বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৬): অবিশ্বাসীর বিশ্বাস – বিজন সাহা
কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। টেলিফোনে। কথাবার্তার বিষয় বিভিন্ন। কথায় কথায় এল ধর্মের কথা।
– জান, আমি ধর্ম মানি না। নাস্তিক। ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।
– কিন্তু অবিশ্বাসও তো এক রকম বিশ্বাস। তাহলে বিশ্বাস করা না করা নিয়ে কথা বলার যুক্তি কোথায়?
– মানে? তুমি কি বলতে চাও নাস্তিকও বিশ্বাসী?
– তুমি যে অর্থে বলছ সেই অর্থে নয়, তবে তুমি একটা ধারণায় বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কর। তার মানে এই যে ঐ ধারণা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা তোমাকে ভাবায়। আর যদি কিছু নাই থাকে তা তোমাকে ভাবায় কেন সে প্রশ্ন করে দেখেছ কখনও? এটা অনেকটা ঋণের মত। তোমার ঋণ কিন্তু কাগজে কলমে বা কথায়। যেমন তুমি তোমার টাকা দেখাতে পারবে, কিন্তু ঋণ শুধু ধারণা। ঈশ্বরের থাকা না থাকা এই ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরং তাঁকে নিয়ে ভাবা বাদ দাও, তাহলেই দেখবে তোমাকে বলতে হবে না তুমি আস্তিক না নাস্তিক, তোমাকে প্রমাণ করতে হবে না ঈশ্বর আছে কি নেই।
– ঠিক আছে। তোমার কথা না হয় মনলাম। কিন্তু এই যে ধর্মের নামে এত খুনোখুনি, এত রক্তপাত, মানুষের এত দুঃখ দুর্দশা এর কী হবে?
– আচ্ছা, এসব কি শুধু ধর্মের নামেই হয় বা হচ্ছে? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মানবতা, নারী অধিকার কিসের নামে আজ এসব খুনোখুনি, রক্তপাত ঘটছে না? যদি ইতিহাস ঘাঁট দেখবে এই ধর্মও এক সময় রাজাদের ও তাদের পুরোহিতদের হাত ধরে এসেছে। এসেছে ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, ক্ষমতা অর্জনের জন্য। সেই সময় লোকজনের বিজ্ঞান ভিত্তিক কোন জ্ঞান ছিল না, তাই ধর্মের কথা বলে, স্বর্গের লোভ আর নরকের ভয় দেখিয়ে তাদের ঠকানো হত। এখনও সেরকম মানুষের অভাব নেই। কিন্তু একই সাথে বেড়েছে সেই সব মানুষ যারা এসব অলৌকিক গল্পে বিশ্বাস করে না। আর তাই এদের ঠকানোর জন্য গণতন্ত্র, সাম্য, বাক-স্বাধীনতা, নারী অধিকার এসব গালভরা বুলি ব্যবহার করা হয়। আমরা শিক্ষিত লোকজন এতে বিশ্বাস করি, এসব ধারণাকে আধুনিক মনে করি। এবং বিশ্বাস করে প্রায়ই ঠকি। কারণ দিনের শেষে সবাই এসব ব্যবহার করে ক্ষমতার জন্য, মানুষ ঠকানোর জন্য, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। বিগত তিন দশকে গণতন্ত্রের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে কত দেশ ধ্বংস করা হয়েছে, কত শত সহস্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সেটা ভেবে দেখ।
– সেটা মানি। তবে ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায় সেটা তো অস্বীকার করতে পারবে না। ছোটবেলায় আমার খেলার সাথীরা যখন বাড়িতে বেড়াতে আসত তখন তাদের ঘরে ঢুকতে দেয়া হত না। সেটা কিন্তু ধর্মের কারণেই। তখন থেকেই ধর্মের প্রতি আমার অশ্রদ্ধা।
– কিন্তু এই সমস্যা কী শুধু ধর্মের কারণে? মনে হয় না। অর্থাৎ শুধু বিধর্মী নয়, নিজের ধর্মের লোকজনদেরও ঘরে ঢুকতে দেয়া হত না। না, আমি ধর্ম মানতে বা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে বলছি না। আমি বলছি তাঁকে নিয়ে একেবারেই না ভাবতে। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই ভূতের ভয় পেতাম। এখনও হয়তো অনেকেই পায়। দেশে তো পায়ই। এখানকার লোকজন কিন্তু ভূতের ভয় পায় না। অন্তত আমি এমনটা দেখিনি। তার মানে তারা ভুতকে পাত্তা দেয় না, ভূত নিয়ে ভাবে না। আর যখন কিছু নিয়ে ভাবা বাদ দাও তখন সে তোমার জীবন থেকে এমনিতেই নাই হয়ে যায়। ধর তুমি কাউকে ভালোবাস বা ভালোবাসতে। কিন্তু কোন কারণে সেই সম্পর্কে ছেদ পড়ল। যতদিন পর্যন্ত তুমি তাকে ঘৃণা করবে ততদিন সে তোমার জীবনে থাকবে, তোমার ভাবনায় থাকবে, এমনকি তোমার সিদ্ধন্তে প্রভাব ফেলবে। কিন্তু যখন তুমি তার প্রতি নির্লিপ্ত হবে দেখবে তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ, সে আর তোমার জীবনে কোন ভাবেই প্রভাব ফেলছে না। ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও তাই। কারণ আমরা চাই বা না চাই অনেক মানুষ ঠিকই ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে, তারা উপাসনা করবে, পূজা পার্বণ করবে। এরা যদি তোমার কাছের মানুষ হয় তাহলে নিজেদের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হবে। সেটার কি আদৌ দরকার আছে? আর ঐ যে মানুষে মানুষে বিভেদের কথা বললে, সেটা কি শুধুই ধর্মের কারণে? দেশে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির লোকজন একে অন্যের মুখ দেখে না, আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদেরও একই অবস্থা। তাই সমস্যা মনে হয় আরও গভীরে। সেটা আমাদের কেউ যে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে এই সহজ সত্যটি গ্রহণ করার অপারগতা। অথচ আমরা ভেবে দেখি না ঐ লোকের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি নিজেও ভিন্ন মত পোষণ করছি। তাই আমার মনে হয় ধর্ম, অধর্ম, আস্তিক, নাস্তিক এসব নিয়ে সময় নষ্ট না করে আমরা যদি ছোটবেলা থেকেই সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা এসব বিষয়ে ভাবি, এসব বিষয়ে শিক্ষা দেই তাহলে এই ভেদাভেদ, এই ঘৃণা অনেকাংশেই দূর হয়ে যাবে। আর এ জন্যে দরকার সামাজিক পরিবর্তন, সামাজিক সংস্কার। বিপ্লবের কথা বলছি না, কারণ বিপ্লবের পেছনে এক ধরণের জবরদস্তি থাকে। অর্থাৎ এক দল লোক জোর করে তাদের মত অন্যদের উপরে চাপিয়ে দেয়। ফলে সেটা আর যাই হোক কখনোই সবাই মনেপ্রাণে গ্রহণ করে না। সুযোগ পেলেই প্রতিবিপ্লব ঘটায়। কিন্তু আমরা যদি মানুষকে বুঝিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারি সেটা হয় পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে সমাজের ভেতরে অসন্তোষ কম থাকে। তুমি যখন কাউকে বোঝাতে যাও তোমাকে ইচ্ছা অনিচ্ছায় তার কথা শুনতে হয়, তার সমস্যার কথা জানতে হয়, এমনকি তার জুতা পরে কিছুটা হলেও চলতে হয়। তখন এক ধরণের বন্ধন তোমাদের আবদ্ধ করে। কিন্তু যখন তুমি গায়ের জোরে বা পদাধিকার বলে কারো উপর কিছু চাপিয়ে দাও তখন কিন্তু বোঝাপড়া গড়ে ওঠে না। আমরা কিন্তু এই বোঝাপড়া হরহামেশাই করছি। বিভিন্ন ক্লাবে, সংগঠনে এমনকি রাজনৈতিক দলেও এটা হয়। আমরা পরস্পরের বন্ধু বা কমরেড হই, একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসি। এর মানে এটা সম্ভব। আপাতত যেটা স্বল্প পরিসরে হচ্ছে সেটাকে বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেয়া – এটাই তো। চেষ্টা করতে অসুবিধা কি?
– কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমাদের দেশে, যেখানে বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি, বিশেষ করে ধর্মীয় অনুভূতি এত প্রবল, যেখানে ভালোবাসা নয়, ভিন্ন মতের প্রতি ঘৃণাই সব কিছুর চালিকাশক্তি – সেখানে ভালোবাসার স্থান কোথায়? মহাত্মা গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন – সফল হননি, আমরা কোন ছার।
– জানি সেটা কঠিন। কিন্তু এই বাংলার মানুষই একদিন এককাট্টা হয়ে যুদ্ধ করেছিল পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। বিজয়ী হয়েছিল সেই যুদ্ধে। একবার পেরেছি, আবার না পারার কারণ দেখি না।
– ঐ বিজয়ের কথা আর বল না। আজ সেই বিজয় আমাদের হাতছাড়া। একাত্তরের পরাজিত শক্তির হাতে এখন দেশের চাবিকাঠি। কয়েকদিন পরে একাত্তরের নাম পর্যন্ত নিতে পারবে না।
– সেটা যতটা না ওদের কৃতিত্ব, তারচেয়ে বেশি আমাদের ব্যর্থতা। আমরা বিজয় পেয়েছি, কিন্তু যুদ্ধে জয় তো ছিল লক্ষ্য অর্জনের প্রথম ধাপ। সেখানেই আমরা পরস্পরের সাথে ঝগড়া শুরু করেছি ট্রফি নিয়ে। সুযোগ আমরাই দিয়েছি। তাই আমাদের পরাজয় যতটা না শত্রুর শক্তি তারচেয়েও বেশি আমাদের দুর্বলতা। কিন্তু এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও সময় আছে স্বাধীনতার পক্ষের সমস্ত শক্তির ঐক্যবদ্ধ হবার, এক হয়ে লড়াই করার। আর এজন্যে দরকার পারস্পরিক বোঝাপড়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যদি সেটা করতে পারি, আমার বিশ্বাস একদিন আমরা ঠিকই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব।
– সেই আশায়ই বসে থাক।
– আশা থেকেই সব হয়। তবে বসে থাকলে হবে না। কাজ করতে হবে। শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়েই।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো