বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৬৪): মানুষের মন

-বিজন সাহা

কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। আমরা আসলে ছবি নিয়েই মূলত কথা বলি। আমাদের বন্ধুত্বের মূলে রয়েছে ছবি, সেটার শুরু ২০০৬ সালে। সে সময় আমরা একত্রে ফোকাস নামে ফটো ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা দু’ জন বাদে সেই সময়ের আর কেউই এই ক্লাবের সাথে নেই -–কেউ অপ্সরাদের ছবি তুলছে, কেউ বা অন্য দেশে। আমরা দু’ জন এখনও ক্লাব চালিয়ে যাচ্ছি নতুনদের নিয়ে। অনেক বিষয়েই আমাদের মতের মিল নেই, কিন্তু তাই বলে এক সাথে চলতে সমস্যা হয় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা একেবারেই ভিন্ন মত পোষণ করি বা বলা চলে কীভাবে সেটা বাস্তবায়ন করা যায় সে প্রশ্নে ভিন্ন মত পোষণ করি। তারপরেও আমরা একে অন্যের সাথে রাজনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। কারণ ভিন্ন মত না শুনলে কোন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়।

আজকাল আমি যখন মস্কো, দুবনা বা রাশিয়ার যেকোনো শহরে যাই চোখে পড়ে মধ্য এশিয়ার প্রচুর লোকজন। এদের বেশির ভাগ তাজিকস্তানের, আছে কিরঘিজিয়া, উজবেকিস্তান – এসব এলাকার লোকও। আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের লোক তো সব সময়ই ছিল আর ছিল জর্জিয়ার মানুষ। এরা এখনও আগের মতই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। কিন্তু কথা হচ্ছে মধ্য এশিয়া নিয়ে। এই যে তাজিক, কিরঘিজ বা উজবেকদের কথা বললাম, তারা মূলত বিভিন্ন ধরণের অড জবের সাথে জড়িত। নির্মাণ কাজ, রাস্তা পরিষ্কার, সুপার মার্কেটে জিনিসপত্র গোছানো, পরিষ্কার করা, গাড়ি চালানো ইত্যাদি সেক্টরে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সোভিয়েত আমলে আমি বিভিন্ন এলাকায় গেছি। তখন প্রায় সবাই ছিল লেখাপড়া জানা, শিক্ষিত, বিভিন্ন উৎপাদনের সাথে জড়িত। সব এলাকার মানুষই কোন না কোন কাজ, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক আর অন্য কিছু হোক, নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সে সময় কাজ না করে চলা যেত না আর সরকার সবার কাজের ব্যবস্থা করত। কাজ নেই বলে উপার্জন নেই – এটা বলে কেউ যাতে পার না পায় এ জন্য অলসদের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। এক কথায় যেকোনো সোভিয়েত মানুষের মতই এরা জীবন যাপন করত। এর আগে মানে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগে মধ্য এশিয়ার লোকজন ছিল প্রায় মধ্য যুগের বাসিন্দা। লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা ছিল হাতে গণা, মহিলারা ছিল পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত। মূলত মুসলিম প্রধান এই এলাকা ছিল যেকোনো ইসলামি রাষ্ট্রের মতই। বই পড়ে, সিনেমা দেখে বা লোকজনদের সাথে আলাপ করে এসব এলাকার সে রকমই একটি চিত্র পাওয়া যায়। তবে আশির দশকে, যখন আমার সুযোগ হয়েছে এসব এলাকায় যাওয়ার, বিভিন্ন স্থানে এদের সাথে মেশার, এসব এলাকা শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য এলাকার মতই ছিল। নারীরাও ছিল পুরুষদের পাশাপাশি দেশ গঠনের অগ্রণী সৈনিক। সে সময় এসব এলাকার শিশুরাও অন্যান্য এলাকার শিশুদের মত পাইওনিয়ার ক্যাম্পে যেত, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত। এক কথায় সবাই ছিল শিল্পোন্নত বিশ্বের নাগরিক, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত এসব চর্চা করত দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের মতই।

বিভিন্ন দেশে এরকম এক ধারণা বিদ্যমান যে বর্তমানে স্বাধীন এসব রাষ্ট্র ছিল রাশিয়ার উপনিবেশ। রাশিয়া এদের শোষণ করত। কারণ উপনিবেশ মানেই শোষিত। বিশেষ করে পশ্চিমা মাধ্যমে সেভাবেই তা প্রচারিত। কিন্তু প্রতিটি দেশই, তা সে বাল্টিকের দেশ হোক, ইউক্রেন হোক আর এশিয়ার দেশই হোক – সোভিয়েত আমলে সেই সময়ের তুলনায় উন্নত ছিল। রাশিয়া নিজে এসব দেশে প্রচুর বিনিয়োগ করত। ফলে যে আর্মেনিয়ার নিজের গ্যাস নেই সেখানেও সেই সময় প্রায় ১০০% গ্যাসায়ন হয়েছিল, পক্ষান্তরে প্রচুর গ্যাসের মালিক হয়েও রাশিয়ার সর্বত্র এখনও গ্যাস যায়নি। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় সেটা নয়। আমরা বলব বিভিন্ন দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর স্থানীয় এলিটরা সেসব দেশে সরকার গঠন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আগেও কমবেশি তাই হত, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতারাই সেসব রিপাবলিকের পরিচালনায় ছিল। এসব নেতারাই পরে নিজ নিজ দেশের শাসক হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত বৈদেশিক ঋণ নিজের কাঁধে তুলে নেয় এবং বিভিন্ন রিপাবলিকে প্রাকৃতিক সম্পদ তো বটেই, সোভিয়েত আমলে সমস্ত দেশবাসীর সহযোগিতায় যা গড়ে তোলা হয়েছিল সবই সেখানে রেখে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা – সব দিকেই বেশ ভালো অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হত। পশ্চিমা বিশ্বের মত না হলেও সব রিপাবলিকেই এসব ব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নত। তাহলে কেন দেশে একটা ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, কল কারখানা, কৃষি ব্যবস্থা এসব থাকার পরেও এসব দেশ স্বাধীনতার পরে সেটাকে ধরে রাখতে পারল না, কেন এসব দেশের তরুণ তরুণীরা নিজের দেশে কাজ না করে রাশিয়ায় আসে অড জব করার জন্য?

কেন যেন এটা মনে হয় জাতিগত বৈশিষ্ট্য। এই তো আমাদের দেশেও দুই শতাশিক বছর ব্রিটিশ শাসন ছিল। কিন্তু উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষই এখনও হাজার বছর ধরে চলে আসা রীতিনীতি মেনেই দিন কাটায়। এমনকি শিক্ষিত মানুষও দৈনন্দিন জীবনে স্থানীয় রীতিনীতিই মেনে চলে। এখনও বিভিন্ন উপজাতিরা তাদের মান্ধাতার আমলের জীবনযাত্রাই বেশি পছন্দ করে। যতদূর শুনেছি আমেরিকান ইন্ডিয়ানরা নিজেদের প্রথাগত জীবনকেই বেশি পছন্দ করে। অথবা যদি তাকাই আফগানিস্তানের দিকে। কয়েক বছর সোভিয়েত শাসন, কুড়ি বছরের আমেরিকান শাসনের পরেও প্রথম সুযোগেই তারা ফিরে গেছে মধ্য যুগে যেটা মিশে আছে তাদের রক্তে। তাহলে এই যে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সভ্যতাকে অনুসরণ করে তাদের মত হতে চাই বা কোন কোন সভ্যতা কোন জাতিতে জয় করে তাদের মধ্যে নিজেদের সভ্যতা ছড়িয়ে দিতে চায় সেটা কি আদৌ সম্ভব নয়? সত্তর বছরের সোভিয়েত শাসনে যেখান থেকে ঈশ্বরকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল সেখানেও কিন্তু প্রথম সুযোগেই তিনি ফিরে এসেছেন যেমন লেনিন ফিরে এসেছিলেন নির্বাসন থেকে ১৯১৭ সালে। ফিরে এসে লেনিন যেমন অক্টোবর বিল্পব ঘটিয়েছিলেন, ঈশ্বর তেমনি পেরেস্ত্রোইকার ফাঁকফোকর দিয়ে ফিরে এসে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেটা পেরেছিলেন, কারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরের চাহিদা ছিল, হাজার বছর ধরে ধীরে ধীরে যে বিশ্বাস তার মধ্যে বপন করা হয়েছিল, প্রতিকুল পরিবেশে সেটা লুকিয়ে থাকলেও অনুকূল পরিবেশ ঠিকই জীবন ফিরে পায়। এটা অনেকটা শীতে ডালপালা ন্যাড়া করে কোন মতে বেঁচে থেকে বসন্তে পাতা মেলার মত।
আসলে সমস্ত সমাজেই পরিবর্তন আসে আবেগপ্রবণ কিছু মানুষের হাত ধরে যারা লক্ষ্য অর্জনে জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। লেভ গুমিলেভের প্যাসনারি তত্ত্ব সেটাই বলে। এই অতি আবেগপ্রবণ বা প্যাসনারি মানুষের সংখ্যা কখনোই খুব বেশি নয়। তবে এরা জনতাকে মোহিত করে নিজেদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল এরা নিজেরা পরিবর্তিত হলেও জনতা ঠিক আগের মতই থেকে যায়, মানে অধিকাংশ মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্য এসব আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। সেটা যেকোনো দেশের বা যেকোনো জাতির ক্ষেত্রেই সত্যি। ফলে প্রায় সব জায়গায়ই আমরা দেখি আজ হোক কাল হোক সবাই দিনের শেষে নিজের হাজার বছরের অভ্যেসেই ফিরে আসে। এটা অনেকটা চুম্বকের সংস্পর্শে লোহার ক্ষণিকের জন্য অস্থায়ী চুম্বকে পরিণত হবার মত অথবা বাইরে থেকে ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে আয়নিত হবার মত। এসব বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক নিয়মেই ধীরে ধীরে উবে যায় আর বস্তু ফিরে আসে তার নিজের অবস্থায়। সেই অনেকটা পুনর্মূষিক ভব। তাহলে এই যে বার বার রঙ বেরঙের বসন্ত এনে দেশে দেশে মানুষকে পরিবর্তনের চেষ্টা তার কি কোন অর্থ হয়? কোন জাতি বা কোন জনগোষ্ঠী এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, হাজার বছরের অভ্যেস। তাহলে আমরা কেন বাইরে থেকে আনা বিভিন্ন রীতিনীতি নিজেদের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বদল না করে নিজেরাই বদলে যেতে চাই বা মানুষকে বদলানোর চেষ্টা করি? যদি কোন কিছু কোন জাতির ডিএনএ পর্যায়ে চলে যায় তাহলে কি দুই একটা সামাজিক বিপ্লব বা সংস্কারে সেটাকে উপড়ে ফেলা যায়? গণিত বা পদার্থবিদ্যায় অনেক সমস্যার সাধারণ সমাধান থাকে, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে সেটা কার্যকরী নাও হতে পারে যদি না সেটা ইনিশিয়াল বা বাউন্ডারি কন্ডিশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। সমাজের এই ইনিশিয়াল বা বাউন্ডারি কন্ডিশনগুলো হচ্ছে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, তার সংস্কৃতি, রীতিনীতি, তার প্রকৃতি। এসব বিবেচনায় না নিয়ে কোন কিছু চাপিয়ে দিতে গেলে প্রায়ই হিতে বিপরীত হয়। কথায় বলে এক দেশের গালি অন্য দেশের বুলি। তাই ভিন্ন কোন দেশের, তা সে যত উন্নতই হোক না কেন, নিয়ম কানুন যে আমাদের দেশের চলবে, সেটা প্রয়োগ করে আমাদের দেশের মানুষও যে একই রকম সুখ শান্তি পাবে সেটা ভাবা ভুল। সুখটা একান্তই ব্যক্তিগত। তাই জনগণকে নিজের মত করেই সুখী হতে দেয়ার চেষ্টা করা ভালো, বাইরে থেকে সুখ চাপিয়ে দিলে সেটা মানুষের পেটে হজম নাও হতে পারে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৬৩): জাতীয় সংগীতের অবমাননা কি আইনত দ্বন্দ্বনীয়?-বিজন সাহা

মানুষের মাঝে স্থানীয় সংস্কৃতি যত গভীরে শেকড় গাড়ে অন্য কিছু ততটা গভীরে যায় না। তাই দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শত্রুরা এটা বুঝে বলেই প্রথমেই আঘাত হানে দেশের সংস্কৃতিতে। সেটা দেশীয় সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করার অধ্য দিয়েই হোক অথবা নিজেদের সংস্কৃতি প্রচারের মধ্য দিয়েই হোক। নদীর তীরে যাদের জন্ম তাদের মন যেমন নদী দেখলেই উতলা হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি স্থানীয় সংস্কৃতির চর্চা মানুষকে তাদের শিকড় খুঁজে পেতে সাহায্য করে। দেশ বর্তমানে যে পথে হাঁটছে তাতে সারি, জারি, বাউল, কবিগান সহ যা কিছু দেশীয় তার চর্চা একান্ত জরুরি। কারণ এসব মানুষের কাছে মায়ের দুধের মত। স্বৈরাচারের পতনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অনেক অবদান ছিল। সেই বিজয়কে ধরে রাখতে হলে এখন তাদের নতুন করে মাঠে নামতে হবে, মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে তাদের গান, তাদের সুর।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো