চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ দুর্ঘটনা: শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জরুরি দাবি -ফজলুল কবির মিন্টু

৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত এস এন কর্পোরেশন গ্রিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১২ জন শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন এবং ৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে আমাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৮ জনে। এবারের দুর্ঘটনার তীব্রতা পূর্ববর্তী সকল দুর্ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে, যা পরিস্থিতির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
একটি গুরুতর দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সঠিক তদন্ত ও দায়ী পক্ষগুলির শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি, একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বস্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত, যাতে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর পাশাপাশি, দুর্ঘটনার মূল কারণ উদঘাটন করে দুর্ঘটনামুক্ত এবং নিরাপদ ইয়ার্ড ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বর্তমানে, জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা অত্যন্ত অনিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করছেন এবং পর্যাপ্ত মজুরি ও সুবিধা পাচ্ছেন না। ২০১৮ সালে ঘোষিত নিম্নতম মজুরি এখনো কার্যকর হয়নি, এবং শ্রম আইনের বিভিন্ন অধিকার যেমন সবেতন ছুটি, চিকিৎসা সুবিধা, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বিধান ইত্যাদি পালন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায়, শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে এবং একটি দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ জাহাজভাঙা ইয়ার্ড গড়ে তোলার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এছাড়া, এই শিল্প পরিবেশবান্ধব নয়। বর্জ্যের কারণে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদ দিন দিন কমছে এবং অনেক ইয়ার্ড মালিকের বিরুদ্ধে সরকারি খাস জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে।
এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে, নিম্নলিখিত দাবিসমূহ বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি:
১) দুর্ঘটনার তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা: দুর্ঘটনার মূল কারণ উদঘাটন করে একটি কার্যকরী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং দায়ী মালিকপক্ষ, কনসালটেন্ট ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২) তদন্ত কমিটিতে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি: গঠিত সকল তদন্ত কমিটিতে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৩) মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ: দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৪) আহত শ্রমিকদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ: আহত শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে এবং শ্রম আইন অনুযায়ী সবেতন ছুটি ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৫) পুনর্বাসন ও চাকরির ব্যবস্থা: নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে এবং তাদের মধ্যে অন্তত একজনকে জাহাজভাঙা ইয়ার্ডের বাইরে মালিকের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদান করতে হবে।
৬) নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র প্রদান: সকল শ্রমিককে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান করতে হবে।
৭) সবেতন ছুটি: শ্রম আইনের অনুযায়ী সকল সবেতন ছুটি প্রদান করতে হবে।
৮) নিম্নতম মজুরি: ২০১৮ সালের ঘোষিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ কার্যকর করে বকেয়া পরিশোধ ও নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে নিম্নতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করতে হবে।
৯) সরাসরি নিয়োগ: স্থায়ী পদে শ্রমিকদের নিয়োগে ঠিকাদারী ব্যবস্থার পরিবর্তে সরাসরি মালিকের অধীনে নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
১০) আইএলও কনভেনশন বাস্তবায়ন: আইএলও কনভেনশন ১ এবং শ্রম আইনের ধারা ১০০ অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস নির্ধারণ, প্রতি ঘণ্টায় ১৫ মিনিট বিশ্রামের বিধান এবং আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ অনুযায়ী অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন ও দর কষাকষির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাহাজভাঙা শিল্প যেহেতু শুধুমাত্র চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ, ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্ব চট্টগ্রাম শ্রম দপ্তরকে দিতে হবে।
এক্ষেত্রে সরকারের জরুরি পদক্ষেপের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব। শ্রমিকদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন।
(লেখকঃ বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক)