু অফ খিলাফত’ বইতে লিখেছেন: ‘সুলতান সেলিম খান প্রথমের সময় থেকে আজ পর্যন্ত অটোমান তুর্কি সুলতানরা সব মুসলমানের খলিফা ও ইমাম ছিলেন।’

‘এই চার শতাব্দীর মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে খিলাফতের দাবিদারও উঠেনি। সরকারের কাছে শত শত খলিফা দাবিদার উঠেছে ঠিকই কিন্তু কেউ ইসলামের কেন্দ্রীয় খিলাফত দাবি করতে পারেনি।’

প্রথম সেলিমের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক সাম্রাজ্য দখল করতে পারতেন। এর বড় কারণ ছিল তার কার্যকর যুদ্ধ কৌশল।

পানিপথের যুদ্ধে তার এই রণকৌশল অনুসরণ করে ওই যুদ্ধে প্রথম গোলা বারুদ ব্যবহার করেন সম্রাট বাবর।

ওই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদিকে হারানোর পরই মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর।

প্রথম সেলিমকে সাধারণত প্রথম উসমানীয় খলিফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়
ছবির ক্যাপশান, প্রথম সেলিমকে সাধারণত প্রথম উসমানীয় খলিফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়

হুমায়ুন বনাম খলিফা

বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ুনও অটোমানদের এই অনুগ্রহের কথা মনে রেখেছিলেন। সেলিমের ছেলে সালমান আলিশানকে লেখা একটি চিঠিতে হুমায়ুন লেখেন:

‘খিলাফতের মর্যাদার ধারক, মহানতার স্তম্ভ, ইসলামের ভিত্তির রক্ষক সুলতানের জন্য শুভ কামনা। আপনার নাম সম্মানের সিলমোহরে খোদাই করা হয়েছে এবং আপনার সময়ে খেলাফত নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মহান আল্লাহ যেন আপনার খেলাফত অব্যাহত রাখেন।’

হুমায়ুনের ছেলে আকবর অবশ্য উসমানীয়দের সাথে কোনও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেননি।

যার কারণ সম্ভবত এই যে, ইরানের সাফাভিদ শাসকদের সাথে অটোমানরা তখন ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং আকবর সাফাভিদ শাসকদের ক্ষেপাতে চাননি।

তবে আকবরের উত্তরসূরি শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের অটোমান সুলতানদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল।

উপহার বিনিময় আর কূটনৈতিক মিশন তাদের মধ্যে সাধারণ বিষয় ছিল এবং তারা তাকে সমস্ত মুসলমানদের খলিফা বলে মনে করতেন।

শুধু মুঘলরা নয়, অন্যান্য ভারতীয় শাসকরাও অটোমানদেরকে তাদের খলিফা হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং ক্ষমতায় আসার পর তাদের কাছ থেকে আনুগত্য নেওয়া জরুরি বলে মনে করতেন।

টিপু সুলতান মহীশুরের শাসক হওয়ার পর, তিনি তৎকালীন অটোমান খলিফা তৃতীয় সেলিমের কাছ থেকে তার শাসনের জন্য সমর্থন চাইতে কনস্টান্টিনোপলে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন।

তৃতীয় সেলিম টিপু সুলতানকে তার নাম সম্বলিত একটি মুদ্রা টাকশাল করতে এবং শুক্রবারের খুতবায় তার নাম পাঠ করার অনুমতি দেন।

তবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য টিপু সুলতান যখন সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন তখন অটোমান খলিফা সেই অনুরোধ গ্রহণ করেননি।

কারণ সে সময় তিনি নিজে রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তখন শক্তিশালী ব্রিটিশ শত্রুদের পরাস্ত করা বেশ কঠিন হতো।

তুরস্কের জনপ্রিয় সিরিয়াল সুলতান সুলেইমান
তুরস্কের জনপ্রিয় সিরিয়াল সুলতান সুলেইমান

সুলতান সুলেইমান

অটোমানরা শুরুতে ইউরোপের অনেক অঞ্চল দখল করে। তবে এই সাম্রাজ্য রাজনীতি, রণনীতি, অর্থনীতি – এই তিনটি ক্ষেত্রেই সবচেয়ে প্রসার লাভ করে প্রথম সুলেইমানের আমলে।

তিনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সালে টানা ৪৫ বছর আমৃত্যু শাসনভারে ছিলেন।

সুলেইমান আলী খানের শাসনামলে সালতানাত বা অটোমান সাম্রাজ্য তার সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শীর্ষে পৌঁছেছিল।

এ কারণে তিনি পশ্চিম ইউরোপে ‘সুলেইমান দ্য মেগনিফিসেন্ট’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। অন্যদিকে, নিজ সাম্রাজ্যে তাকে বলা হতো কানুনি সুলতান।

বেলগ্রেড ও হাঙ্গেরি জয় করে সুলেইমান তার সীমানা মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। তবে দু’বার চেষ্টা করেও অস্ট্রিয়ার বিলাসবহুল শহর ভিয়েনা জয় করতে পারেননি তিনি।

(যাকে ঘিরে তুরস্কের জনপ্রিয় সিরিয়াল সুলতান সুলেইমান নির্মাণ করা হয়েছে। সিরিয়ালটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে।)

অটোমানরা দুইবার ভিয়েনা অবরোধ করলেও জয় করতে ব্যর্থ হয়
অটোমানরা দুইবার ভিয়েনা অবরোধ করলেও জয় করতে ব্যর্থ হয়

ইউরোপ এগিয়ে যায়

ইউরোপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১৬ ও ১৭ শতকে বিশ্বের বাকি অংশকে ছাড়িয়ে যায়। এর একটি কারণ সে সময় জাহাজ শিল্প বিকাশ লাভ করছিল।

এটি ছিল ইউরোপের ‘আবিষ্কারের যুগ’। অর্থাৎ ইউরোপীয় নৌবহর বিশেষ করে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ডাচ আর ব্রিটিশ নৌবহরগুলো সারা বিশ্বের সমুদ্র অন্বেষণ করছিল।

এভাবে আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কার হয় এবং ইউরোপীয়রা তা দখল করে। এই দখলদারিত্বের কারণে ইউরোপ বাকি বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

এসময় ইউরোপীয় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করে।

ইউরোপীয়দের জন্য বেশি বেশি জলযান চালাতে নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করা এবং যন্ত্রগুলো উন্নত করার প্রয়োজন হয়ে ওঠে।

এই প্রয়োজনীয়তা থেকে সে সময় ইউরোপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন করতে থাকে।

এ সময় দ্বিতীয় আরেকটি শিল্প বেশ বিকাশ লাভ করে। আর সেটি হচ্ছে ছাপাখানা। এই ছাপাখানার উদ্ভাবন হয়েছিল ১৪৩৯ সালে।

ইউরোপে বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ঘটানোর ক্ষেত্রে এক বিশাল ভূমিকা রেখেছিল এই ছাপাখানা।

সেই সময় বিজ্ঞান ও কলা – দুটি বিষয়ের উপর শুধুমাত্র অভিজাত ও গির্জার একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, ছাপাখানার বদৌলতে তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসে।

অটোমানরাও যদি ছাপাখানা ব্যবহার করা শুরু করতো, তাহলে হয়তো আজ পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো।

আমেরিকা মহাদেশে কলম্বাসের আগমন ছিল ইউরোপের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময় থেকে ইউরোপে জ্ঞান ও শিল্পের এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
আমেরিকা মহাদেশে কলম্বাসের আগমন ছিল ইউরোপের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময় থেকে ইউরোপে জ্ঞান ও শিল্পের এক নতুন যুগের সূচনা হয়।

কিন্তু সুলতান ফাতিহের পুত্র দ্বিতীয় বায়েজিদ ১৪৮৩ সালে, যারা আরবি হরফে বই ছাপাতেন, তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড আরোপ করেন।

এর কারণ ছিল, আলেমগণ ছাপাখানাকে ফেরাঙ্গিদের উদ্ভাবন বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। তাদের মতে, ফেরাঙ্গিদের আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে কুরআন বা আরবি লিপিতে বই ছাপানো ধর্মবিরোধী।

তাই ইউরোপ যখন সময়ের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন অটোমান সাম্রাজ্য বছরের পর বছর ততটাই পেছাতে থাকে এবং সংকুচিত হতে থাকে।

এরপর ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আনাতোলিয়া ছাড়া তাদের প্রায় সমস্ত অঞ্চল দখল করে নেয়।

ভারতের মুসলমানরা এতে অনেক ভেঙে পড়ে কারণ তারা অটোমান খলিফাকে তাদের ধর্মীয় শাসক ও নেতা হিসাবে বিবেচনা করতো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরিকল্পিত ভাঙ্গন এবং তাদের উপর ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানরা একটি রাজনৈতিক প্রচারণা শুরু করে যাকে ‘খিলাফত আন্দোলন’ বা ‘তেহরিক-ই-খিলাফাহ’ বলা হয়।

১৯১৯ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে এই খিলাফত আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়।

এই আন্দোলন থেকে ব্রিটিশদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে যদি তারা অটোমান খলিফা আবদুল হামিদকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করে তবে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।

খলিফা আন্দোলনে যোগ দেয়া নেতাদের মধ্যে আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, হাসরাত মোহানি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, জাফর আলী খান, মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও হাকিম আজমল খান অন্যতম ছিলেন।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (বাঁয়ে) গান্ধী (ডানে)
 মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (বাঁয়ে) গান্ধী (ডানে)

গান্ধী ছিলেন খিলাফতের সাথে, সরে দাঁড়িয়েছিলেন কায়েদ-ই-আজম

ভারতের কংগ্রেস পার্টি বা ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-আইএনসি’ ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করতে শুরু করে।

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আইন অমান্য অভিযানের সূত্রপাত হয়েছিল এই খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।

মজার ব্যাপার হলো, কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেকে এই আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে এটি সফল হবে না।

এই আন্দোলন গতি পাওয়ার আগে, ১৯২২ সালে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী বাহিনী দেশটি দখল করে এবং খলিফা আবদুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে খিলাফতের পদ বাতিল করে।

এর মাধ্যমে অটোমানদের ৬২৩ বছরের মহান সাম্রাজ্যের সূর্য চিরতরে অস্তমিত হয়।

ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় খিলাফত আন্দোলনে বেশ উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করে। মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন: ‘যারা ১৯২১ থেকে ১৯২২ সময়কাল দেখেননি তাদের জন্য বলতে হয় যে সে সময় ভারত একটি আগ্নেয়গিরির রূপ নিয়েছিল, উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ‘মিত্রশক্তি’র বিজয় তাদের পরিকল্পনা এবং খিলাফতের অবসান ঘটিয়েছিল।’

‘তাদের দখলের এই খবর সারা ভারতে আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল। মসজিদ, সমাবেশ, মাদ্রাসা, বাড়িঘর, দোকানপাট, কোথাও যেন এই বিষয় ছাড়া আর কোনও কথাবার্তাই হতো না।

উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, ইতালি, জাপান এবং ১৯১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মিত্রশক্তি’ বলা হতো।

মাওলানা শওকত আলী (চেয়ারে বসা) ছিলেন তেহরিক খিলাফতের একজন কর্মী
মাওলানা শওকত আলী (চেয়ারে বসা) ছিলেন তেহরিক খিলাফতের একজন কর্মী

সে সময় প্রতিটি যুবক, বৃদ্ধ, শিশু ও নর-নারীর মুখে এই একটি কবিতা উচ্চারিত হতো, যার বাংলা অনুবাদ অনেকটা এরকম:

বল মোহাম্মদ আলীর মা/দাও বাছা, তোমার জান দাও খলিফাকে

আন্দোলন সফল করার জন্য সাধারণ মানুষ উৎসাহী ছিল এবং নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অবদান রেখেছিল।

এমনকি সারা ভারত থেকে নারীরা তাদের চুড়ি ও কানের দুল খুলে খিলাফত কমিটিতে দিতেন।

প্রচলিত আছে যে, এক নারী তার সন্তানকে নিয়ে এসে খিলাফত কমিটির কাছে হস্তান্তর করেন এই বলে যে, এই বাচ্চা ছাড়া আমার দান করার কিছু নেই।

এরপরও খিলাফত আন্দোলন সফল হয়নি, কিন্তু তুরস্কের মানুষ আজও এই চেতনাকে মনে রেখেছে।

যারা তুরস্কে গেছেন তারা বলছেন, ভারতবর্ষের এই মুসলমান সম্প্রদায়ের যে সম্মান তুরস্কে আছে তা অন্য কোনও দেশে নেই।

# জাফর সৈয়দ, বিবিসি উর্দু