সীতাকুণ্ডে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভয়াবহ দুর্ঘটনা: ইঞ্জিন রুম ও পাম্প রুম কাটার সময় নিরাপত্তা সতর্কতা -ফজলুল কবির মিন্টু
বিগত ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত এস এন কর্পোরেশন গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। মালিক পক্ষের ভাষ্য এবং পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী এতে প্রায় ১২ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হন। আহতদের মধ্যে ৩ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন, এবং আরো ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। উক্ত ৬ জনের প্রত্যেকের শরীরের ৬০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গেছে এবং তাদের প্রায় সবার শ্বাসনালীও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে আহত বাকি ৬ জন আদৌ বাঁচবে কিনা সংশয় আছে। অভিজ্ঞমহল উক্ত দুর্ঘটনাকে শিপ ব্রেকিং সেক্টরের ইতিহাসে ভয়াবহতম দুর্ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠিত কমপ্লায়েন্ট গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে এই ধরণের দুর্ঘটনা ঘটায় আশংকার কারন বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বলাবাহুল্য জাহাজভাঙায় সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিপূর্ণ এরিয়া হচ্ছে, ইঞ্জিন রুম এবং পাম্প রুম। এই সব জায়গায় কাটার সময় যে সকল বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
প্রথমত, জাহাজের ইঞ্জিন রুম এবং পাম্প রুমের কাটার কাজ শুরু করার আগে একটি পূর্ণাঙ্গ ঝুঁকি মূল্যায়ন করা উচিত। এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সব ধরনের সম্ভাব্য বিপদ চিহ্নিত করতে হবে এবং কাজের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। মূল্যায়নের মধ্যে সবার আগে গ্যাস, তেল এবং অন্যান্য বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। এই উপাদানগুলির উপস্থিতি নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায়, তাই তাদের সঠিকভাবে সনাক্ত করে নিরাপদে অপসারণ করা প্রয়োজন।
জাহাজ কাটার শুরুতেই সর্বাগ্রে প্রধান পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দিতে হয়। এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি যে জাহাজের অভ্যন্তরে সমস্ত বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধের পর কোন বিদ্যুতের উৎস থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে না তা নিশ্চিত করতে হবে।
অতঃপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল গ্যাস ও তেলের লাইন বন্ধ করা। প্রতিটি গ্যাস এবং তেল সরবরাহের লাইনকে খুবই সতর্কতার সাথে সঠিকভাবে বন্ধ করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে কোথাও কোনো দাহ্য পদার্থ সঞ্চিত নেই। পাইপলাইনগুলিতে বিদ্যমান গ্যাস বা পদার্থ যদি যথাযথভাবে নিষ্কাশিত না হয়, তবে তা পরবর্তীতে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই পুরাতন জাহাজের ইঞ্জিন রুম এবং পাম্প রুম কাটার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমস্ত পাইপ খুলে ফেলা উচিৎ। পাইপগুলির ভিতরে থাকা তৈল, গ্যাস বা অন্য কোন দাহ্য পদার্থ অপসারণ না করা হলে, এটি কাজের সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পাইপগুলিকে সম্পূর্ণরূপে খোলার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অবাঞ্ছিত সঞ্চিত পদার্থ অপসারণ করা হয়, যা ভবিষ্যতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমায়।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, পাইপ খোলার সময় কোন গ্যাস কাটার ব্যবহার করা উচিত নয়। গ্যাস কাটার ব্যবহার করা হলে তা জ্বালানী গ্যাসের উন্মুক্ততা এবং উত্তপ্ত ধাতুর কারণে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তাই, পাইপ খোলার সময় স্বাভাবিক মেকানিক্যাল টুলস ব্যবহার করা উচিত এবং একদম নিশ্চিত হতে হবে যে কোন ধরণের আগুন বা তাপ উৎপন্ন হচ্ছে না।
এরপর, রুমগুলোর ভিতরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ভর্তি করা উচিত। এটি বিশেষত নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আগুন বা বিস্ফোরণের ঝুঁকি কমায় এবং যদি কোনো তেল বা অন্যান্য দাহ্য পদার্থ থেকে থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। পানি ভর্তি করার মাধ্যমে, পাম্প রুম এবং ইঞ্জিন রুমের নিচে জমে থাকা অবশিষ্ট পদার্থ এবং ধূলিকণা ধোয়া যায় এবং এটি একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।
ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের গুরুত্বও অপরিসীম। শ্রম আাইনের ৭৮(ক) ধারা এবং শ্রম বিধিমালা ৬৭ বিধি অনুসারে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম তথা হেলমেট, গগলস, গøাভস এবং সেফটি বুট ইত্যাদি ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। এই সকল নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহারে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এছাড়া, সকল সময় অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম হাতের কাছে রাখা উচিত এবং সেগুলি ব্যবহারের কৌশল জানা থাকাও বাঞ্চনীয়।
কাটার আগে ইঞ্জিন এবং পাম্পরুমে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজের এলাকায় পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে যদি সেখানে গ্যাস বা বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি থাকে। এটি যাতে করে কর্মীরা নিরাপদভাবে কাজ করতে পারে এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে দূরে থাকতে পারে।
জাহাজের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত এবং নিশ্চিত করতে হবে যে তারা নিরাপত্তা নির্দেশাবলী মেনে চলছে। ইঞ্জিন রুম এবং পাম্প রুমে কাজ করার সময় সার্বক্ষণিক অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিরাপত্তা টিম নিয়োজিত থাকা উচিত -যারা পুরো কাজের সময় পর্যবেক্ষণ করবে এবং যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রæত সাড়া দিতে সক্ষম হবে।
সর্বশেষে, যেকোন জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি থাকা উচিত। এতে অগ্নি দুর্ঘটনা, বিস্ফোরণ, বা অন্যান্য দুর্ঘটনার জন্য একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে, যে কোনো অনাকাংখিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে দ্রæত এবং কার্যকরভাবে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
এই সকল সতর্কতা এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে পুরাতন জাহাজের ইঞ্জিন রুম এবং পাম্প রুম কাটার কাজটি নিরাপদে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে এবং কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। ভবিষ্যতে সীতাকুÐের এস এন কর্পোরেশন গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের দুর্ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধ করতে সঠিক সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় আমাদেরকে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার বারবার হতে হবে।
(লেখক: বিল্স-ডিটিডিএ প্রকল্পের পেশাগত স¦াস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)